তারকাদের তারকার ট্র্যাজিক বিদায়

ঢাকাই সিনেমার এক নক্ষত্রের নাম সোহানুর রহমান সোহান। প্রয়াত কিংবদন্তি নায়ক সালমান শাহ থেকে শুরু করে হালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খানের মতো অনেকেই তার হাতে গড়া সুপারস্টার। এমন কি শাকিব খান নামটিও তার দেওয়া। সোহানুর রহমান সোহান ছিলেন একজন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা। এক সময় অসংখ্যবার ফোন করেছি তাকে, নিউজের জন্য। কখনো বিরক্ত হতেন না। হঠাৎ করেই শুনতে হলো তার মৃত্যু সংবাদ। মর্মান্তিক ঘটনাই বটে। তার মৃত্যুর চব্বিশ ঘণ্টা আগে তার স্ত্রী মারা গেছেন। রোজ অ্যাডেনিয়ামের প্রতিবেদনে গুণী এই মানুষটির প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়ে রঙবেরঙের পক্ষ থেকে এই নিবেদন।

বগুড়ার ছেলে সোহান

১৯৫৯ সালের ১৫ অক্টোবর বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ফুলবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সোহানুর রহমান সোহান। বগুড়া ও জয়পুরহাটে স্কুল ও কলেজজীবন শেষে ঢাকায় আসেন তিনি। ১৯৮৮ সাল থেকে সারাজীবন চলচ্চিত্রের সঙ্গেই কাটিয়েছেন তিনি। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

সোহান যখন সহকারি পরিচালক

১৯৭৭ সালে খ্যাতিমান পরিচালক শিবলি সাদিকের সহকারী হিসেবে সোহানের চলচ্চিত্র কর্মজীবন শুরু। পরবর্তীতে তিনি শহীদুল হক খানের কলমিলতা (১৯৮১), এজে মিন্টুর অশান্তি (১৯৮৬) ও শিবলি সাদিকের ভেজা চোখ (১৯৮৮) চলচ্চিত্রে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর নিজেও উপহার দিয়ে গেছেন একের পর এক দর্শকনন্দিত ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র।

সোহানের যত জনপ্রিয় নির্মাণ

একক ও প্রধান পরিচালক হিসেবে তার প্রথম চলচ্চিত্র বিশ্বাস অবিশ্বাস (১৯৮৮)। পরিচালনায় তার প্রথম সফলতা আসে কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩) দিয়ে। এটি হিন্দি কেয়ামত সে কেয়ামত তক (১৯৮৮) এর পুনঃনির্মাণ। সোহানের ‘অনন্ত ভালোবাসা’ সিনেমার মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ঢালিউডের শীর্ষ তারকা চিত্রনায়ক শাকিব খান। তার নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হলো: বেনাম বাদশা (১৯৯২), কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩), আখেরি রাস্তা (১৯৯৪), বিদ্রোহী কন্যা (১৯৯৬), স্বজন (১৯৯৬), আমার ঘর আমার বেহেশত (১৯৯৭), আমার দেশ আমার প্রেম (১৯৯৮), মা যখন বিচারক (১৯৯৮), অনন্ত ভালবাসা (১৯৯৯), কিলার (২০০০), সত্যের বিজয় (২০০৩), স্বামী ছিনতাই (২০০৪), বলো না ভালোবাসি (২০০৫), বৃষ্টি ভেজা আকাশ (২০০৭), কথা দাও সাথী হবে (২০০৭), আমার জান আমার প্রাণ (২০০৮), পরাণ যায় জ্বলিয়া রে (২০১০), কোটি টাকার প্রেম (২০১১) দ্যা স্পিড (২০১২), সে আমার মন কেড়েছে (২০১২), এক মন এক প্রাণ (২০১২), লোভে পাপ পাপে মৃত্যু (২০১৪), ভাল লাগার চেয়েও একটু বেশি, জেদী (২০২২)।

সোহানের সেরা আবিষ্কার

সোহানের হাত ধরে অনেক তারকার পথচলা শুরু হয়েছে ঢালিউডে। তার নির্মিত সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রটির নাম ‘কেয়মত থেকে কেয়ামত’। জনপ্রিয় এই নির্মাতার হাত ধরেই চলচ্চিত্রে আসেন সালমান শাহ, মৌসুমী, পপি ও ইরিন জামান। তার পরিচালনায় ‘আমার ঘর আমার বেহেশত’ সিনেমার মাধ্যমে প্রথম রুপালি পর্দায় পা রাখেন শাকিল খান। তার নায়িকা ছিলেন পপি। সুপারহিট হয় এই এই সিনেমা। ঢাকাই সিনেমার শীর্ষ নায়ক শাকিব খানের মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমা ‘অনন্ত ভালোবাসা’র নির্মাতাও সোহানুর রহমান সোহান। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় এই সিনেমা। এসময় ‘মাসুদ রানা’ নামটি পরিবর্তন করে সোহান এই নায়কের নতুন নাম দেন ‘শাকিব খান’।

সোহানের মৃত্যুতে তারকাদের শোক

বরেণ্য নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান। তার মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে যায় ঢালিউড। সোহানের মৃত্যুর খবরে চিত্রনায়ক শাকিব খান, রিয়াজ, ফেরদৌস, নিপুণসহ ঢাকাই সিনেমার পরিচালক ও শিল্পীরা তাকে শেষবারের মতো দেখতে যান। বাংলাদেশ পরিচালক সমিতির সভাপতি কাজী হায়াৎও মুষড়ে পড়েন তার মৃত্যুতে। মৃত্যুর দিন কাজী হায়াতের সঙ্গে শেষ কথা হয় সোহানুর রহমানের। সোহানের মৃত্যুর পর সে কথা প্রকাশ করেন কাজী হায়াৎ। বলেন, ‘সোহানের মৃত্যুদিনেই আমার সঙ্গে সোহানের কথা হয়েছে। সে আমাকে কান্নাকাটি করে বলল, হায়াৎ ভাই, আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আমি স্ত্রী হারানোর শোক সইতে পারি। আল্লাহ যেন আমাকে ধৈর্য দেন।’ এরপর কাজী হায়াৎ বলেন, ‘আমি মনে করি সোহান ভাগ্যবান, যে স্ত্রীর শোক খুব বেশি সময় ধরে তাকে সইতে হয়নি। সব ছিন্ন করে তিনিও চলে গেলেন। সোহানের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি একজন কীর্তিমান পরিচালক ছিলেন। পরিচালকরা সাধারণত খ্যাতিমান হন কম, কিন্তু সোহান খ্যাতিমান পরিচালক ছিলেন। তার জন্য সবাই দোয়া করবেন।’ শাকিব নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেন, আমার এই শাকিব খান নামটি সোহান ভাইয়ের দেওয়া। সত্যি কথা বলতে, তার সম্পর্কে কিছু বলার বা লেখার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ভাবি এবং সোহান ভাইকে মহান আল্লাহ পরপারে শান্তিতে রাখুন। তিনি আরও বলেন, এই তো কয়েকদিন আগেও সোহান ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হচ্ছিল। বলছিলেন, তিনি অসুস্থ, উন্নত চিকিৎসা নিতে জাপান যাবেন। কিন্তু হঠাৎ করে খবরটি পেয়ে আঁতকে উঠলাম! জানলাম, ভাবির মৃত্যুর একদিন পরেই সোহান ভাইও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

যাওয়ার কথা জাপান, নিলেন সস্ত্রীক বিদায়

সোহানুর রহমান সোহান স্নায়ুতন্ত্রের জটিল সমস্যায় ভুগছিলেন। দেশে কয়েক দফায় ডাক্তার দেখিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। তাই চিকিৎসার জন্য জাপান যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। সবকিছু চূড়ান্ত ছিল। ১৫ সেপ্টেম্বর জাপানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই ১৩ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন অনন্ত যাত্রায়। এদিকে ১২ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ব্রেইন স্ট্রোকে মারা যান তার স্ত্রী। পরের দিন ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সোহান।

স্ত্রীর পাশে চিরতরে শায়িত সোহান

স্ত্রীকে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে সমাহিত করে ঢাকায় ফেরার পরদিনই তার কবরের পাশে চিরতরে শায়িত হন সোহানুর রহমান সোহান। জীবনসঙ্গী প্রিয়া রহমানের শোকে কাতর ছিলেন সোহান। বগুড়ায় জন্ম নেওয়া সোহানের শ্বশুরবাড়ি টাঙ্গাইলে। সোহানের ইচ্ছানুযায়ী তার স্ত্রীর কবরের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। টাঙ্গাইলের পুরোনো বাস স্ট্যান্ড মসজিদে জানাজা শেষে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। এর আগে উত্তরার বাসায় তার প্রথম জানাজা হয়।

শেষ কথা

সোহানুর রহমান সোহানের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে লিখেছেন আরেকজন নন্দিত শিক্ষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ড. মতিন রহমান। মতিন রহমান লিখেন: ‘সোহানুর রহমান সোহান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সফল একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার নাম। যে নাম এখন দর্শক-পাঠকের কাছে অতীত পৃষ্ঠার স্মৃতি। অনুসন্ধানমূলক দৃষ্টিকোণে সোহানুর রহমান সোহানের জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণ করলে প্রমাণ করবে তিনি কেবল চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন না; ছিলেন সংগঠক, শিল্প সংস্কারক এবং দুঃসাহসী সংস্কৃতিকর্মী। গড় পছন্দে তিনি বিনোদনধর্মী সিনেমা নির্মাণের চেনা পথে ভ্রমণ করলেও তিনি ছিলেন এক কর্মীপুরুষ। সোহানুর রহমান সোহান শিল্পী মনের চেতনায় শিল্পী কুশলীদের দিনান্তের জীবনটা সুখী ও সুন্দর দেখতে চেয়েছেন। তাদের উৎসাহে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। সফলও হয়েছেন। কখনো হয়েছেন সমালোচিত। তবুও সোহানুর রহমানের লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষের মনে প্রবেশ করে তাদের আত্মউন্নয়ন ঘটানো। সোহানুর রহমানের চলচ্চিত্র নির্মাতা পদবি ছাড়া একটি টাইটেল ছিল; বলা হতো ‘তারকাদের তারকা’। সিনেমার পর্দায় নতুন শিল্পী আনতে প্রযোজকদের উৎসাহিত করতেন। নতুনদের নিয়ে কাজ করতেন। দর্শকদের সামনে হাজির করতে অথবা পছন্দ করাতে কঠোর পরিশ্রম করতেন। কখনো লোকসান হওয়ার ঝুঁকি নিতেন, সফলও হতেন। যতদিন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি থাকবে, ততদিন সবুজ তৃণলতা পুষ্প মঞ্জুরিত বাগান, দেয়ালে নকশা শোভিত টাইলসের বিন্যাস যা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি তথা আবদুল জব্বার খান পাঠাগারের অনিবার্য শিল্প অনুষঙ্গ হিসেবে সেইসব ক্ষেত্রে ফুটে উঠবে সোহানের অনিবার্য এক চিত্র! তার জন্ম উত্তরবঙ্গের বেহুলা-লখিন্দরের জনপদ হিসেবে খ্যাত বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে। শিক্ষাদীক্ষা লাভ ও বেড়ে ওঠা বৌদ্ধ বিহার অঞ্চল জয়পুরহাটে। তার মৃত্যু এক মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডির মতো। স্ত্রীর মৃত্যুর বাইশ ঘণ্টা পর তার মৃত্যু হয় এবং স্ত্রীর কবরের পাশে অন্তিম শয়ানে শায়িত হয়; যা বিশ্বের নানান ট্র্যাজিক মহিমায় উন্নীত নাটক ও সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। তা যেন চলচ্চিত্রেরই অন্য পিঠ আরেক গল্প হয়ে হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে নির্মিত হবে আরেক মহাকাব্যিক বাস্তবতার ট্র্যাজিক চিত্রগাঁথা!’

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 + 2 =