স্মৃতিচারণ

স্বাধীনতার মাসে ঝরে পড়া তিন গুণী

সম্প্রতি সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ঢাকাই সিনেমার তিন কলাকুশলী-অভিনেতা। স্বাধীনতার মাসে না ফেরার দেশে চলে গেছেন নন্দিত নৃত্য পরিচালক মাসুম বাবুল, প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক জেড এইচ মিন্টু এবং অভিনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেকুজ্জামান। তিনি শিল্পীকে হারিয়ে শোকার্ত চলচ্চিত্রের মানুষেরা। তাদের নিয়ে রঙবেরঙের এই ছোট্ট আয়োজন। ঢাকায় সিনেমায় অনেক অবদান রেখেছেন এই তিনজন মানুষ। রোজ অ্যাডেনিয়ামের প্রতিবেদনে দেখে নেওয়া যাক তাদের বর্ণিল জীবন।

মাসুম বাবুল নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান

পর্দার আড়ালেই কাজ করে গেছেন সারা জীবন। এক জীবনে চলচ্চিত্রের জন্য করেছেন অনেক। বিনিময়ে পেয়েছেন অসংখ্য তারকার ভালোবাসা। যে সিনেমার নৃত্যপরিচালক হিসেবে যুক্ত থাকতেন মাসুম বাবুল সেই সিনেমার কলাকুশলীরা নিশ্চিত হতেন তাদের নাচের কোরিওগ্রাফি নিয়ে আর কোনো ভাবনা নেই। নৃত্য পরিচালক হিসেবে তিন তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন মাসুম বাবুল। ১৯৯৩ সালে ‘দোলা’, ২০০৮ সালে ‘কি জাদু করিলা’, ও ২০১৮ সালে ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবির জন্য নৃত্য পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। বঙ্গবন্ধুর বায়োগ্রাফিতে একমাত্র বাংলাদেশি টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। সিনেমাটি মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

চির নিদ্রায় মাসুম বাবুল

২০২৩ সালের ৬ মার্চ ঢাকার সিদ্দিক বাজারের নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন মাসুম বাবুল। তিনি দেড় বছর ধরে ক্যানসারে ভুগছিলেন। মাঝে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ২০২২ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি। ১৯৬২ সালের ৩১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন মাসুম বাবুল। ঢাকাই সিনেমার একজন প্রবীণ নৃত্য পরিচালক ছিলেন তিনি। শাবানা থেকে শাবনূর, নানা প্রজন্মের নায়িকারাই পর্দায় ঝড় তুলেছেন তার নির্দেশনার নাচের মুদ্রায়। শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়ের আঙ্গিনায় পা রেখেছিলেন মাসুম বাবুল। তারপর হয়ে ওঠেন তারকাদের নাচের গুরু। দিনে দিনে নিজেকে তারকা নৃত্য পরিচালক হিসেবে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে নিয়ে যান। চার দশকের ক্যারিয়ারে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘কোটি টাকার কাবিন’, ‘বিক্ষোভ’সহ বহু চলচ্চিত্রে নৃত্য পরিচালনা করেছেন।

বাবুলকে নিয়ে অপুর স্মৃতিচারণ

প্রয়াত নৃত্যপরিচালক মাসুম বাবুলকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন ঢালিউড কুইনখ্যাত চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস। নিজের ফেসবুকে অপু বিশ্বাস লিখেছেন, ‘এই মানুষটাকে আমি দাদা বলে ডাকতাম। কলকাতায় চিকিৎসাকালীন আমাকে বলেছিল, শিং মাছের তরকারির ঝোল খেতে চাই। আমি যেভাবে পারি দিয়েছিলাম।’ অপু বিশ্বাস আরও লেখেন, ‘সেদিন এস এ হক অলীক ভাই ছিলেন। খুব মনে পড়ছে দাদা। মা নেই তুমি নেই, কী বলব জানি না। ওপারে ভালো থেকো।’

বুলবুল বিশ্বাসের স্মৃতিচারণ

নির্মাতা তার ফেসবুকে মাসুম বাবুলকে নিয়ে বলেন, ‘খোলা-চিঠি: আমার যেন বাম হাতের লাঠিটাই হারিয়ে গেলো। মাসুম ভাই আর নেই। অপূর্ব রানা ভাই সংবাদটা জানানোর পর থেকেই যেন অবসাদ ঘিরে ধরলো। পুরা একটা রাত পার করলাম, কিছুতেই ঘুমাতে পারলাম না। কত আড্ডা, কত স্মৃতি। হঠাৎই সকালে মাথায় আসলো, আজও যদি তাকে নিয়ে দু’লাইন না লিখি, তাইলে আর কবে লিখবো! সংযুক্ত ছবিই প্রমাণ দেয়, কেমন হাসি-খুশি আর প্রাণবন্ত ছিলো মানুষটা।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো তার সাথে কাজ করার। তার সান্নিধ্য পাওয়ার। তার কাজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিলো, গানের মধ্যে গল্পের আমেজ ঠিক রেখে দৃশ্য ও নাচের মুদ্রার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। যা বর্তমানের কোরিওগ্রাফারদের মাঝে বিরল। অনেক শিষ্যই রেখে গেলেন তিনি। জানিনা, তারা পারবেন কি না, তার এ পরম্পরা, এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে? আশা করি তারা চেষ্টা করে যাবেন। মাসুম বাবুল নামটাই একটা প্রতিষ্ঠান, একটা ইতিহাস। ভাইজান তুমি ভালো থেকো।’

শোকাহত চলচ্চিত্র পরিবার

নৃত্য পরিচালক মাসুম বাবুলের মৃত্যু সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লে ফেসবুকে অভিনেতা জায়েদ খান তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে একটি ছবি পোস্ট করেন। যেখানে তিনি লেখেন, ‘আমাদের সবার প্রিয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত কোরিওগ্রাফার মাসুম বাবুল সাহেব আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আজ বিকাল (৬ মার্চ) আনুমানিক ৫.৪৫ মিনিটে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। তার পরিবারের পক্ষ থেকে সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করেছে।’

চিত্রগ্রাহক জেড এইচ মিন্টু

প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক জেড এইচ মিন্টু সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ২০২৩ সালের ১০ মার্চ। ওই দিন ভোর ছয়টায় নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৬৬ বছর। স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন এই গুণী মানুষটি।

স্ট্রোক; অতঃপর…

প্রায় তিন মাস আগে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে মিন্টু স্ট্রোক করেছিলেন। সর্বশেষ তিনি রাজধানীর মহাখালী মেট্রোপলিটন হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রথমে তার ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে। পরবর্তী সময়ে নিউরো সার্জন অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়ার তত্ত্বাবধানে মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। সফলভাবে মস্তিষ্ক থেকে টিউমার অপসারণ করা হলেও বায়োপসিতে তার ব্রেন ক্যানসার ধরা পড়ে। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু রেডিওথেরাপি নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা না থাকায় চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে বাসায় আনা হয়।

মিন্টুর সাড়া জাগানো সিনেমা

জেড এইচ মিন্টু একাধারে প্রযোজক ও পরিচালক ছিলেন। গুণী এই মানুষটি ‘শুভদা’, ‘চ›ন্দ্রনাথ’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘চাঁদনী’, ‘আত্ম অহংকার’, নিঝুম অরণ্য’সহ দেড় শতাধিক সিনেমার চিত্রগ্রাহক হিসেবে নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। রায়হান মুজিব পরিচালিত ‘আত্ম অহংকার’ এবং আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘আদরের সন্তান’ সিনেমা দুটির প্রযোজক জেড এইচ মিন্টু। ‘পোস্ট মাস্টার ৭১’ সিনেমার জন্য জেড এইচ মিন্টু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। দুই বাংলার বরেণ্য চলচ্চিত্র চিত্রগ্রাহক সাধন রায়ের সহকারী হিসেবে জেড এইচ মিন্টুর চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি। পরবর্তীতে আব্দুল লতিফ বাচ্চু ও বরেণ্য চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে দীর্ঘদিন সহকারী হিসেবে কাজ করেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র চিত্রগ্রাহক সংস্থার সাবেক এই সহসভাপতি।

অভিনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেকুজ্জামান

অভিনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেকুজ্জামান ছিলেন ছোটপর্দার প্রিয় এক মুখ। বড়পর্দাতেও অভিনয় করেছেন তিনি। অনেক নাটক টেলিছবিতে তাকে দেখা যেত বাবার চরিত্রে অভিনয় করতে। সবার প্রিয় এই অভিনেতা হঠাৎ করেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ২০২৩ সালের ২১ মার্চ সকাল ১১টায়। গুলশানে নিজ বাসায় মারা যান এই অভিনেতা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। যার নেশা ও পেশা ছিল অভিনয়।

খালেকুজ্জামানের ব্যক্তি জীবন

খালেকুজ্জামানের জন্ম বগুড়ার শান্তাহারে। তার বাবা ডা. শামসুজ্জামান ছিলেন ব্রিটিশ রেলওয়ের মেডিকেল অফিসার। মা শায়েস্তা আক্তার জামান ছিলেন গৃহিনী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য ও চারুকলা বিভাগের প্রথম মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের একজন ছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীনের বেশ কয়েক বছর পর খালেকুজ্জামান ১৯৭৫ সালে বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। তার আগে স্কুল-কলেজ জীবনে তিনি অনেক মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন। বিটিভিতে তিনি প্রথম নওয়াজেশ আলী খানের প্রযোজনায় ‘সর্পভ্রমে রজ্জু’ নাটকে অভিনয় করেন। এরপর তিনি ধারাবাহিক নাটক ‘তমা’, ‘বড় বাড়ি’, ‘সময় অসময়’, ‘সুবর্ণ সময়’সহ বহু নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হন।

চলচ্চিত্রে খালেকুজ্জামান

নায়করাজ রাজ্জাক ও কবরীর সঙ্গে ‘অনির্বাণ’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন খালেকুজ্জামান। চলচ্চিত্রে দীর্ঘদিন বিরতির পর মুরাদ পারভেজ’র ‘বৃহন্নলা’য় অভিনয় করেন। এরপর তিনি শিহাব শাহীনের ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার অভিনীত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা অনম বিশ্বাসের ‘দেবী’।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × two =