চলচ্চিত্রে ফিলিস্তিন ইসরায়েল সংঘাত

রোজ অ্যাডেনিয়াম

জাতিসংঘের ১৩৮টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের স্বীকৃতি এখনো পায়নি ফিলিস্তিন। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সময় মূল ভূখণ্ড দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। তবে ইসরাইল স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি ফিলিস্তিন। বরং তাদের পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপ্ন দিনে দিনে ফিকে হয়ে যাচ্ছে।

ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত নিয়ে সিনেমা

ফিলিস্তিন ইসরাইল সংঘাতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু সিনেমা। এই সিনেমাগুলো এসেছে আলোচনায়। অনেকগুলো সিনেমা বিভিন্ন সময় পুরস্কৃত হয়েছে। এগুলো নিয়ে আমাদের এই পর্বের আলোচনা। তুলে ধরা হলো ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত নিয়ে আলোচিত কয়েকটি সিনেমার ইতিকথা।

ওয়েডিং ইন গালিলি

১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পরের ঘটনা। ইসরায়েলের দখল করা এক গ্রামে তখনো কারফিউ চলছে। গ্রামের প্রধান মুক্তার তার ছেলের বিয়ের সময় সাময়িকভাবে কারফিউ স্থগিতের আবেদন জানায় ইসরায়েলি মিলিটারির কাছে। মিলিটারি গভর্নর রাজি হয় এক শর্তে। বিয়েতে তারাও যোগ দেবে। শর্ত মেনে রাজি হয় মুক্তার। তবে বিষয়টি মেনে নিতে পারে না অনেকে। বিয়ের উৎসব শুরু হয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা আসে। উৎসব আর প্রথা পালনের মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে অনুষ্ঠান। হঠাৎ কিছু যুবক ইসরায়েলি সেনাদের ওপর আক্রমণ করে বসে। নিমেষেই উৎসব পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। এমন গল্প নিয়ে ফিলিস্তিনি নির্মাতা মিশেল খলিফি বানিয়েছেন ‘উরস আল জালিল’ বা ‘ওয়েডিং ইন গালিলি’। কানসহ বিশ্বের অনেক উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে এটি।

প্যারাডাইস নাউ (২০০৫)

সাঈদ ও খালেদ নামে ফিলিস্তিনের দুই যুবক তেল আবিবে একটি আত্মঘাতী মিশনের জন্য নিযুক্ত হয়। মিশনে যাওয়ার আগে একসঙ্গে তাদের কাটানো শেষ কয়েকটি দিনের গল্প উঠে এসেছে ‘প্যারাডাইস নাউ’ সিনেমায়। সশস্ত্র গোষ্ঠী একটি গোপন জায়গায় নিয়ে যায় তাদের। পরিবারের উদ্দেশে তারা ভিডিও বার্তা রেকর্ড করে। তাদের শরীরে বোমা বেঁধে দেওয়া হয়। সীমানা টপকে তারা ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে। পথ চলতে চলতে সাঈদ ও খালেদের কথোপকথনে উঠে আসে তাদের জীবনদর্শন, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের বৈরিতার কথা। প্যারাডাইস নাউ বানিয়েছেন ফিলিস্তিনি-ডাচ নির্মাতা হানি আবু আসাদ। প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন কায়েস নাসেফ ও আলি সুলিমান। অস্কারে মনোনীত হয়েছিল সিনেমাটি। পুরস্কার জিতেছে গোল্ডেন গ্লোবসহ অনেক উৎসবে।

লেমন ট্রি (২০০৮)

ইসরায়েল ও পশ্চিম তীরের সীমানার কাছাকাছি একটা বাড়িতে থাকা শুরু করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নেভন ও তার স্ত্রী। সেই বাড়ির কিছুটা দূরে সালমার ছোট লেবুর বাগান। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে সেই বাগানে সার্বক্ষণিক তদারকি শুরু করে ইসরায়েলের সেনারা। একপর্যায়ে সব গাছ কেটে বাগান সাফ করে দিতে চায়। কিন্তু এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয় সালমা। কয়েক প্রজন্ম ধরে এ বাগান চাষ করে আসছে তারা। অনেকেই সালমাকে বোঝায়, ইসরায়েলের সৈন্যদের সঙ্গে ঝামেলায় না জড়াতে। কিন্তু সালমা কেস ঠুকে দেয় সুপ্রিম কোর্টে। বিষয়টি নিয়ে মিডিয়া সরব হয়, আলোচনা শুরু হয় সবখানে। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে তৈরি সিনেমাটি ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়ার পর ইসরায়েলেও প্রশংসিত হয়। ইসরায়েলি নির্মাতা এরান রিকলিসের ‘লেমন ট্রি’ বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবসহ অনেক উৎসবে পুরস্কৃত হয়।

দ্য টাইম দ্যাট রিমেইনস (২০০৯)

সুলেমানের অনন্য নির্মাণ ‘দ্য টাইম দ্যাট রিমেইনস’। অনেকটা আত্মজীবনীর ঢঙে এ সিনেমায় তিনি তুলে এনেছেন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংকটের আদ্যোপান্ত। নির্মাণ করেছেন ফিলিস্তিনের জনপ্রিয় নির্মাতা এলিয়া। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর কীভাবে বদলে গেল ফিলিস্তিনের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল; দুই অঞ্চলের মানুষের মনে কীভাবে দ্বন্দ্ব ঘনীভূত হলো, এ সিনেমায় তার একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়।

ওমর (২০১৩)

ফিলিস্তিনের যুবক ওমর প্রায়ই পশ্চিম তীরের সীমানা টপকে চলে যায় তার প্রেমিকা নাদিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। দুই বন্ধু তারেক ও আমজাদকে নিয়ে গোপনে ওমর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ওপর হামলার জন্য। একদিন সীমানা পেরোতে গিয়ে ওমর গ্রেপ্তার হয়। তার ওপর নির্যাতন চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। ছাড়া পেয়ে তিন বন্ধু মিলে এক চেকপোস্টে হামলা করে। এক ইসরায়েলি সৈন্যকে হত্যার অভিযোগে আবার ধরা পড়ে ওমর। ইসরায়েলি বাহিনীর তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করতে সম্মত হয় সে। তবে তার আসল উদ্দেশ্য অন্য কিছু। হানি আবু আসাদের ‘ওমর’ সিনেমায় উঠে এসেছে ফিলিস্তিনের তরুণ প্রজন্মের ভাবনা ও জীবনযাপন। অস্কারে মনোনীত হয়েছিল হানি আবু আসাদের সিনেমাটি। স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড, কান চলচ্চিত্র উৎসবসহ অনেক উৎসবে পুরস্কার পেয়েছে ‘ওমর’।

আল নাকবা

ফিলিস্তিনিদের জন্য ১৯৪৮ সাল ভয়ানক বিপর্যয়ের একটি বছর। সেই বিপর্যয়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আল নাকবা’। যার অর্থ বিপর্যয়। হাজার হাজার লোক বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল সেই সময়। ইসরাইলীদের জন্য নতুন রাষ্ট্র তৈরির এই মর্মান্তিক যাত্রা তুলে ধরতে বেনি ব্রুনা ও আলেক জান্দ্রা জানসির পরিচালনায় চার পর্বের সিরিজ নির্মিত হয়।

দ্য ওয়্যার ইন জুন ১৯৬৭

১৯৬৭ সালে ৬ দিনব্যাপী একটা যুদ্ধ হয়েছিল এই অঞ্চলে। পুরো অঞ্চলটি এলোমেলো হয়ে যায়। যার প্রভাব এখনো রয়েছে। সে ছয় ছয় দিনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিল। যে সিনেমাটির নাম ‘দ্য ওয়্যার ইন জুন ১৯৬৭’।

দ্য ওয়্যার ইন অক্টোবর: হোয়াট হ্যাপেন্ড ইন ১৯৭৩

মিশরীয়রা একে অক্টোবর যুদ্ধ বলে। আর ইসরাইলিরা বলে ইয়োম কিপুর যুদ্ধ। এমন একটি যুদ্ধ যেটিতে আরব ও ইসরাইলিরা উভয়েই নিজেদেরকে বিজয়ী বলে দাবি করেছিল। ১৯৭৩ সালের ৩ সপ্তাহের এই যুদ্ধে আসলেই কি ঘটেছিল? জানতে চাইলে দেখতে হবে ‘দ্য ওয়্যার ইন অক্টোবর: হোয়াট হ্যাপেন্ড ইন ১৯৭৩’ সিনেমাটি। এই যুদ্ধ বিশ্বকে পারমাণবিক সংঘর্ষের এক দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। বিরল ফিল্ম আর্কাইভ নিয়ে এবং যুদ্ধে যারা করেছিলেন অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তিন পর্বের এই সিরিজটি গ্রাফিক্স, মানচিত্র ও এনিমেটেড সিকুয়েন্স ব্যবহার করে বানানো হয়েছে।

দ্যা প্রাইজ অব অসলো

ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধের ইতিহাসে অসলো চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই অসলো একর্ড-এর গোপন পরিকল্পনা উঠে এসেছে ‘দা প্রাইস অফ অসলো’ নামের দুই পর্বের এই সিরিজে।

জেরু জালেম: ডিভাইডিং আল আকসা

এই চলচ্চিত্রটি আল আকসা মসজিদের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। মুসলিম ও ইহুদিদের কাছে এই মসজিদের যে তাৎপর্য তা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে ইজরাইলিদের আক্রমণ, বিধি-নিষেধ দেওয়ার চেষ্টা, প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ ইত্যাদি নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

প্যালেস্টাইন ১৯২০: দ্য আদার সাইড অফ দ্যা প্যালেস্টাইন স্টোরি

১৮শ দশকে খ্রিষ্টান লেখকরা প্যালেস্টাইন এবং ইহুদি জনগণের মধ্যে সম্পর্ক বর্ণনা করেন ‘মানুষ ছাড়া একটি ভূমি ও একটি ভূমি ছাড়া মানুষ ভেবে’। আর মধ্যপ্রাচ্যের বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস মূলত সেই চোখ দিয়ে দেখে লেখা হয়েছে। কিন্তু আল জাজিরার এই ডকুমেন্ট আরবদের থেকে ফিলিস্তিনিদের একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখায়। ইতিহাসবিদ যুদ্ধের সাক্ষী, আর্কাইভ ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গা থেকে নতুন সংগ্রহ করে এই ফিল্ম তৈরি করা হয়েছে। এই ফিল্ম ফিলিস্তিনকে অটোমান সাম্রাজ্যের একটি সমৃদ্ধশালী প্রদেশ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

শেষ কথা

এমন আরও অনেক সিরিজ ও চলচ্চিত্র রয়েছে যেগুলোতে উঠে এসেছে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের সংঘাত। আমরা সংঘাত চাই না। শান্তি চাই। পৃথিবী যুদ্ধ মুক্ত হোক। পৃথিবী হোক শান্তিময়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 × 4 =