স্মার্ট এয়ারপোর্ট সার্ভিস

আবদুল মান্নান: আমাদের পৃথিবীটা অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে পাল্টে যাচ্ছে। পুরনো ধ্যান ধারণার পরিবর্তে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা সংযোজন করে নতুন কিছু করার চেষ্টা চলছে বিশ্ব জুড়ে। এসবের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও অনেক বেশি সহজ ও স্বাচ্ছন্দময় করে তোলা। প্রতিযোগিতা চলছে কে কতো ইনোভেটিভ ওয়েতে দ্রুততার সাথে সহজে ইতিবাচকভাবে সেবা গ্রহীতার আকাঙ্খা অনুযায়ী সেবাটি পৌঁছাতে পারে। শুধু কি তাই সেবা গ্রহীতার সন্তুষ্টির জন্য আরও কী কী করা যেতে পারে তা নিয়েও চলে সবিস্তর গবেষণা। এটতো বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত  একটি দেশের বিমানবন্দর থেকেই সে দেশের সম্পর্কে অনেক কিছুর ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের দেশের বিমানবন্দরের সেবা নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ কম বেশি সকলেরই অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষও কম বেশি সচেতন। তারাও চেষ্টা করছেন ধাপে ধাপে এ সব সমস্যার সমাধান করার।

সারা বিশ্বেই বিমানবন্দর ব্যবস্হাপনায় পরিবর্তন ঘটছে। বিশ্বের প্রায় সকল বিমানবন্দরের সেবাগুলোকে ডিজিটাল সেবায় রূপান্তর করা হয়েছে এবং হচ্ছে। একদিকে যেমন বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্হাকে নিচ্ছিদ্র করা হচ্ছে আবার ঠিক এর পাশাপাশি যাত্রী সেবা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর রয়েছে। এগুলো হলো ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, চট্টগ্রামে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর এবং সিলেটে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। এছাড়াও কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বিমানবন্দরে রানওয়ের সম্প্রসারণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করার লক্ষ্যে অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য হবে ১০ হাজার ৭ শত ফুট,যা বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ রানওয়ে সমৃদ্ধ বিমানবন্দরের মর্যাদা পাবে। এখানে উল্লেখ্য যে এই রানওয়ের ১ হাজার ৩ শ ফুট থাকবে সমুদ্রের মধ্যে। ভবিষ্যতে কক্সবাজার বিমানবন্দর আমাদের পূর্ব দিকের দেশ বিশেষ করে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিফাইনসহ পূর্বমুখী দেশগুলোর সুপরিসর বিমানগুলোর এ বিমানবন্দর ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ  সৃষ্টি হচ্ছে। কক্সবাজার বিমানবন্দরকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে পূর্বমুখী দেশগুলো বিমান খুব সহজেই পশ্চিমের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। এর ফলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প আরও বিকশিত হবে। সামগ্রিকভাবে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ চারটি বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলের সুবিধা রয়েছে। এর পাশাপাশি দেশে আরও চারটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর রয়েছে। এগুলো হলো যশোর, রাজশাহী, সৈয়দপুর ও বরিশাল। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উন্নীতকরে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার  লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যে পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশের পতাকাবাহী ২১ টি বিমান দিয়ে বাংলাদেশ বিমান ৪ টি মহাদেশের ১৬ টি দেশে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। বেসরকারি খাতের ইউএস-বাংলা ও নভোএয়ার নিয়মিত দেশে বিদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।সরকার  দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসমূহের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সি ওয়ে,হ্যাংগার ও আমদানি রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডসমূহ সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে বর্হি:বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যবসাবাণিজ্যসহ অনেক বিষয়েই এখন দূর প্রাচ্যের দেশগুলোর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দিন দিন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। বিশ্ববাসীর আগ্রহের জায়গায় চলে এসেছে বাংলাদেশ। এরই ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ বিদেশিদের বাংলাদেশে নিয়মিত যাতায়াত দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আমাদের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরগুলোতে যাত্রীসংখ্যা ও কার্গো হ্যান্ডলিং বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বর্ধিত চাপ সামাল দেওয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সর্বাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ সুবিধাসহ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে আদলে এটি নির্মিত হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের রোহানি বাহরিনের নকশা বাস্তবায়ন করছে জাপানের দুইটি কোম্পানি মিতসুবিশি ও ফুজিতা এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় স্যামসং কনস্ট্রাকশন এন্ড টেকিং করপোরেশন। বর্তমানে এক লাখ বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে  শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের দুটি টার্মিনাল। আর তৃতীয় টার্মিনালটি হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২১ হাজার ৩ শ কোটি টাকারও বেশি। এখানে থাকবে দুটি হাই স্পিড ট্যাক্সিওয়ে। যাতে বিমানগুলোকে বেশি সময় রানওয়ে না থাকতে হয়। বিমান বেশি সময় রানওয়েতে অবস্থান করলে অন্য বিমানের উঠানামা করতে সমস্যা হয়। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিন তলা ভবন। যাতে একসাথে ১ হাজার ৩ শত গাড়ি পার্কিং করা যাবে। দীর্ঘদিনের গাড়ি পার্কিংয়ের সমস্যার সমাধান হবে। ইতোপূর্বে গাড়ি পার্কিং  বিমানবন্দর ব্যবস্হাপনা ও নিরাপত্তার জন্য সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হতো। গাড়ি পার্কিংয়েও থাকবে ডিজিটাল ব্যবস্হাপনা।হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের বছরে বর্তমান ৮০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এ সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে ২ কোটিতে উন্নীত হবে। যাত্রীদেরকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হবে না। এজন্য  একশত পনেরটি চেক ইন কাউন্টার এবং ১২ টি বোর্ডিং ব্রিজ যা সরাসরি বিমানের সাথে সংযুক্তির ব্যবস্হা থাকবে। বহির্গমন ও আগমনী ইমিগ্রেশনের জন্য ৬৪ টি করে কাউন্টার থাকবে এবং লাগেজ টানার জন্য ১৬ টি অত্যাধুনিক কনভয় বেল্ট থাকবে। আগমনী কার্গো টার্মিনাল হবে ২৭ হাজার বর্গ মিটারের। রাজধানীর কাওলা রেলস্টেশনকে তৈরি করা হচ্ছে শুধু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে যাওয়ার জন্য। এছাড়াও মেট্রোরেল -১ কমলাপুর থেকে শুরু হয়ে বিমানবন্দরে সংযুক্ত হবে।এর পুরোটাই হবে পাতালরেল। একই সাথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টার্মিনালে নামার জন্য সুড়ঙ্গ পথও থাকবে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর যে সব যাত্রীরা ব্যবহার করবেন তারা খুব সহজেই ঝামেলামুক্ত পরিবেশে দ্রুত নিরাপদে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন একইভাবে যারা এ বিমানবন্দর ব্যবহার করে দেশের বাইরে যাবেন তারাও বিমানবন্দরে সকল প্রকার আধুনিক সুযোগ সুবিধা পাবেন এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের আকাশসীমায় ও বিমানবন্দরসমূহে চলাচলকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল বিমানের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের। সরকার বাংলাদেশের আকাশসীমায় ও বিমানবন্দরসমূহে চলাচলকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল বিমানের সময়ানুগ,দ্রুত ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিমানবন্দর, এয়ার ট্রাফিক, এয়ার নেভিগেশন, টেলিযোগাযোগ সেবা ও সুবিধা বিশ্বমানের পর্যায়ে পৌঁছাতে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যাত্রীদের এয়ারপোর্টে ডিজিটাল সার্ভিস দেওয়া শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। এয়ারপোর্টের সকল সার্ভিসই পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ই- গেইট সুবিধা চালু করা হয়েছে। অত্যাধুনিক স্কিনিং মেশিন স্হাপনের মাধ্যমে  প্যাসেঞ্জার ও কার্গো সিকিউরিটি স্কিনিং এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়াও অত্যাধুনিক দুইটি ইডিএস ( এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম) স্হাপনের মাধ্যমে কার্গো হ্যান্ডেলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ব্যবহারকারীদের প্রধান ছয়টি  অভিযোগ হলো টলির স্বল্পতা, লাগেজে পেতে বিলম্ব,লাগেজ থেকে মূল্যবান জিনিস চুরি হওয়া, ইমিগ্রেশনে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ,সেবাদাতার অসহযোগিতা , বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে পরিবহণ ও নিরাপত্তার সমস্যা। কর্তৃপক্ষ স্মার্ট এয়ারপোর্ট ব্যবস্হাপনার আওতায় এ বিষয়গুলোসহ আরও যে বিষয়গুলো ঘাটতি রয়েছে সেগুলো বিবেচনা নিয়ে পর্যায়ক্রমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করছে। ইতিমধ্যে টলির সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। লাগেজ প্রাপ্তির সময় কমিয়ে আনা হয়েছে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এটি আরও কমে আসবে। লাগেজ থেকে মূল্যবান জিনিস চুরি ঠেকাতে সিসি ক্যমেরাসহ নিরাপত্তা ও পরিদর্শন জোরদার করা হয়েছে। বিমানবন্দরের সকল শ্রেণির কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং মোটিভেশান দেওয়া হচ্ছে । আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এয়ারপোর্ট এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কাজ করছে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্মার্ট বিমানবন্দর ব্যবস্হসপনা এখন সময়ের দাবি। বিমান বন্দরের যাত্রী সেবা, কার্গো হ্যান্ডলিং,নিরাপত্তা ব্যবস্হাসহ বিমানবন্দর ব্যবস্হসপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার,দক্ষ জনবল নিয়োগ এবং বিমানবন্দর ব্যবহারকারীদের সচেতন করতে সকল পক্ষকে সম্বলিতভাবে কাজ করতে হবে, তবেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে।

লেখক: সিভিল এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nineteen + 2 =