বাংলাদেশের সিনেমার গল্প বিশ্ববাজারে এখন দূরালাপ, উল্টো দেশের মাটিতেই খাচ্ছে খাবি। এরমধ্যে ঢুকে পড়েছে বলিউডের সিনেমা, সেই তোপে নিজ দেশেই প্রেক্ষাগৃহে জায়গা পাচ্ছে না ঢালিউড! যার সর্বশেষ উদাহরণ গত ১৯ মে মুক্তি প্রতীক্ষিত ‘মা’। ছবিটি ‘পাঠান’ চাপে সিনেমা হল না পেয়ে পিছিয়েছে ২৬ মে পর্যন্ত।
তবে তার আগেই নিজ দেশে অবহেলিত ছবিটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলো ফরাসি সৈকতে। না, ৭৬তম কান উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশন কিংবা সমান্তরাল কোনও বিভাগে ঠাঁই পায়নি এটি। যেমনটা পেয়েছিল তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ কিংবা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। তবে উৎসবের বাণিজ্যিক শাখা মার্শে দ্যু ফিল্মে ‘মা’ ছবিটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হতে যাচ্ছে আজ (২০ মে) স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৪৫ মিনিট) পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের পালে-ই থিয়েটারে। এর সময়সূচি উৎসবের লিফলেট এবং মার্শে দ্যু ফিল্মের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে উৎসব কর্তৃপক্ষ ছবিটি প্রদর্শনের টিকিটও দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের হাতে।
ঘটনাটিকে ইতিহাস বলা ঠিক হবে না। কারণ, এমন প্রিমিয়ার দেশের অনেক ছবিরই হয়েছে দক্ষিণ ফরাসি উপকূলীয় শহর কানে। যে মিছিলে এর আগে শামিল হয়েছেন আব্দুল আজিজ, অনন্ত জলিল, অমিতাভ রেজাসহ অনেকেই। ফলে বাণিজ্যিক বিভাগে প্রদর্শনী বাংলাদেশের সিনেমার জন্য নতুন কিছু নয়। তবে ‘মা’-এর প্রিমিয়ারের সূত্র ধরে ১৯ মে (শুক্রবার) দিনজুড়ে বড় একটি ঘটনা ঘটে গেলো কানসৈকতের পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের ভেতরে ও বাইরে।
এদিন ছবিটির নির্মাতা-প্রযোজকরা কান শহরের পথে পথে হেঁটে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন। শুধু কি পতাকা? তারা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক পাঞ্জাবি, লুঙ্গি ও গামছা পরে বেরিয়েছিলেন! এই পোশাকেই ‘মা’ সংশ্লিষ্টরা পতাকা হাতে ঘুরলেন কান শহরে এবং পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনেও একই পোশাকে প্রবেশ করেছেন। একই পোশাকে সিনেমার মার্কেটিং করেছেন মার্শে দ্যু ফিল্মের বাংলাদেশের স্টলে বসে, যা দেখে অন্য বাঙালিরা মুগ্ধতায় ভেসেছেন আর বিদেশিরা দেখেছেন অবাক চোখে। কাছে এসে অনেক বিদেশি সাংবাদিক ও শিল্পী জিজ্ঞেস করেছেন– ছবিটি কোন দেশের, কবে প্রদর্শনী হচ্ছে ইত্যাদি।
ইতিহাস বলে, এর আগে বাংলাদেশের কোনও ছবিকে ঘিরে ফরাসি উপকূলে এমন অভিনব প্রচারণা বা দেশপ্রেমের প্রতিচ্ছবি মেলেনি। যেমনটা ঘটালেন ‘মা’ সিনেমার নির্মাতা অরণ্য আনোয়ার, প্রযোজক ইসমাইল হোসেন ও পুলক কান্তি বড়ুয়া এবং বাংলাদেশ থেকে আগত অন্য নির্মাতা ও সাংবাদিকরা। শুক্রবার (১৯ মে) বিকালে কান শহরে ঘটে যাওয়া এমন অভূতপূর্ব (লুঙ্গি-পাঞ্জাবি-পতাকা) ঘটনাটি দেখে স্থানীয় বাংলাদেশিরাও মুগ্ধতায় ভেসেছেন। ভিডিও করেছেন অসংখ্য মানুষ।
এমন অভিনব উদ্যোগ প্রসঙ্গে নির্মাতা অরণ্য আনোয়ার বলেন, ‘এটা অনেকের কাছে অভিনব মনে হলেও আমার কাছে খুব স্বাভাবিক। আমাদের অবস্থা হচ্ছে কেউ স্বাভাবিক কাজটি করলে অবাক হয়ে যাই! আমি দেশ ছেড়ে এই ফরাসিকূলে এসেছি বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্য। সেটা হতে পারে আন-অফিসিয়াল। কিন্তু এসেছি তো বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে। তো বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে, বাঙালি চেহারা ও ভাষা নিয়ে এই ফরাসি উপকূলে এসে কেন আমি বাঙালি পোশাক পরার স্বাধীনতা পাবো না! আমি উৎসবের ড্রেসকোডকে সম্মান করে টাক্সেডো পরে যেমন লালগালিচায় হেঁটেছি এবার, তেমনি লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে পতাকা হাতে নিয়েও কান শহর আর উৎসবের বিভিন্ন স্টলে ঘুরেছি। এর মাধ্যমে যদি কান উৎসবে আসা দুজন বিদেশি মানুষও বাংলাদেশকে জানতে পারে, ক্ষতি কী?’
কান শহরে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে কিছু মানুষ হেঁটে যাচ্ছে ফরাসি সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেত্রী ক্যাথেরিন দ্যুনোভের বিশাল পোস্টারের নিচ দিয়ে… পাশে পালে দে ফেস্টিভ্যালের তারকাখচিত ভবন, হাজারো চলচ্চিত্রপ্রেমী কোট-টাই-ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে উৎসবে মেতে আছে, ঠিক সেই ভিড়ে একটুকরো বাংলাদেশ; সত্যিই ইতিহাসে ফ্রেমবন্দি করার মতো দৃশ্য।
এমন দৃশ্য দেখে বিস্মিত ও মুগ্ধ হলেন কান শহরের স্থায়ী বাসিন্দা বাংলাদেশের সেজান চৌধুরী। তিনি শুক্রবারের এই দৃশ্যটি দেখে আফসোসের সুরেই বললেন, ‘আমি যদি জানতাম আগে, তবে বাসা থেকে স্ত্রী-সন্তানকে শাড়ি পরিয়ে এখানে নিয়ে আসতাম। নিজেও পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরে বেরিয়ে পড়তাম। এমন দৃশ্য সত্যিই আমাদের আবেগতাড়িত করে। যেমনটা তাড়িত হয়েছি বিশ্বকাপ জয়ের পর আর্জেন্টিনার উৎসবে বাংলাদেশের পতাকা দেখে।’
এদিকে ‘মা’ নির্মাতা অরণ্য আনোয়ার জানান, শনিবার (২০ মে) ছবিটির প্রিমিয়ারকে সামনে রেখে দারুণ উচ্ছ্বসিত তিনি। কারণ, এরমধ্যে ছবিটিকে ঘিরে ভালোই সাড়া পাচ্ছেন উৎসবে আগত বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।
নির্মাতার ইচ্ছে, গোটা বিশ্বে এই ছবিটি পৌঁছানো। এমনকি ফ্রান্সেও ছবিটি মুক্তির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছেন এই সফরে। আর বাংলাদেশে এটি মুক্তির নতুন তারিখ চূড়ান্ত হলো ২৬ মে, যদি বলিউডের ভিড়ে দেশে প্রেক্ষাগৃহ ফাঁকা পাওয়া যায়।
‘মা’ সিনেমার অন্যতম চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরীমণি। আরও আছেন আজাদ আবুল কালাম, ফারজানা ছবি, সাজু খাদেম, রেবেনা করিম জুঁই, শিল্পী সরকার অপু, সেতু, লাবণ্য, শাহাদাত হোসেন প্রমুখ। এদিকে কান উৎসবে সরাসরি যুক্ত না হতে পারলেও দূর ঢাকা থেকে মুগ্ধ সিনেমার নায়িকা পরীমণি। শুক্রবার (১৯ মে) ঢাকা থেকে পরী শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান কানে। তিনি তার সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লেখেন, ‘‘কানে আমাদের ছবিটি আজ (২০ মে) প্রদর্শিত হচ্ছে। এতে আমি ভীষণ আনন্দিত ও গর্বিত। ‘মা’ সংশ্লিষ্ট সকলকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন, অনেক ভালোবাসা রইলো। ধন্যবাদ আমার পরিচালক অরণ্য আনোয়ারকে।’’
বলা ভালো, এবারই প্রথম বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিএফডিসি স্টল নিয়েছে মার্শে দ্যু ফিল্মে। ১৬ মে উৎসবের উদ্বোধন হলেও ২০ মে পর্যন্ত সেই স্টলে বিএফডিসি বা তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাউকে দেখা যায়নি। বরং সেটি পাহারা দিচ্ছেন ‘মা’ টিমের সদস্যরা।
এবারের উৎসবে ‘মা’ সদস্যরা ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে এসেছেন নির্মাতা মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ, নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামূল, স্বপন আহমেদ, সাজ্জাদ খান এবং ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক আহম্মেদ মুজতবা জামাল।