১৯৭১ সেই সব দিন: নতুন প্রজন্মকে মুক্তির পথ দেখায়

মাসুম আওয়াল

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটা বহুমাত্রিক সংগ্রাম। এই সংগ্রামের ইতিহাস এখনো সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। নতুন প্রজন্মকে মুক্তির পথ দেখায় মুক্তিযুদ্ধ। তাই তো এখনো নির্মাণ হয় মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে গান, নাটক, চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধের উপর যত বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে ততই নতুন নানা দিক উম্মোচিত হবে। ২০২৩ সালে হৃদি হক নির্মাণ করেন ‘১৯৭১ সেই সব দিন’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণায় এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে পথ দেখিয়েছে এই চলচিত্রটি। রঙবেরঙের নিয়মিত আয়োজন এবার ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ নিয়ে।

মুক্তির আলোয়

নাট্যজন ড. ইনামুল হক ও লাকী ইনামের মেয়ে হৃদি হক। অভিনয় ও নাট্যপরিচালক হিসেবে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন অনেক আগেই। গত বছর তিনি নাম লিখিয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘১৯৭১ সেইসব দিন’। চলচ্চিত্রটি মুক্তির আলোয় আসে ২০২৩ সালের ১৮ আগস্ট। দিনটি ছিলো ইনামুল হকের জন্মদিন। ছবির শুটিং শুরু হয়েছিল ঠাকুরগাঁ ও মানিকগঞ্জে, চার বছর আগে। ড. ইনামুল হক তখন বেঁচে ছিলেন। তবে ছবির মুক্তি দেখে যাওয়া হয়নি তার। ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সসহ ১০টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সিনেমাটি। প্রযোজক ছিলেন লাকী ইনাম ও বাংলাদেশ সরকার। চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য লিখেছেন হৃদি হক নিজেই। কাহিনিকার ছিলেন নাট্যজন ইনামুল হক। চলচিত্রটির দৃশ্য ধারণে ছিলেন মেহেদী রনি এবং সম্পাদনার কাজ করেছেন কামরুজ্জামান রনি। দীর্ঘদিন পরে অভিনয়ে ফেরা লিটু আনাম এতে অভিনয় ছাড়াও শিল্পনির্দেশনা ও কোরিওগ্রাফি করেছেন। আর পরিবেশক ছিল জাজ মাল্টিমিডিয়া।

প্রথম ঝলকেই চমক

সিনেমা দেখার আগে দর্শক দেখেন সিনেমার পোস্টার। আর ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ সিনেমার পোস্টারেই ছিলো চমক। হাতে আঁকা পোস্টার দর্শককে আবেগতাড়িত করে ছিল। এক সময় হাতে আঁকা পোস্টারই ছিলো সিনেমার প্রাণ। সেই সময় সিনেমা হলগুলোর বাইরে বড় বড় হাতে আঁকা পোস্টার ও ব্যানার টাঙানো থাকতো। দর্শক দেখে চেনার চেষ্টা করতেন ছবির কলাকুশলীদের। সিনেমার প্রচারের জন্য রিকশার সামনে এবং পেছনেও লাগানো থাকতো হাতে আঁকা পোস্টারের প্রিন্ট কপি। এই সিনেমার পোস্টার শুরুতেই বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের কথা মনে করিয়ে দেয়।

কী আছে চলচ্চিত্রটিতে

চলচ্চিত্রটি ১৯৭১ সালে একটি পরিবারের অভিজ্ঞতার চারপাশে আবর্তিত হয়, যা সে যুগের একটি মর্মস্পর্শী চিত্রায়ন। মুক্তিযুদ্ধে জড়িত তিন ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরদৌস, লিটু আনাম ও সজল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ফেরদৌস। হৃদি হক বলেন, ‘১৯৭১ সেইসব দিন’ চলচ্চিত্রের মূল বার্তা হলো – এটি মুক্তির গল্প। সিনেমাটি দিয়ে আমরা ১৯৭১ সালে ফিরে গেছি। মানুষের মুক্তির স্বাদ চিরন্তন। কেবল একাত্তরেই গল্পটি আটকে আছে তা-ও নয়, এটি এগিয়ে যাবার গল্পও। সব মিলিয়ে দর্শকদের একটি মুক্তির গল্প দেখিয়েছি আমরা। ক্যারিয়ারের প্রথম চলচ্চিত্র পরিচালনা অনেক কঠিন ছিল। ভালো কাজের জন্য কঠিন কিছু বেছে নিতেই হয়। সিনেমাটির মূল গল্প বা মূল ভাবনা ড. ইনামুল হকের। এটা নিয়ে আমাদের দলের একটা নাটক ছিল। সেই ভাবনটা ঠিক রেখে চিত্রনাট্য করেছি। অনেক চরিত্র যোগ করেছি। ভীষণ সুন্দর একটি গল্প। আব্বা এই গল্পটি লিখেছিলেন দেশ স্বাধীনের পর পর। কঠিন গল্পটি সিনেমার জন্য বেছে নেওয়ার একটি বিশেষ কারণও ছিল। তা হচ্ছে – ১৯৭১ সালের গল্প চিরদিন রয়ে যাবে। এই গল্প মুছে যাবে না। ইতিহাস রয়ে যায়। দেখে মনে হতে পারে সিনেমার প্রতিটা দৃশ্য যেন ডায়েরির একেকটা পাতা। যেখানে খুব যত্ন করে লেখা হয়েছে দিনপঞ্জি। ১৯৭১-এর মার্চ থেকে গল্পের শুরু হয়। স্বাধীনতার দাবিতে শহর উত্তাল। মিছিল। ট্রাকে করে সংস্কৃতিকর্মীরা পরিবেশন করছেন গান-নাটক। দেশবাসী ভাবছে কোন দিকে গড়াচ্ছে পরিস্থিতি! সবার চোখে নতুন পতাকার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন, ঘাত প্রতিঘাত ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে চলে গল্প।

পর্দার চরিত্ররা

‘১৯৭১ সেই সব দিন’  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত একটি রোমান্টিক চলচ্চিত্র। ইনামুল হকের গল্প অবলম্বনে পরিচালনা করেছেন হৃদি হক। প্রধান চরিত্রে আছেন ফেরদৌস আহমেদ, সজল নূর, লিটু আনাম, সানজিদা প্রীতি, হৃদি হক। আরও অভিনয় করেছেন মামুনুর রশীদ, আবুল হায়াত, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মুনমুন আহমেদ, শিল্পী সরকার অপু, তারিন জাহান, সাজু খাদেম, নাজিয়া হক অর্ষা, আনিসুর রহমান মিলন, জুয়েল জহুর, মৌসুমী হামিদ, গীতশ্রী চৌধুরী প্রমুখ।

ঢাকা শহরের শান্তিবাগ এলাকার দুটি পরিবারের চোখ দিয়ে ওই সময়ের পরিস্থিতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন নির্মাতা হৃদি হক। এক পরিবারের কর্তা আলম সাহেব। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, তিন ছেলে, দুই বউমা আর নাতিকে নিয়ে তার ভরা সংসার। এই যৌথ পরিবারের বড় ছেলে লিটু ও তার স্ত্রী তারিনের মানসিকতা অন্যদের চেয়ে আলাদা। সবাই যখন স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর, তখন এই আলোচনা নিতান্তই শিশুসুলভ তাদের কাছে। মুখোমুখি বাড়িতে অন্য পরিবারের বসবাস। সানজিদা প্রীতি সেই পরিবারের বড় মেয়ে। সজলের সঙ্গে তার ভাব। প্রায়ই চলে চিরকুট চালাচালি, সাইকেলে ঘোরাঘুরি। এই পারিবারিক আবহের ভেতরে আসে ২৫ মার্চ। কালরাতের ভয়াবহতা হৃদি হক তুলে এনেছেন সম্পূর্ণ অন্যভাবে। শহরজুড়ে প্রচণ্ড গুলির শব্দের ভেতরে দুই পরিবারের যে অসহায়ত্ব, আর্তনাদ; এসবের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে পুরো দেশের চিত্র।

সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র

২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারি অনুদানে এই চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। অনুদানের অর্থ ছাড়াও আরও অর্থ যোগ করতে হয়েছে সিনেমাটির জন্য। হৃদি হক বলেন, অনুদানটাকে আমরা সম্মান হিসেবে দেখেছি। আসলে আরও অর্থ যোগ করতে হয়েছে সিনেমাটির জন্য। সিনেমা অনেক বড় বিষয়। আমাদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘টিকিট’ এগিয়ে এসেছে। এরই মধ্যে আবার আব্বাকে (ইনামুল হক) হারালাম। তিনি নেই কিন্তু না থেকেও দূর থেকে শক্তি হিসেবে কাজ করছেন।

শুটিং টাইম

ঢাকা, সাভার ও উত্তরাঞ্চলের ঠাকুরগাঁও এলাকায় সিনেমার শুটিং হয়। শুটিংয়ের অনুভূতি প্রকাশ করে হৃদি হক বলেন, ‘মূল কথা হচ্ছে সময়টাকে ধরতে হয়েছে। ৫২ বছর আগের পরিবেশ অন্যরকম ছিল। তখন মানুষের কথা বলার ধরনও একটু অন্যরকম ছিল। পোশাক, গেটআপ, মেকআপ, অন্যরকম ছিল। সবকিছুতে ফিরে যেতে হয়েছে সেই সময়ে। জার্নিটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। একটি দৃশ্য করেছি এক হাজারেরও বেশি মানুষ দিয়ে। এক হাজার থেকে দেড় হাজার মানুষ দিয়ে একটি দৃশ্য করার জন্য অনেক খাটতে হয়েছে। সবই করেছি ভালো একটি সিনেমার জন্য।’

গানের চমক

সিনেমার গান প্রসঙ্গে হৃদি হক জানান, ‘সিনেমাটির একটি গানের শিরোনাম, যাচ্ছো কোথায়। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন কামরুজ্জামান রনি এবং ইশরাত অ্যানি। গানটির গীতিকার আমি। সুর ও সংগীত করেছেন ওপার বাংলার দেবজ্যোতি মিশ্র। সত্যি কথা বলতে গানটি মুক্তির পর অসংখ্য মানুষের প্রশংসা পেয়েছি। এছাড়া সিনেমার একটি উর্দু গানও পছন্দ করেছেন দর্শক।’

আসলেই সিনেমাটির গানগুলো এক কথায় শ্রুতিমধুর। গানগুলো এসেছে দৃশ্যায়নের প্রয়োজনে। প্রতিটি গানই দর্শক শ্রোতার প্রাণে জায়গা করে নেয়ার মতো। ‘যাচ্ছো কোথায়’ গানটা হালকা চালের রোমান্টিক গান। ‘ইয়ে শামে’ গানটা সমসাময়িক উর্দু গানের কথা মনে করিয়ে দেয়। এছাড়াও মমতাজের দরাজ গলায় গাওয়া ‘যাওরে পংখি উইড়া যাওরে’ যেমন লোকজ ধাঁচের আবার একইসাথে মৌসুমী হামিদের ঠোঁটে ইংরেজি গানটিও দর্শক গ্রহণ করেছে।

সিনেমার সংলাপ

সিনেমাটিতে মনে রাখার মতো কয়েকটা সংলাপ আছে। অন্ধকারে জ্বলতে থাকা ল্যাম্প নিভে যাবার সময়কার সংলাপ ‘২৫ মার্চ বাংলাদেশটাকেই অন্ধকার করে গেছে’। পাকিস্তানিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা পরিবারের বড় ছেলের এক সংলাপের জবাবে বাবার উত্তর ‘সম্রাট হলেও পরাধীনতায় কোনও সুখ নেই’।

সিনেমার পোস্টার

মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে নির্মিত সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমা ‘১৯৭১ সেইসব দিন’ মুক্তির আগের দিন (১৭ আগস্ট ২০২৩) গণভবনে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার হাতে সিনেমাটির পোস্টার তুলে দেন নির্মাতা হৃদি হক, চিত্রনায়ক ফেরদৌস, অভিনেত্রী তারিন, লাকী ইনামসহ আট সদস্যের প্রতিনিধি। গণবভন থেকে বের হয়ে চিত্রনায়ক ফেরদৌস সংবাদমাধ্যমকে জানান সেই তথ্য। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ টিমের পক্ষ থেকে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তার হাতে সিনেমাটির পোস্টার তুলে দিয়েছি। এরপর তাকে সিনেমাটির ট্রেলার দেখানো হয়। সেটি দেখে তিনি অনেক প্রশংসা করেছেন। তিনি সিনেমাটি দেখতে চান। পেনড্রাইভে সিনেমাটি তাকে দিয়ে এসেছি আমরা।

শেষকথা

চলতি বছর দ্বিতীয়বারের মতো স্টার সিনেপ্লেক্সে মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধ ও প্রেমের গল্পনির্ভর চলচ্চিত্র ‘১৯৭১ সেই সব দিন’। ২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে স্টার সিনেপ্লেক্সে চলে এটি। এখনো না দেখে থাকলে সুযোগ পেলেই দেখে নিতে পারেন সিনেমাটি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × 4 =