স্মৃতিতে অম্লান ২৬ মার্চ ১৯৭১

সালেক সুফী: মানুষের জীবনে কিছু কিছু দিনের স্মৃতি চিরভাস্মর হয়ে জেগে থাকে। মনে হয় যেন এইতো সেদিনের ঘটনা। আমরা যারা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম তাদের সবার কাছেই ২৬ মার্চ ১৯৭১ এমনি এক চিরদিনের স্মরণীয় দিন। কি হয়েছিল ২৫ মার্চ মাঝ রাত থেকে ২৬ মার্চ ১৯৭১, তা নিয়ে অনেক মনগড়া কথা শুনি। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে কিছু ঘটনা এখানে তুলে ধরছি। হয়তো বিবিসি বাংলা সার্ভিসের আর্কাইভ থেকে আমার নিজ কানে শুনা কথাগুলোর প্রমাণ মিলবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কারো দয়ার দান ছিল না। ১৯৫২র ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ৬ দফা, ছাত্রদের ১১ দফা, আগরতলা মামলা, ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন; বাংলাদেশি জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। ভাত-মাছে তুষ্ট শান্তিবিলাসী নিরস্ত্র জাতিকে তিলে তিলে স্বাধীনতার মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়ার মুজিব ভাই, কারো কারো মুজিব দাদা। ২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তান সেনা দলের ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ পাকিস্তান নামের দেশটির কবর রচনা করেছিল। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধুর বরাতে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা মূলক ভাষণ শেষে ফরিদপুর হয়ে মমতাময়ী মায়ের নির্দেশে বড় ভাইয়ের খুলনার বাসায় চলে যাই। ভাই-ভাবীর খুলনার মুন্সিপাড়ার বাসাটি ওই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ প্রস্তুতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। খুলনার ছাত্র-যুব নেতারা ভাইয়ের বাসায় সমবেত হয়ে মিটিং-মিছিলের পরিকল্পনা করতেন। নজরুল ভাই, বালু ভাই, টুকু ভাই, সিরি আপাদের কথা মনে আছে। খুলনা জেলা স্কুল মাঠে একজন ইপিআর সুবেদার আমাদের হালকা অস্ত্র চালনা, গ্রেনেড নিক্ষেপ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। ছাত্র নেতা বড় ভাই বোনদের সাথে স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশবিশেষ অনুকরণ করতাম। অন্যান্য সময় বন্ধু সাথীদের সাথে মিলে খালিশপুর বিহারীদের এলাকা পাহারা দিতাম, যাতে ওরা এলাকায় বাঙালিদের অত্যাচার না করতে পারে। দেশজুড়ে যুদ্ধ প্রস্তুতি, থমথমে পরিবেশ। বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ছোটোখাটো সংঘাত চলছিল।
পঁচিশে মার্চ কালো রাতের গণহত্যার খবর রাতেই আমরা পেয়ে যাই। মনে আছে, ভোর রাত থেকেই বিবিসি শুনছিলাম। সকালে ৭:৩০ মিনিটে বিবিসি বাংলা’র খবরে প্রথম শুনলাম, ‘পূর্বপাকিস্তানে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। অজানা বেতার কেন্দ্র থেকে মৃদু কণ্ঠে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে’। বড় ভাই প্রয়াত খন্দকার মালেক, ভাবী আমাদের ৩ মাস বয়সী ভাতিজি মালাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শুরু হলো আমাদের প্রস্তুতি। মনে আছে ৬ এপ্রিল ছাত্র-জনতা খুলনার নেতা সবুর খানের বাসা ঘেরাও করে ভাঙচুর করেছিল। আমি উপস্থিত ছিলাম। বাসার ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে পুড়িয়েছিলাম। বাসা থেকে বিদেশি কুকুরটি নিয়ে এসে টিক্কা খান নাম দিয়ে পালতে শুরু করেছিলাম।
ফেব্রুয়ারির শেষ থেকেই ঢাকায় বড় বোনের আজিমপুর কলোনির বাসায় ছিলাম। উচ্চ মাধমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। ১৯৬৬ আপার বিয়ের পর প্রতি বছর নভেম্বর বা ডিসেম্বরে ঢাকায় যেতাম। ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল, ক্রিকেট দেখার জন্য। আর ১৯৭১ সালে আমাদের কলেজের টেস্ট পরীক্ষার পর অবকাশ ছিল। কখনো পুরোদস্তুর ছাত্র নেতা না থাকলেও রাজনীতি সচেতন ছিলাম। বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা, ছাত্রদের ১১ দফা, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৭০ জাতীয় নির্বাচন বিষয়গুলো নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা এবং কিছুটা সম্পৃক্ততা ছিল। নানা কারণে বঙ্গবন্ধুকে রোল মডেল মনে হতো। তোফায়েল ভাই, নূর আলম সিদ্দিকী ভাইয়ের ভাষণের দারুন ভক্ত ছিলাম।
৭ই মার্চের পর সম্ভবত ১০ মার্চ ফরিদপুর হয়ে খুলনা চলে যাই। খুলনায় ভাই-ভাবী নিবিড় ভাবে আন্দোলন এবং যুদ্ধ প্রস্তুতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭০ এ জন্ম নেয়া ভাতিজি মালাকে যত্ন নেয়ার দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়।
তখন খুলনা এলাকা কর্নেল শামসের নেতৃত্বে ক্ষুদ্র একটি সেনাদল ছিল। পুলিশ এবং ইপিআর বাহিনীর সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। মোটামুটি প্রস্তুতি ছিল কী হলে কী করতে হবে। ২৬ মার্চ থেকে মোটামুটি ধারণা দেওয়া হয়েছিল, খুলনা আক্রমণ হলে মহিলা শিশুদের রূপসার ওপর পারে মিল ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের বাসায় দ্রুত অপসারণ করতে হবে। আমাদের কয়েকজনের উপর দায়িত্ব ছিল, ওদের যথাসম্ভব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × two =