চড়েও মাহাত্ম্য আছে

মাহবুব আলম

আমাদের দেশে পঞ্চাশ-ষাট উর্ধ্ব প্রজন্ম ছোট বেলায় চড়-থাপ্পড় খায়নি এমন ঘটনা কমই আছে। কারণে অকারণে এই চড়-থাপ্পড় খেতে হয়েছে। কখনো বাড়িতে বাবা-মা-বড় ভাই বোনের কাছে, কখনো স্কুলে পড়া না পারার জন্য শিক্ষকের কাছে, আবার কখনো পাড়া-মহল্লায় বড় ভাই, কথিত সিনিয়র দাবিদারের কাছে। এ ছাড়াও পাড়া-মহল্লায় বা স্কুলের বন্ধু সহপাঠিদের সঙ্গে রাগারাগি ঝগড়ার এক পর্যায়ে কোনো এক বন্ধু কিল ঘুষির আগে কষে একটা বড় মেরে দিয়েছে। এই নিয়ে হৈচৈ হাঙ্গামাও কম হয়নি। তবে তা খুবই ক্ষণস্থায়ী, হৈচৈয়ের বেশি কিছু নয়। ‘এছাড়াও এক চড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দেবো। বেশি বাড়িস না চড়ায়া ঠিক করে দেবো।’ এই সব শুনতে শুনতেই ৫০-৬০ এর প্রজন্ম বড় হয়েছে। অন্যভাবে বললে বলতে হয় আমাদের দেশে চড়-থাপ্পড় একেবারে ডালভাত।

কারণে অকারণে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষকে চড়-থাপ্পড় খেতে হয়। সাধারণত বয়ষ্ক, উঁচুতলার ক্ষমতাধর শক্তিধর শক্তিশালী মানুষরাই চড়-থাপ্পড় মারে তার থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল নিচতলার বিত্তহীন মানুষকে।

আবার পারিবারিক জীবনে অশান্তির জেরে অনেক স্বামী সপাটে চড় কষে দেয় স্ত্রীর গালে। এ ক্ষেত্রেও দুর্বল বিত্তহীন পরিবার থেকে আসা স্ত্রীদের গালে।

আর যদি পাড়ায় ছেলেধরা বা পকেটমার ধরা পড়ে তাহলে তো কথাই নেই। যে যেভাবে পারে চড়-থাপ্পর দিয়ে নিজের আয়েশ মিটিয়ে নেয়।

এখন প্রশ্ন হলআ এই চড়-থাপ্পড় মারা কি ভালো? নিঃসন্দেহে উত্তর হবে, না, মোটেও নয়। আর তাইতো আজকাল স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর যেকোনো ধরনের শারীরিক আঘাত বা নির্যাতন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সচেতনতার কারণে আজকাল বাপ-মা’রাও তাদের সন্তানদের প্রতি নির্দয় হয় না। তারপরও বাড়িতে, পাড়া-মহল্লায় চড়-থাপ্পড়ের ঘটনা অহরহ ঘটে। ঘটে ভাই বোনদের মধ্যেও। এমনও দেখা গেছে বা দেখা যায় লুডু খেলতে গিয়ে বড় বোন তার ছোট ভাইয়ের সাথে বারবার চিটিং করে জিতে যায়। বড় বোন ধরেই নেয় ওতো ছোট, ওকি চিটিং ধরতে পারবে? না, পারবে না। তাই সবসময় জেতার জন্য চিটিং করে। বিষয়টা ছোট ভাই কখনো কখনো ধরে ফেলে। তারপর রাগে ক্ষোভে ঠাস করে বোনের গালে থাপ্পড় মারে। এরকম ঘটনা এখনো অহরহ হয় ঘরে ঘরে। কিন্তু এই নিয়ে খুব একটা চর্চা হয়েছে বা হয় এমন ঘটনা কখনো চোখে পড়েনি।

কিন্তু সম্প্রতি চড় নিয়ে চর্চা হয়েছে। চড় কি, কেন, চড়ের রূপ রঙ ইত্যাদি নিয়ে। বাংলা ভাষায় চড়ের আওয়াজ কেমন, চড় কি শব্দ, বাংলা বা বিদেশি নানান বিষয় নিয়ে। চড়, চপাট, থাপড়, থাপ্পড় নিয়ে এই চর্চা এখন পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে। এর কারণ এবার দুর্বলের গালে সবলের চড় নয়, এবার ঘটেছে সবলের গালে দুর্বলের সপাটে চড়।

রীতিমতো ভিআইপির গালে, তাও যে সে ভিআইপি নয়, রীতিমতো ডবল ভিআইপি। এক দিকে বলিউডের তারকাখ্যাতির ভিআইপি, অন্যদিকে সদ্যসমাপ্ত ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপির টিকেটে নির্বাচিত এমপি কঙ্গনা রানাওয়াত।

যার হাতও অনেক লম্বা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পর্যন্ত। নির্বাচনী প্রচারে মোদী নিজেকে এক প্রকারের ঈশ্বর ঘোষণার আগেই এই কঙ্গনা রানাওয়াত নরেন্দ্র মোদীকে হিন্দু দেবতা রামের বংশধর বলে দাবি করেন। আর তাইতো তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। নিয়ম অনুযায়ী বিমানবন্দরে সিকিউরিটি চেকিংয়ের সময় মোবাইল ফোন ট্রেতে দেয়ার কথা। কিন্তু তিনি তা না দিয়ে সিকিউরিটির দায়িত্বরতদের ধাক্কা দিয়ে হেঁটে যান। এই ঘটনায় এক সিআইএসএফ জোয়ান কুলবিন্দর কাউর তাৎক্ষণিকভাবে বলিউড সুন্দরী কঙ্গনা রানাওয়াতের গালে সপাটে চড় মারেন। নারী হলেও সেনা জোয়ানতো বটে। ফলে বিরাশি পাউন্ডের ক্ষিপ্রগতির দাপুটে চড়ে কঙ্গনার ফর্সা গলে জোয়ানের পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যা ভারতসহ সারা দুনিয়ার মানুষ সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে প্রত্যক্ষ করেছে। প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশের মানুষও।

না, তাক্ষণিক ঘটনায় হঠাৎ মেজাজ হারানো ঘটনা নয় এটা। এটা হলো কুলবিন্দর কাউরের মনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পুষে রাখা রাগ, ক্ষোভ ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। চড় মারার পর কুলবিন্দর কাউর নিজেই বলেছেন, ‘ও আমার মাকে অসম্মান করেছে, ও কৃষক আন্দোলনকে অসম্মান করেছে।’ সেই সাথে একথাও বলেছেন, ‘এরকম হাজারটা চাকরি গেলেও কিছু আসে যায় না। এটা আমার আত্মমর্যাদার বিষয়।’ সত্যিই অসাধারণ ঘটনা। সত্যিই সাহসী ঘটনা। এই ঘটনা ‘ঝিকে মরে বৌকে শিক্ষা দেওয়া’র বাংলা প্রবাদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এ চড় যে সে চড় নয়, এই চড় আন্দোলনকারীদের অবজ্ঞা, হেয় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার কড়া জবাব।

আর তাইতো এই চড় নিয়ে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়েছে। গোটা ভারত দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে এই চড়ের জন্য অনেকে সাহসী বর্ণনা করে কুলবিন্দর কাউরকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। শুধু তাই নয়, কুলবিন্দর কাউরের প্রতি যেন অবিচার না নয় তার জন্য রীতিমতো পদযাত্রা, বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সম্মিলিত কিষাণ মোর্চা ও কিষাণ মজদুর মৌচা কুলবিন্দর কাউরকে কুর্নিশ জানিয়েছে। এমনকী কাউরের অশতিপর বৃদ্ধ মাও মেয়ের চড়কাণ্ডকে সমর্থন দিয়েছেন। অবশ্য, ভিন্নমতও আছে। শাবানা আজমির মতো সেলিব্রিটি বলেছেন, ‘সেই চড় নিয়ে যারা উদ্যাপন করছেন আমি তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারছি না। যদি নিরাপত্তা কর্মীরা এভাবে নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয় তাহলে আমরা কেউ-ই নিরাপদ নই।’

উল্লেখ্য, ২০২০-২১ সালে দিল্লিতে যে হাজার হাজার কৃষক প্রায় বছরব্যাপী আন্দোলন করেন, সেই আন্দোলনে যোগদানকারী নারীদেরই একজনের সন্তান এই কুলবিন্দর কাউর। ওই আন্দোলনের সময় কঙ্গনা রানাওয়াত আন্দোলনকারী নারীদের অসম্মান করে বলেছিলেন, কৃষকরা অর্থের বিনিময়ে দিল্লি সীমান্তে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভ করার জন্য ওদেরকে ১০০ বা ২০০ রুপি দেওয়া হয়েছে।

কঙ্গনা রানাওয়াত সুন্দরী ও খ্যাতিমান অভিনেত্রী হলেও কার্যত মুখরা নারী। মুখরা নারীদের যা হয়, এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এই বলিউড সুন্দরী ভারতের স্বাধীনতাকেই অসম্মান করে সোস্যাল মিডিয়া পোস্ট দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ৪৭-এর স্বাধীনতা ভিক্ষার সমান। ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা এসেছে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতায় আসার মধ্যদিয়ে। এই কারণে কঙ্গনা বিজেপির চরম জাতীয়তাবাদী ও ধর্মবাদী রাজনীতির ‘পোস্টার গার্ল’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।

সে যাই হোক। বিষয় চড়। সাধারণভাবে আমাদের অভিজ্ঞতা চড় হলো তাৎক্ষণিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ অথবা কাউকে অপমান করার অস্ত্র। এর ভালো মন্দ দুটি দিকই আছে। চড় মেরে যেমন কেউ কেউ প্রশান্তি লাভ করেন, তৃপ্ত হন। তেমনই চড় মেরে অনুশোচনা ও মনঃকষ্টের ঘটনাও তো কম নয়। শুধু তাই নয় একসময় আমাদের সমাজ মেনেই নিয়েছিল আদব-লেহাজের জন্য চড় একটা উত্তম পন্থা। উত্তম পন্থা শিক্ষা-সংস্কৃতির জন্যও। তাছাড়া চড় রাগ কমানোর জন্য মায়েদের এক মহাঅস্ত্র। এতে শুধু রাগই কমে না, সাথে সাথে ব্লাড প্রেশারও কমে। তাই বলা যায় ঠাস করে নয়, সপাটে চড় ক্ষতি নয় উপকারই করে।

কিন্তু কুলবিন্দর কাউরের চড় অতীতের সবকিছুকে ছাপিয়ে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এই চড় আত্মমর্যাদা, সম্মান রক্ষা ও আন্দোলন বিরোধী বিশেষ করে কিষাণ মজদুর বিরোধীদের বিরুদ্ধে এক সাহসী প্রতিবাদ। আর তাইতো এই চড় উদযাপন করছে অনেকে। সেই সাথে ওই দিনটিকে চড় দিবস পালনের প্রস্তাবনা করে এই প্রস্তাবনার স্বপক্ষে জনমত তৈরি করারও উদ্যোগ নিয়েছে অনেকে। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, চড়েরও মাহাত্ম্য আছে। একটা চড়ও দেশ জাতি জনতাকে নাড়িয়ে দিতে পারে। সেই সাথে এই চড় প্রতিবাদের নতুন ভাষাও হতে পারে।

এটা সকলের পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু এটাই সত্যি যে, দুর্বল একবার রুখে দাঁড়ালে সে যত ক্ষুদ্র ব্যক্তিই হোক না কেন এতেও অনেক কিছু হতে পারে। তাইতো কুলবিন্দর কাউর আইনের চোখে অপরাধী হলেও মনুষ্য বিবেকের দৃষ্টিতে নির্দোষ নিরাপরাধ। এ থেকে এটাও স্পষ্ট যে, চড়ের মাহাত্ম্য আছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 × five =