পেছাচ্ছে নাকি এগুচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট

নিবিড় চৌধুরী

বাংলাদেশের ক্রিকেট বাংলাদেশের ক্রিকেট কি তবে ধ্বংসের পথে বসেছে? সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স দেখলে যে কারও এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরের সূচিতে সেই যে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানকে দুই টেস্ট সিরিজে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশ করলো, এরপর থেকে তো উল্টোরথে নাজমুল হোসেন শান্তরা। অথচ সেই ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের পর আবারও উত্থানের যে ইঙ্গিত দিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল, সেটিতে এখন ধুলা জমেছে।

ভারত সফরে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি সিরিজে হোয়াইটওয়াশ, ঘরের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ, শারজায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে হার; বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছেই। টানা তিন দলের বিপক্ষে নাজেহাল হওয়ার কষ্ট নিয়ে শান্ত-তাসকিনরা এখন গেছেন ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুই টেস্ট, সমান তিন ম্যাচের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে। সেখানে কি বাংলাদেশ হারানো গৌরব উদ্ধার করতে পারবে? বাংলাদেশের ক্রিকেটে অবশ্য গৌরবের চেয়ে হারের পরিসংখ্যানের গ্রাফটাই উর্ধ্বমুখী। তারপরও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর বলেই কিছুটা আশা করা যায়। ক্যারিবীয়দের তিন সংস্করণেই আগে বেশ কয়েকবার হারানোর কীর্তি আছে বাংলাদেশের। এমনকি উইন্ডিজের মাঠেও জিতেছে টেস্ট ম্যাচ। কিন্তু হারের বৃত্তে থাকা বাংলাদেশের ভয় যে ক্যারিবীয়দের পেস আক্রমণ নিয়ে! বাউন্সি উইকেটে শান্ত-লিটনদের দুর্বলতা নতুন নয়। তার মধ্যে কেমার রোচের মতন অভিজ্ঞ ও শামার জোসেফের মতন নতুন ম্যাচ জেতানো পেসারদের সামলানো চাট্টখানি কথা নয়।

ট্যুর ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নির্বাচিত একাদশের বিপক্ষে যে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে সেখানেও দুর্বলতা চোখে পড়েছে বাংলাদেশের। রান পাননি টপ অর্ডাররা। তাদের ব্যাটে এই রানখরা অবশ্য নতুন নয়। লম্বা সময় ধরে বাংলাদেশের ওপেনাররা রান পাচ্ছেন না। অ্যান্টিগার ভিভ রিচার্ডস স্টেডিয়ামে মিডল অর্ডারে নেমে রান পেয়েছেন উইকেটরক্ষক জাকের আলী অনিক ও মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন। তার মধ্যে জাকেরের অভিজ্ঞতা বলতে চট্টগ্রামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১টি টেস্ট খেলা আর অঙ্কনের এখনো অভিষেক হয়নি। রাজনৈতিক কারণে দেশে ফিরতে না পারায় সাকিব আল হাসান খেলতে পারেননি প্রোটিয়াদের বিপক্ষে টেস্টে। আফগানদের বিপক্ষে সিরিজেও ছিলেন না তিনি। যাননি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। অবশ্য প্রোটিয়াদের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে লাল বলের ক্রিকেটকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় বলতে চেয়েছিলেন সাকিব। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ভারতের বিপক্ষে চেন্নাই টেস্টই হয়ে থাকল বাংলাদেশের কিংবদন্তি অলরাউন্ডারের সাদা পোশাকের ক্রিকেটের শেষ অধ্যায়। দেশে ফিরতে না পারলে হয়তো নতুন রূপে হতে যাওয়া আগামী বিপিএলেও (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) খেলা হবে না তার।

মাশরাফি বিন মর্তুজা, তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান বিদায় নিয়েছেন টেস্ট থেকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের কথিত পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে এই অভিজাত সংস্করণে এখনও খেলছেন শুধু উইকেটরক্ষক-ব্যাটার মুশফিকুর রহিম। তবে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ফেরার পর হাসেনি তার ব্যাটও। তবে চোটের কারণে উইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে খেলা হচ্ছে না মুশফিকেরও। এমনকি সাদা বলের সিরিজেও তার না খেলার সম্ভাবনায় বেশি।

অ্যান্টিগায় সিরিজের প্রথম টেস্টে চোটের কারণে খেলা হয়নি বাংলাদেশ দলের নিয়মিত অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর। তার পরিবর্তে টস করতে নামেন অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ। তাতেই বাংলাদেশের ক্রিকেট পেয়ে গেল ১৪তম টেস্ট অধিনায়ক। অভিজ্ঞদের বিদায় ও চোট, স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ দল কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তরুণেরা সুযোগ পেলেও এখনও সেভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। এর আরেক কারণ, বাংলাদেশ দলের পাইপলাইন শক্ত না থাকা। ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীনতার কারণে উঠে আসছে না ভালো ক্রিকেটার। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (ডিপিএল) বা জাতীয় ক্রিকেট লিগে (এনসিএল) রানের বন্যা ছোটালেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের মেলে ধরতে পারছেন না ব্যাটাররা।

এনামুল হক বিজয় বা সৌম্য সরকারের কথায়ই ধরুন। ঘরোয়া ক্রিকেটে তারা রান পেয়েছেন। বড় ইনিংস খেলেছেন। কিন্তু সেই পারফরম্যান্স নিয়ে জাতীয় দলে ফিরলেও উইকেটেই টিকতে পারছেন না বেশিক্ষণ। বাংলাদেশি ব্যাটারদের ইনিংস বড় করতে না পারার পেছনে টেকনিক্যাল ও মানসিক সমস্যা দুই-ই আছে। কিন্তু কেউ এ নিয়ে খুব বেশি কাজ করেন না। অথচ বিরাট কোহলির মতো ব্যাটারও এখনও নেটে অন্যদের চেয়ে বেশি ঘাম ঝরান। রানক্ষুধা ও সাফল্যের জন্য মুখিয়ে থাকেন। টেস্টে স্টিভেন স্মিথের মতো ব্যাটার দ্রুত আউট হয়ে গেলে যেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং পরের ইনিংসে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন সেটি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে দেখা যায় কই! তবে কি গেম প্ল্যান, স্পৃহা, ডেডিকেশনের অভাব?

বাংলাদেশের প্রিয় সংস্করণ ওয়ানডে। এই সংস্করণেই অনেক স্মরণীয় মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে টাইগাররা। কিন্তু একদিনের ক্রিকেটেই শান্ত-মিরাজরা শারজায় আফগানদের বিপক্ষে হেরেছে। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি মেজাজে এখনো অন্যান্য দলগুলোর চেয়ে বেশ পিছিয়ে বাংলাদেশ। সেটি যে কবে তৈরি হবে, খোদা জানেন। বাইরে ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফর্মকে বেশ প্রাধান্য দেওয়া হয়। শচীন টেন্ডুলকারের মতো ব্যাটার যখন এক সময় রান পাচ্ছিলেন না তখন রঞ্জি খেলতে শুরু করেছিলেন। সেখানে ফর্মে ফিরে আবারও জাতীয় দলে রানের ফোয়ারা বইয়ে দিয়েছেন। এবার যখন ঘরের মাটিতে ভারত তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে নিউ জিল্যান্ডের হাতে ভারত ধবলধোলাই হলো, সমালোচকেরা রানখরার জন্য দুই অভিজ্ঞ ব্যাটার রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলিকে রঞ্জি খেলার পরামর্শ দিয়েছেন। আইপিএল, দুলীপ ট্রফি, রঞ্জি মিলিয়ে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যার কারণে শচীন, সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়, মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো ক্রিকেটাররা অবসর নিলেও কখনো সংকটে পড়তে হয়নি তাদের। উঠে এসেছেন শুবমান গিল, যশস্বী জয়সওয়াল, ঋষভ পন্তের মতো ব্যাটার। যে দেশের পাইপলাইন যত শক্ত সে দল ততোই উন্নতি করবে, এটাই সত্যি। শুধু ভারত নয়; অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দলগুলোও জোর দেয় পাইপলাইনের ওপর। তাদের ঘরোয়া ঘরোয়া লিগগুলোর দিকে চোখ বুলালেই সেটি বুঝা যায়।

পাইপলাইন শক্ত না থাকার কারণে কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে, মুত্তিয়া মুরালিধরন, তিলকারত্নে দিলশানের মতো তারকারা যখন অবসর নিয়েছিলেন তখন কঠিন সময় পার করতে হয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। কুশল মেন্ডিস, পাতুম নিশানকাদের হাত ধরে অবশ্য লঙ্কানরা এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। ‘মাতারা হারিকেন’ খ্যাত সনাথ জয়াসুরিয়ার কোচিংয়ে বেশ ভালোই করছে তারা। কিন্তু বাংলাদেশ? পেছনের দিকেই যেন হাঁটছে।

বাংলাদেশিরা ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করছেন বটে। এবার যেমন এনসিএলে (পঞ্চম রাউন্ড পর্যন্ত) রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন অমিত হাসান (৫৬৭), অমিত মজুমদার (৫৩০), এনামুল হক বিজয় (৫২১), ইফতিখার হোসেন ইফতি (৫১৩)। বিজয় ছাড়া এখানে বাকিদের এখনো জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হয়নি। ঘরোয়া ক্রিকেটে যখন ভালো করে কেউ জাতীয় দলে ঢুকে তখন তার প্রতি প্রত্যাশা থাকে বেশি। কিন্তু সেই চাপ সামাল দিতে পারেন না অনেকে। খুব কম ক্রিকেটারই সেটা পারেন। কেন পারেন না সেটি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক কথা বলেছেন আবদুর রাজ্জাক। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচক বলেছেন, ‘জাতীয় লিগের মান আন্তর্জাতিক ম্যাচের মানের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব নয়, যদিও কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ক্রিকেটারদের গেম প্ল্যান এবং মানসিকতা বদলাতে পারলে সেই ঘাটতি কিছুটা কমানো সম্ভব। জাতীয় লিগ, কাউন্টি ক্রিকেট কিংবা অস্ট্রেলিয়ান ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ এবং আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে।’

বাংলাদেশের ঘরোর ক্রিকেটের মান নিয়ে আগেও প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনতা, দুর্নীতি, বাজে উইকেট, বাজে আম্পায়ারিং; এসব নিয়ে অনেকে কথা বলেছেন। তবে বিসিবিকে এসব নিয়ে খুব সরব দেখা যায়নি কখনো। এবার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিপিএল ঢেলে সাজাতে শুরু করেছে বিসিবির নতুন কমিটি। তারা যদি এনসিএল, ডিপিএল, বিসিএলের মতো লিগের দিকেও ভালোমতো নজর দেয় তবে ঘরোয়া ক্রিকেট কিছুটা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও স্বচ্ছ হবে। টি-টোয়েন্টি আসার পর থেকে রাতারাতি খ্যাতি ও অর্থ লাভের আশায় এখন ক্রিকেটারদের বেশি মনোযোগ থাকে। তবে ক্রিকেটের আদি সংস্করণ টেস্ট। সেটাতেই যদি ভালো না করে তবে দেশের ক্রিকেট দাঁড়াবে না। এই কারণে বিসিবির উচিত শুধু বিপিএলের দিকে মনোযোগ না দিয়ে জাতীয় ক্রিকেট লিগের মান আরও বাড়ানো। টেস্টে বাংলাদেশের এমনিতে যে অবস্থা, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য নিয়মিত চার দিনের ম্যাচ খেলা জরুরি হয়ে পড়েছে। খেলোয়াড়দের আঁতুড়ঘরকে আরও শক্ত করার দিকে মনোযোগ আব্দুর রাজ্জাকের। বাংলাদেশ দলের সাবেক এই স্পিনার বলেছেন, ‘সত্যি কথা বলতে, সবাই এখন টি-টোয়েন্টি নিয়ে ব্যস্ত। জাতীয় লিগ বা ঘরোয়া চার দিনের ক্রিকেটকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। অথচ জাতীয় লিগকে আমরা ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর বলি। এখান থেকে খেলোয়াড়দের তৈরি হতে হয়।’

বাইরের দেশগুলো এখন বেশিরভাগই নিজেদের কোচ নিয়োগ দিচ্ছে। ভারতে যেমন রবি শাস্ত্রীর পর রাহুল দ্রাবিড়, দ্রাবিড়ের পর গৌতম গম্ভীর দায়িত্ব নিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার কোচ হয়েছেন জয়াসুরিয়া। পাকিস্তানের দায়িত্ব নিয়েছেন আকিব জাবেদ। তারা সবাই নিজ দেশের সাবেক ক্রিকেটার। কিন্তু আজতক আমাদের দেশে স্থায়ীভাবে দেশের কোন কোচ জাতীয় দল সামেলেছেন? সবসময় বাইরে থেকে কোচ এনে দল চালিয়েছে বিসিবি। ঘরোয়া ক্রিকেটে সালাহ উদ্দিনের কোচিংয়ের প্রশংসা শোনা গেলেও তাকে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে চিন্তা করেনি। এমনকি আমিনুল ইসলাম বুলবুলদের মতো সাবেকদের আনা যেত কোচিংয়ে। প্রধান কোচ না করা হলেও কোচিং প্যানেলে থাকলে বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই লাভ হতো। অন্তত এবার সেই পথে হাঁটবে তো ফারুক আহমেদের বিসিবি?

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

12 − three =