৯৬তম অস্কার

রোজ অ্যাডেনিয়াম

১০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসের ডলবি থিয়েটারে জমকালো আয়োজনে অস্কারের ৯৬তম আসরে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এই আয়োজন মুগ্ধ করেছে সবাইকে। শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান পেয়েছেন সৌভাগ্যবানরা। কে আর কারা পুরস্কার পেয়েছেন, সে তালিকা এখন সবার জানা। অনেকে হয়তো দেখেও ফেলেছেন অস্কার পাওয়া নতুন সিনেমা। জেনে নেওয়া যাক এবারের অস্কারের সেরা সিনেমা, সেরা পরিচালক, অভিনেতা ও অভিনেত্রীর সম্পর্কে।

সেরা সিনেমার ৭ অস্কার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা হামলার দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাড়া করে ফেরে মানুষকে। সেই আণবিক বোমার উদ্ভাবক জে রবার্ট ওপেনহেইমারের জীবনী ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’ লিখেছিলেন মার্টিন জে শেরউইন ও কাই বার্ড। ২০০৫ সালে প্রকাশিত বইটি লিখতে লেখকেরা ২৫ বছর সময় নিয়েছেন। ২০২১ সালে ৮৪ বছর বয়সে শেরউইনের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালে লেখকদ্বয়ের গ্রন্থটি রুপালি পর্দায় তুলে আনেন নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান। সেই  ‘ওপেনহেইমার’ সিনেমাটি এবার ১৩টি মনোনয়ন পেয়ে ৭টি শাখায় অস্কার পুরস্কার জয় করেছে। ৯৬তম অস্কার আসরের সেরা সিনেমা হিসেবে পুরস্কার জিতেছে ‘ওপেনহাইমার’। নির্মাণের জন্য সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতার পুরস্কারও পেয়েছেন ক্রিস্টোফার নোলান। সিনেমাটি পেয়েছে সেরা ছবি, সেরা পরিচালনা, সেরা অভিনেতা এবং সেরা পার্শ্বচরিত্রের অস্কারও। এতে অভিনয় করেছিলেন কিলিয়ান মর্ফি এবং রবার্ট ডাউনি জুনিয়র।

বিশ্বসেরা পরিচালক

এবারে সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতার পুরস্কার পেয়েছেন ক্রিস্টোফার নোলান। একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম তিনি। ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। বহু স্বল্পদৈর্ঘের ছবি তৈরি করেছেন নোলান। তারপর নির্মাণ করেন ‘দ্য প্রেস্টিজ’, ‘ইনসেপশন’, ‘ইন্টারস্টেলার’, ‘টিনেট’-এর মতো ছবি।

বিশ্বসেরা অভিনেতা ও অভিনেত্রী

সেরা অভিনেতার পুরস্কার উঠেছে কিলিয়ান মারফির হাতে। ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমার জন্য এই পুরস্কার জিতেছেন তিনি। এটি তার প্রথম অস্কার এবং তিনিই প্রথম আইরিশ অভিনেতা যিনি এই পুরস্কার জিতেছেন। এই আসরে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার উঠেছে এমা স্টোনের হাতে। ‘পুওর থিংস’ সিনেমার জন্য এই পুরস্কার জিতেছেন তিনি। এটি তার দ্বিতীয় অস্কার। ‘পুওর থিংস’ সিনেমাতে একজন ব্রিটিশ নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন এমা। ২০১৭ সালে ‘লা লা ল্যান্ড’-এর জন্য সেরা অভিনেত্রীর অস্কার জিতেছিলেন এমা। সেটি ছিল তার জীবনের প্রথম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস। অস্কার হাতে নিয়ে ‘ওপেন হাইমার’-এর অভিনেতা মার্ফি জানিয়েছেন, তিনি সামান্য উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন। পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান এবং প্রযোজক এমা থমাসকে তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন ‘ওপেনহাইমার’ ছবিতে তাকে অভিনয় করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। ক্রিস্টোফার নোলানের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন কিংবদন্তি অভিনেতা আল পাচিনো।

এক নজরে  ৯৬তম অস্কার বিজয়ী

১. সেরা অভিনেতা:  কিলিয়ার মারফি (ওপেনহাইমার) ২. সেরা অভিনেত্রী: এমা স্টোন (পুওর থিংকস) ৩. সেরা পরিচালক:  ক্রিস্টেফার নোলান (ওপেনহাইমার) ৪. সেরা সিনেমা: ওপেনহাইমার ৫. সেরা পার্শ্ব অভিনেতা: রবার্ট ডাউনি জুনিয়র (ওপেনহাইমার) ৬. সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী: ডে’ভাইন জয় র‌্যান্ডলফ (দ্য হোল্ডওভারস) ৭. সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য: অ্যানাটমি অব অ্যা ফল (জাস্টিন ত্রিয়েত, আর্থার হারারি) ৮. সেরা রূপান্তরিত চিত্রনাট্য: আমেরিকান ফিকশন (কর্ড জেফারসন) ৯. সেরা অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র: দ্য বয় অ্যান্ড দ্য হেরন (হায়াও মিয়াজাকি ও তোশিও সুজুকি) ১০. সেরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র: দ্য জোন অব ইন্টারেস্ট (যুক্তরাজ্য) ১১. সেরা চিত্রগ্রহণ: হয়তে ফন হয়তেমা (ওপেনহাইমার) ১২. সেরা পোশাক পরিকল্পনা: পুওর থিংস (হলি ওয়াডিংটন) ১৩. সেরা প্রামাণ্যচিত্র: টোয়েন্টি ডেজ ইন মারিউপোল (মিস্তিসøাভ চেরনোভ, ইউক্রেন) ১৪. সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র: দ্য লাস্ট রিপেয়ার শপ (বেন প্রাউডফুট ও ক্রিস বাওয়ার্স) ১৫. সেরা চলচ্চিত্র সম্পাদনা: জেনিফার লেম (ওপেনহাইমার)  ১৬. সেরা রূপসজ্জা ও চুলসজ্জা: পুওর থিংস (নাদিয়া স্টেসি, জশ ওয়েস্টন ও মার্ক কুলিয়ার) ১৭. সেরা মৌলিক আবহসংগীত: লুদবিগ গোরানসন (ওপেনহাইমার) ১৮. সেরা মৌলিক গান: হোয়াট ওয়াজ আই মেড ফর? (গীতিকবি ও সুরকার বিলি আইলিশ, ফিনিয়াস ও’কনেল, চলচ্চিত্র বার্বি) ১৯. সেরা শিল্প নির্দেশনা: পুওর থিংস (জেমস প্রাইস, শনা হিথ ও জুজা মিহালেক) ২০. সেরা শব্দগ্রাহক: দ্য জোন অব ইন্টারেস্ট (জনি বার্ন, টার্ন উইলার্স) ২১. সেরা ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস: গডজিলা মাইনাস ওয়ান (তাকাশি ইয়ামাজাকি, কিয়োকো শিবুয়া, মাসাকি তাকাহাশি, তাতসুজি নোজিমা) ২২. সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র: দ্য ওয়ান্ডারফুল স্টোরি অব হেনরি সুগার (ওয়েস অ্যান্ডারসন, স্টিভেন রালস) ২৩. সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র: ওয়ার ইজ ওভার! ইন্সপায়ার্ড বাই দ্য মিউজিক অব জন অ্যান্ড ইয়োকো (ডেভ মালিন্স, ব্র্যড বুকার) ২৪. সম্মানসূচক অস্কার: আমেরিকান অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলা ব্যাসেট, আমেরিকান কমেডিয়ান, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক মেল ব্রুকস, চলচ্চিত্র সম্পাদক ক্যারল লিটেলটন ২৫. জিন হার্শোল্ট মানবিক অ্যাওয়ার্ড: সানড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবের নির্বাহী মিশেল স্যাটার।

অস্কারে যুক্ত হলো নতুন ক্যাটাগরি

এবারের অনুষ্ঠানে কাস্টিং ডিরেক্টর নামে নতুন আরও একটি শাখা যুক্ত করা হয়েছে। এতদিন সিনেমার সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য কলাকুশলীরা পুরস্কৃত হলেও অস্কারে কাস্টিং ডিরেক্টরদের কোনো স্থান ছিল না। অস্কারের ৯৮তম আসর অর্থাৎ ২০২৬ সাল থেকে তাদের সম্মানিত করা হবে। ২০০১ সালে অস্কারে সর্বশেষ ‘বেস্ট অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম’ নামে নতুন বিভাগ যুক্ত হয়েছিল। অর্থাৎ দুই দশকের বেশি সময় পর অস্কারে নতুন কোনো বিভাগ যুক্ত হলো। নতুন এ বিভাগের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বেস্ট অ্যাচিভমেন্ট ইন কাস্টিং’। বিগত কয়েক বছর ধরে কাস্টিং ডিরেক্টররা তাদের কাজের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে আসছে। অ্যাকাডেমির কর্তারা এক বিবৃতিতে বলেছিলেন যে, কাস্টিং ডিরেক্টররা ‘চলচ্চিত্র নির্মাণে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে’। এ ছাড়াও অ্যাকাডেমির সিইও বিল ক্রেমার এবং প্রেসিডেন্ট জ্যানেট ইয়াং বলেন যে, ‘অস্কারে কাস্টিংয়ে বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে যোগ করতে পেরে আমরা গর্বিত।’

অস্কার নিয়ে মজার তথ্য

অস্কারপ্রাপ্তদের নাম লেখা থাকে সিলগালা করা খামের মধ্যে। ১৯৪০ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস চূড়ান্ত ঘোষণার আগেই অস্কারে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ফাঁস করে দেয়। তারপর থেকেই সিলগালা করা খামের প্রচলন হয়। এই আয়োজনে পুরস্কারপ্রাপ্তদের অনুভূতি প্রকাশের জন্য সময়সীমা থাকে মাত্র ৪৫ সেকেন্ড। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলে তার কথা ঢেকে দিতে অর্কেস্ট্রার বাজনা শুরু হয়ে যায়। তাতেও কাজ না হলে টেলিপ্রম্পটার দিয়ে তাকে সতর্ক করে দেওয়ার বন্দোবস্ত আছে। এরপরেও যদি কেউ ধন্যবাদ জ্ঞাপনের তালিকা বাড়িয়েই চলেন, তাহলে তার মাইক্রোফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়! অস্কার অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশিবার সঞ্চালনার রেকর্ড করেছেন বব হোপ। সঞ্চালনার দায়িত্ব নিয়ে এ মঞ্চে তিনি উঠেছেন ১৯ বার।

সবচেয়ে বেশিবার অস্কারে সম্মানিত ওয়াল্ট ডিজনি পেয়েছে ৩২টি অস্কার! ১৯৫০ সাল থেকে অ্যাকাডেমি অস্কারপ্রাপ্তদের সাথে চুক্তি করে কোনো বিজয়ী তাদের অস্কারের স্ট্যাচুটি অ্যাকাডেমিকে প্রস্তাব না করে অন্য কোনো পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারবেন না। ১৯৫০ সালের আগে অবশ্য এমন কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। ১৯৯২ সালে বর্ষীয়ান অভিনেতা হ্যারল্ড রাসেল তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য নিজের জেতা অস্কারের ট্রফিটি সাড়ে ৬০ হাজার মার্কিন ডলারে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত অস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনজন। ১৯৩৫ সালে ডাডলি নিকোলস (চিত্রনাট্য-দি ইনফর্মার), ১৯৭০ সালে জর্জ সি স্কট (শ্রেষ্ঠ অভিনেতা-প্যাটন) এবং ১৯৭২ সালে মার্লোন ব্র্যান্ডো (শ্রেষ্ঠ অভিনেতা-দ্য গডফাদার)। ১৯৩৮, ১৯৬৮ এবং ১৯৮১ সালে মোট তিনবার স্থগিত হয়েছে অস্কার অনুষ্ঠান।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

11 + 5 =