ভুল থেকে কী বিনাশের পথে হাঁটছে বিএনপি?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

গোটা দেশের রাজনীতি যখন উত্তাল, একের পর এক জনপদে গাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে অবরোধের সমর্থনে, যখন নাগরিক সমাজের কেউ কেউ অনিশ্চয়তার কথা বলছেন, তখনই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়াল। জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলে দিলেন নির্বাচন হবে আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি। এখন সেই নির্বাচন নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে ফর্ম বিতরণও শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা হলে পাড়ায় পাড়ায়, জনপদে এমনকি ঘরে ঘরে যুদ্ধের ডাক দেওয়া বিদেশে বসা বিএনপির সামাজিক মাধ্যমের অগ্র সৈনিকরা এখন কেবল শেখ হাসিনাকে গালি দিয়ে সময় পার করছেন। বিএনপি নেতা কর্মীরা যুদ্ধ তো দূরের কথা, সামান্য প্রতিবাদও করতে পারেনি এই শহরে। একটা টান টান উত্তেজনা ছিল, ছিল শঙ্কাও। কিন্তু প্রত্যাখ্যান করে আবার হরতাল ডাকা ছাড়া সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির আর কিছু দৃশ্যমান নয় বিএনপির দিক থেকে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন গত ১৫ বছর ধরে একই কাণ্ড ঘটিয়ে দলটি এখন ভুলের পাহাড়ে চড়ে বসেছে। এই ভুল প্রথমে এসেছে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে এবং নির্বাচন বর্জন করে। এরপর ভুল এসেছে কিছু ফেসবুকার আর ইউটিউবার থেকে। এরা বিদেশে নিরাপদ দূরত্বে বসে বিএনপিকে চাঙা করার নামে অলীক স্বপ্নে মজিয়ে রেখেছে। এরা এমন একটা আবহ সৃষ্টি করেছে যেন, আওয়ামী লীগ আজ নেই, কাল নেই।

বিএনপির আরেকটি বড় নির্ভরতা তৈরি হয়েছিল বিদেশিদের দিক থেকে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। ওয়াশিংটনে নিয়মিতভাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে এনেছে দলটি। মার্কিন ভিসা নীতিতে উদ্বেলিত হয়েছে। কিন্তু মাঠের আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। বরং ২১০৩-১৫ পর্যন্ত আগুন আন্দোলনের অভিজ্ঞতা মাথায় নিয়ে সাধারণ মানুষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত না হয়ে সতর্ক থাকছে। ফলে অবরোধ কার্যকর করতে চোরাগোপ্তা হামলাই ভরসা এখন।

একটা প্রশ্ন এখন সবখানে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিএনপি নেতৃত্ব কী কোনো কারণে বিভ্রান্ত হয়েছে? ক্ষমতায় যেতে মরিয়া বিএনপির নেতা-কর্মীরা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়েছে দেশের বাইরে থাকা কিছু ফেসবুকার আর ইউটিউবার দ্বারা। এরা প্রায় প্রতিদিন স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছে যে, শেখ হাসিনা আজকে নেই, কালকে নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো শেখ হাসিনার সরকার নিজের অবস্থান আরও সংহত করেছে।

এবারও যদি বিএনপি ছাড়া নির্বাচন করতে পারে আওয়ামী লীগ, যদি নির্বাচন প্রতিহত করতে না পারে তাহলে কী হবে আগামীতে? প্রশ্ন উঠছে, এভাবে চললে দলটার অস্তিত্ব থাকবে তো? ভুল থেকে কি বিনাশের পথে হাঁটছে বিএনপি? এসব আঙ্কার কোনটিই হয়তো হবে না, কারণ গত ১৭ বছর ধরে ক্ষমতায় না থাকলেও দল ভাঙেনি, দুর্বল হয়নি। বরং বলা চলে রাজনৈতিকভাবে দলের কর্মীরা চাপের মধ্যেও ঐক্য দেখাতে পেরেছে।

যা ভাবা হয়েছিল তা-ই হয়েছে। বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। বুধবার সন্ধ্যায় তফসিল ঘোষণার পর এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নির্বাচনের এই আয়োজনকে ভোটরঙ্গ আখ্যায়িত করে বলেছেন, জনগণ এটা বাস্তবায়ন হতে দেবে না। এই তফসিল বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেবে জনতা। এগুলো সবই রাজনৈতিক কথা। সত্যি বলতে কি বিএনপি নিজেই ২৮ অক্টোবরের ঘটনার পর থেকে অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে সরকারের দমননীতির চাপে।

রাজনৈতিক দলের কাছে এখন আদর্শ আর নৈতিকতাই যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ নয় তাই, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও দলের অনেকেই যে নির্বাচন করতে চাইবেন, অনেকে নির্বাচন যে করবেনও সেটা বোঝা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বিএনপির সাবেক কয়েকজন নেতার সৃষ্ট তৃণমূল বিএনপি তিনশ আসনেই প্রার্থী দিবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় পার্টির একটা অংশ বা সম্পূর্ণটাই নির্বাচনে আসতে পারে। তবে আসছে না সিপিবি-বাসদের বাম গণতান্ত্রিক জোট। সামগ্রিকভাবে বলা চলে আগামী নির্বাচন বিএনপি ছাড়া এক ভিন্ন রকমের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে চলেছে যেখানে আগেরবারের মতো বিনা ভোটের এমপি হওয়ার হিড়িক পড়বে না।

জাতীয় রাজনীতিতে অস্তিত্ব টেকাতে এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে এখন কৌশল সাজানোর পালা বিএনপির। সেই কৌশলটা কি দলের হাই কমান্ডই বলতে পারবে। কিন্তু এ কথা ঠিক যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার রুখতে জামাত সহিংসতা করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারলেও পারেনি বিএনপি। ক্ষমতাসীন দলের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য জনসাধারণকে কার্যকরভাবে সংগঠিত করতে না পারার যে ব্যর্থতা, তার পুনরাবৃত্তি আবার দেখা গেল এবার। দল বড় সমাবেশ করছে, সংগঠিত হচ্ছে, আলোচনায় থাকছে, দেশ-বিদেশের নানা জায়গার সমর্থন পাচ্ছে, কিন্তু রাজনীতিতে সেই প্রভাব দেখাতে পারছে না। এবং সে কারণে জনগণের মধ্যে এর অবস্থানও দুর্বল থেকে যাচ্ছে।

নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার অধীনেই। নির্বাচনে যাওয়া হলো না, প্রতিহত করাও গেল না – তাহলে কী হতে পারে পরিস্থিতি সেই বিশ্লেষণ কি আছে দলের ভেতর? থাকারই কথা। সাধারণ নাগরিকের উদ্বেগের সাথে নিজেকে সংযুক্ত না করতে পারলে বেশি কিছু করা যায় না। নিজের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারলে সর্বাত্মক সক্ষমতা দেখানো যায়। নির্বাচন করতে না দেওয়ার রণনীতি যে বন্ধ দরজায় আটকে গেল, তাকে কী উপায়ে খোলা যাবে সেটাই এখন বিএনপির বড় ভাবনা নিশ্চয়ই।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিন দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twelve − 6 =