মাসুম আওয়াল
রাজনীতির কঠিন ময়দান থেকে উৎসারিত সুরধ্বনিকে আমরা স্লোগান বলি। রাজনীতির মাঠে অন্যতম ভূমিকা রাখে এই স্লোগান। ছন্দ ও সুরের আদম্য শক্তি খুব সহজেই মানুষের হৃদয় ভেদ করে। সকলেই একমত হবেন হয়তো আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন গতিময় করেছে বেশকিছু কবিতা, গান, পোস্টার, কার্টুন আর দেয়াল লিখন। কিছু কিছু স্লোগান বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। এই গণআন্দোলনে এত বিচিত্র ধরনের গান, স্লোগান, কার্টুন, দেয়াল লিখন ও মিম তৈরি হয়েছে হয়েছে, ইতিহাসে যার দ্বিতীয় নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন। এছাড়া জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের দিকে তাকালে অনেক নতুন বিষয় চোখে পড়ে, আগের নানা সময়ের আন্দোলনের সঙ্গে এই আন্দোলনের কিছু ফারাক আছে। জেন-জির এই আন্দোলনে ঘটেছে অনেক অভূতপূর্ব ঘটনা।
শোকের কালো রঙ হয়ে যায় লাল
এত অল্প সময়ে কোনো আন্দোলন কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে এ ভাবনা ছিল সবার কল্পনার অতীত। যখন শেখ হাসিনা সরকার শোক দিবসে সবাইকে কালো রঙ ব্যবহার করার নির্দেশ দিল, তখন দারুণ কুশলতায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা দিলেন বিপ্লবের লাল রঙে প্রোফাইল রাঙানোর ডাক। আর তাতে সাড়া দিয়ে কোটি মানুষ ফেসবুকের মতো মিডিয়ার নীল ফিডকে লালে লাল বানিয়ে ফেলল।
স্লোগানে স্লোগানে গণআন্দোলন
বিশ শতকের শুরুর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত স্লোগান ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলনের ‘যদি তুমি ভয় পাও/ তবে তুমি শেষ/ যদি তুমি রুখে দাঁড়াও/ তবে তুমিই বাংলাদেশ’ স্লোগানও তুমুলভাবে আলোড়িত করেছে মানুষের মন। একইভাবে জুলাই ২৪ অভ্যুত্থানের স্লোগানগুলো আলাদা ভাবে দাগ কেটেছে মানুষের মনে। গণবিদ্রোহের ইতিহাসে অনন্য এই জেন-জির অভ্যুত্থানের স্লোগানগুলোও। দেখা গেছে, কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে নিতে বদলে গেছে আন্দোলনের দাবি, মিছিলের স্লোগান ও অভ্যুত্থানের ভাষা। যেমন আন্দোলনের শুরুতে স্লোগান ছিল, ‘কোটা না মেধা? মেধা, মেধা’ কিংবা ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’-এর মতো স্লোগান। ১৫ জুলাই রাতে শেখ হাসিনা যখন আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনা করেন তখন করলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বদলে যায় তাদের স্লোগানের ভাষা। তারা স্লোগান দিতে থাকে – ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার।/ কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’।এছাড়া ‘চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’! আন্দোলনকারীরা আরও স্লোগান দিতে থাকে – ‘লাখো শহীদের দামে কেনা/ দেশটা কারও বাপের না’।
আওয়ামী স্লোগানের পাল্টা স্লোগান
এই পর্যায়ে এসে আওয়ামী স্লোগানের অনেকগুলো পাল্টা স্লোগান শোনা যায় আন্দোলকারীদের মুখে মুখে। যেমন ‘আছিস যত রাজাকার/ এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’-এর পাল্টা স্লোগান শোনা যায় ‘স্বৈরাচার, স্বৈরাচার/ এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’। কিংবা আওয়ামী লীগের ‘জনে জনে খবর দে/ এক দফা কবর দে’র পাল্টা স্লোগান ‘জনে জনে খবর দে/ ছাত্রলীগের কবর দে’।
আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর আন্দোলনের নতুন মোড়
খেয়াল করলেই দেখা যায় ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হলে তার ছবি আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হয়। দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ছবি হয়ে ওঠে প্রতিরোধ আর বিপ্লবের আইকন। এদিন থেকে স্লোগানের মেজাজও বদলাতে থাকে। পুলিশি সহিংসতা আর নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপরে গুলি চালানোর ফলে স্লোগানেও তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। আন্দোলনকারীরা স্লোগান দেন, ‘আমার খায়, আমার পরে,/ আমার বুকেই গুলি করে’। কিংবা সরাসরি সাঈদের ছবি ব্যবহার করে অনলাইনে বা অফলাইনে দেখা যায়, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর’-এর মতো স্লোগান। এই সময় থেকে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিচারেরও দাবি ওঠে। স্লোগানে তার ভাষা হয়ে ওঠে, ‘তোর কোটা তুই নে,/ আমার ভাই ফিরিয়ে দে’ কিংবা ‘লাশের ভিতর জীবন দে/ নইলে গদি ছেড়ে দে’। হাসিনার শাসনপন্থীরা বলতে থাকে আওয়ামী লীগের বিকল্প দেখান। তার বিপরীতে ছাত্ররা স্লোগান দেয় – ‘তুমি কে? আমি কে?/ বিকল্প, বিকল্প’। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের আপসের কিছুটা সম্ভাবনা থাকলেও আবু সাঈদ, মুগ্ধরা প্রাণ হারানোর সেই সম্ভাবনা দুরিভূত হয়। সমস্ত সম্ভাবনা বিলীন হতে শুরু করে। স্লোগান ওঠে ‘আপস না সংগ্রাম?/ সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘দালালি না রাজপথ?/ রাজপথ, রাজপথ’। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সহিংসতার বিরুদ্ধেও স্লোগান ওঠে – ‘কে এসেছে? কে এসেছে?/ পুলিশ এসেছে।/ কী করছে? কী করছে?/ স্বৈরাচারের পা চাটছে’।
স্লোগানে স্লোগানে শেখ হাসিনার পদত্যাগ
ধীরে ধীরে মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকে। আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার ক্ষোভও বাড়তে থাকে। শেখ হাসিনার সরকারের পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের গুলিতে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়। সরকারের পতন ঘটানোই তখন মূল লক্ষ্য হয়ে যায় আন্দোলনকারীদের। স্লোগান ওঠে, ‘এক দুই তিন চার,/ শেখ হাসিনা, গদি ছাড়’, ‘দফা এক দাবি এক,/ শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ কিংবা ‘এক দফা, এক দাবি/ স্বৈরাচার তুই কবে যাবি’। ৪ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে আন্দোলনকারীরা গণভবন ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্যে দেন লংমার্চের ডাক। জনতাকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়ে স্লোগান ওঠে, ‘ঢাকায় আসো জনতা,/ ছাড়তে হবে ক্ষমতা’। ৫ আগস্ট সকাল থেকে শোনা যায় হাসিনা পালিয়ে গেছে দেশ ছেড়ে। স্লোগান ওঠে – ‘পালাইছে রে পালাইছে,/ হাসিনা পালাইছে’। বিকেলে সংবাদমাধ্যমগুলো হাসিনার দেশত্যাগের খবর প্রচার করে। এরপর আনন্দ মিছিলে মেতে ওঠে সারাদেশ।
শেষ কথা
ইতিহাসে অনেক গণঅভ্যুত্থানের কথা লেখা আছে। কিন্তু জুলাই ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের সঙ্গে অন্যান্য অভ্যুত্থানের অমিল হলো – কোনো রাজনৈতিক ব্যানারে বা সুসংগঠিত দলের নেতৃত্বে এটি হয়নি। যদিও আন্দোলন সফল হওয়ার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনের সঙ্গে তাদের যুক্ত থাকার কথা দাবি করেছেন। তথাকথিত ‘অরাজনৈতিক’ বলে পরিচিত জেন-জির হাত দিয়ে সংঘটিত হওয়া একুশ শতকের সবচেয়ে যুগান্তকারী অভ্যুত্থানের ভবিষ্যত দেখার জন্য আরও কিছুদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
‘জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান ২০২৪’ স্লোগান
১. কোটা না মেধা?
মেধা, মেধা।
২. সারা বাংলায় খবর দে,
কোটাপ্রথা কবর দে।
৩. আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই না।
তোমার আমার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই।
৪. জেগেছে রে জেগেছে,
ছাত্রসমাজ জেগেছে।
লেগেছে রে লেগেছে,
রক্তে আগুন লেগেছে।
৫. আপস না সংগ্রাম?
সংগ্রাম, সংগ্রাম।
৬. দালালি না রাজপথ?
রাজপথ, রাজপথ।
৭. গোলামি না ইনকিলাব?
ইনকিলাব, ইনকিলাব।
৮. অ্যাকশন টু অ্যাকশন
ডাইরেক্ট অ্যাকশন।
৯. দিয়েছি তো রক্ত,আরো দিব রক্ত।
রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়।
১০. কোটাপ্রথা নিপাত যাক,
মেধাবীরা মুক্তি পাক।
১১. লাঠি, বোমা, টিয়ারগ্যাস
জবাব দিবে বাংলাদেশ।
১২. লড়াই, লড়াই, লড়াই চাই।
লড়াই করে বাঁচতে চাই।
১৩. একাত্তরের হাতিয়ার,
গর্জে উঠো আরেকবার।
১৪. বাধা আসবে যেখানে,
লড়াই হবে সেখানে।
১৫. একে তো কোটার বাঁশ,
তার উপর প্রশ্ন ফাঁস।
১৬. গুলি করে আন্দোলন,
বন্ধ করা যাবে না, যাবে না।
১৭. জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো।
১৮. কথায় কথায় বাংলা ছাড়,
বাংলা কি তোর বাপ-দাদার?
১৯. লাখো শহীদের রক্তে কেনা,
দেশটা কারোর বাপের না।
২০. আমার ভাই মরল কেন?
প্রশাসন জবাব দে।
২১. বুকের ভেতর অনেক ঝড়,
বুক পেতেছি গুলি কর’
২২. ছাত্র যদি ভয় পাইতো, বন্দুকের গুলি।
উর্দু থাকতো রাষ্ট্রভাষা, উর্দু থাকতো বুলি।
২৩. আমার খায়, আমার পরে।
আমার বুকেই গুলি করে।
২৪. তোর কোটা তুই নে,
আমার ভাই ফিরাই দে।
২৫. আমার ভাইয়ের রক্ত,
বৃথা যেতে দেব না’
২৬. পা চাটলে সঙ্গী,
না চাটলে জঙ্গি।
২৭. মোদীর সন্তানেরা,
সীমান্তে ফিরে যাও (বিজিবির উদ্দেশ্যে)।
২৮. ভুয়া, ভুয়া (পুলিশের উদ্দেশ্যে)
২৯. পুলিশ ছাড়া মাঠে নাম,
ভুলিয়ে দিব তোর বাপের নাম।
৩০. লাশের হিসাব কে দিবে?
কোন কোটায় দাফন হবে?
৩১. তুমি কে? আমি কে?
রাজাকার, রাজাকর।
কে বলেছে? কে বলেছে?
স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।
৩২. চেয়েছিলাম অধিকার,
হয়ে গেলাম রাজাকার।
৩৩. আমি নই, তুমি নও
রাজাকার,রাজাকার।
কে রাজাকার? কে রাজাকার?
তুই রাজাকার, তুই রাজাকার (হাসিনার উদ্দেশ্যে)।
৩৪. তুমি কে? আমি কে?
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।
৩৫. স্বৈরাচার,
এই মুহূর্তে গদি ছাড়।
৩৬. এক, দুই, তিন, চার
হাসিনা তুই স্বৈরাচার।
৩৭. আইয়ুব থেকে হাসিনা,
স্বৈরাচার মানি না।
৩৮. লাশের ভেতর জীবন দে,
নইলে গদি ছাইড়া দে।
৩৯. লাখো শহীদের রক্তে কেনা,
দেশটা কারোর বাপের না।
৪০. আমার ভাই কবরে, খুনিরা কেন বাইরে?
৪১. ‘আমার ভাই জেলে কেন?
প্রশাসন জবাব দে।
৪২. গুলি করে আন্দোলন,
বন্ধ করা যাবে না, যাবে না।
৪৩. জাস্টিস জাস্টিস
উই ওয়ান্ট জাস্টিস।
৪৪. সেইম সেইম
ডিক্টেটর।
৪৫. অনাস্থা অনাস্থা, স্বৈরতন্ত্রে অনাস্থা।
৪৬. আঁর ন হাঁইয়্যে, বৌতদিন হাঁইয়্য’
(আর খেয়ো না, অনেক দিন খেয়েছ)।
৪৭. গোপালগঞ্জের গোলাপি,
আর কত জ্বালাবি?
৪৮. দফা এক, দাবি এক।
হাসিনার পদত্যাগ।
৪৯. ছিঃ ছিঃ হাসিনা,
লজ্জায় বাঁচি না।
৫০. শেখ হাসিনার গদিতে
আগুন লাগাও একসাথে।
৫১. কে এসেছে? কে এসেছে?
পুলিশ এসেছে,পুলিশ এসেছে।
কি করছে? কি করছে?
স্বৈরাচারের পা চাটছে।
৫২. আমাদের সংগ্রাম,
চলছে, চলবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ