হাসান নীল
৯০ দশকে যারা বেড়ে উঠেছেন তাদের ছেলেবেলাটা পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্য লোভনীয়। এক একটি স্মৃতি যেন রূপকথার গল্প। খাবার দাবার, পোশাক আশাক সবকিছুতেই। বেলা বিস্কুটের সঙ্গেও ৯০ দশকের প্রজন্ম সরাসরি জড়িত। আমিও তাদের একজন। খুব সহজলভ্য ছিল বেলা বিস্কুট। একটির দাম ২৫ পয়সা। এক টাকায় মুঠো ভরে যেত। খেতে অতটা নরম কোমল ছিল না। কচি দাঁতে ভেঙে খাওয়া সম্ভব হতো না। এ যেন শাপে বর ছিল। একটি বেলা বিস্কুট কামড়াতে কামড়াতে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যাওয়া। ফেরার সময় অন্য একটি নিয়ে কামড়াতে কামড়াতে ফেরা। সব মিলিয়ে বেলা বিস্কুট যেন ছিল মন ভালো করে দেওয়ার গল্প। ফেলে আসা শৈশবের ভেলায় ভেসে গেছে বেলা বিস্কুট। আজকাল সচরাচর মেলে না।
উৎপত্তি
বেলা বিস্কুটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আব্দুল গনির নাম। শোনা যায় তার হাত ধরেই এই বিস্কুটের উৎপত্তি। কীভাবে গনির হাত ধরে বেলা বিস্কুটের উৎপত্তি সেই ঘটনাও কারও জানা নেই। তারপরও যেটুকু শোনা যায় সেটুকু বলতে গেলে যেতে হবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। তাও আবার ২০০ থেকে ২৫০ বছর পেছনে। কেননা এখান থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল গোল আকৃতির এই বিস্কুটের। সে সময় উপমহাদেশে নানান দেশের বণিকদের যাওয়া আসা। এরমধ্যে অন্যতম ছিল পর্তুগিজ। পর্তুগিজ ও মোঘলদের পছন্দ ছিল বেকারি জাতীয় খাবার। মূলত এই জায়গা থেকেই বেকারি শিল্পের সূচনা চট্টগ্রামে। গনি বেকারির শুরুটাও সেসময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বেকারিতে আনাগোনা করত ব্রিটিশ সৈন্যদের। বেলা বিস্কুট ছিল তাদেরও পছন্দের।
গনি বেকারি
এই গনি বেকারির পেছনেও রয়েছে একটি গল্প। গনি বেকারির শুরুটা তারও কয়েক পুরুষ আগের। আবদুল গনি সওদাগরের পূর্বপুরুষ লাল খাঁ সুবেদার ও তার ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির হাত ধরে বেকারির কেক বিস্কুট বন ইত্যাদি তৈরি হয়। আব্দুল গনি গত হয়েছেন অনেক বছর আগে। তবে গনি বেকারি আজও রয়ে গেছে। তার মৃত্যুর পর এর হাল ধরেন তার ভাইয়ের ছেলে। ভাতুষ্পুত্রকে আব্দুল গনি ওয়াকফ করে বেকারিটির মালিকানা দিয়েছিলেন।
কেউ দেখেনি তাকে
বেলা বিস্কুটের নামকরণ নিয়েও রয়েছে দ্বিমত। তবে সর্বজনগৃহীত গল্পটি হচ্ছে বিস্কুট বিক্রেতা বেলায়েত হোসেনের নাম অনুসারে হয়েছে এই বেলা বিস্কুটের নাম। তবে সেই বেলায়েত হোসেনকে আজ থেকে দুই আড়াই শ বছর আগেও কেউ দেখেননি। তাই একটি ধোঁয়াশা থেকেই যায়। লেখক ও গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, বেলা বিস্কুট আমাদের ঐতিহ্য বহন করে। অনেকের ধারনা ১৫০ থেকে ২০০ বছর আগে কেউ বেলায়েতকে দেখেনি, বেলায়েতের নাম যারা বলে তারাও দেখেনি। অনেকে মনে করেন বেলিয়ে তৈরি করা হয় বলে বেলা বিস্কুট নামকরণ করা হয়। তবে আমার কাছে বেলায়ত নামে বেলা বিস্কুটের নামকরণটাই গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
চট্টগ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক
চট্টগ্রামের মানুষের সঙ্গেও বেলা বিস্কুটের সম্পর্কটা অন্যরকম। এটি তাদের আবেগ জুড়ে আছে। এ শহরের অনেক পরিবার আছে যাদের সকালের চা’য়ে বেলা বিস্কুট না হলে চলেই না। এটি তাদের কাছে ঐতিহ্য।
বিভিন্ন বেকারিতে তৈরি
আজকাল গনি বেকারি ছাড়াও বিভিন্ন বেকারিতে তৈরি করা হয় বেলা বিস্কুট। এরমধ্যে রয়েছে নামিদামি ব্র্যান্ডও। মাদারবাড়ির পানাহার বেকারি, মুরাদপুরের হাসিনা বেকারি, বহদ্দারহাটের জান্নাত বেকারি, চকবাজারের হাজী ফয়েজ বেকারি, পাঁচলাইশের প্রবাসী বেকারি। এসব বেকারির কোনো শাখা নেই। অন্যদিকে হাইওয়ে সুইট, ইস্পাহানি ওয়েল ফুড, আম্মান ফুড, চট্টলা বেকারিসহ বড় কিছু প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করছে বেলা বিস্কুট। এসব বেকারির বিভিন্ন শাখায় পাওয়া যায় এই বিস্কুট। তবে স্বাদে রাজত্ব ধরে রেখেছে গনি বেকারী। এরও বেশ কিছু কারণ আছে। আজকাল বিভিন্ন বেকারি তৈরিতে নানান ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলেও সে পথে হাঁটেনি গনি বেকারি। সেই ব্রিটিশ আমলের পদ্ধতিতেই বেলা বিস্কুট তৈরি করা হয় সেখানে।
পুরানো নিয়মেই গনির বেলা
পুরানো নিয়ম অনুসরণ করায় গনি বেকারির বেলা বিস্কুট তৈরিতে অন্তত দুই দিন সময় লাগে। প্রথমে তৈরি করা হয় খামির। এতে ব্যবহার করা হয় ময়দা, চিনি, লবণ, ভোজ্য তেল, ডালডা, গুঁড়া দুধ। এগুলো প্রথমে পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে খামির তৈরি করা হয়। ইস্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও গনি বেকারি বেলা বিস্কুটের ক্ষেত্রে সেটি এড়িয়ে চলে। তার বদলে দেয় বিশেষ ধরনের মেওয়া। তবে কি দিয়ে বানানো হয় মেওয়া সে বিষয়টি রহস্য আবৃত। গনি বেকারি সংশ্লিষ্টরা এটি প্রকাশ করতে চান না। খামিরে মেওয়া মিশিয়ে একদিন রাখা হয়। এরপর মাওয়াযুক্ত খামির তন্দুরে এক ঘণ্টা সেঁকা হয়। পরের দফায় আরও একবার সেঁকে তৈরি করা হয় বেলা বিস্কুট। বেলা বিস্কুট সেঁকতে গ্যাসের সঙ্গে ব্যবহার করা হয় কাঠ কয়লা।
সাহিত্যে বেলা বিস্কুট
সাহিত্যিকদের লেখায় উঠে এসেছে বেলা বিস্কুটের কথা। চট্টগ্রামের সাবেক উপাচার্য ও সাহিত্যিক আবুল ফজল তার আত্মজীবনী রেখাচিত্রে বেলা বিস্কুট নিয়ে লিখেছেন। তার কথায়, ‘ঘুম থেকে উঠে পান্তা ভাতের বদলে খাচ্ছি গরম-গরম চা, বেলা কুকিজ নামের বিস্কুট দিয়ে। কুকিজ ইংরেজি নাম বেলা কিন্তু খাস চাটগেঁয়ে।’ এছাড়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বেলা বিস্কুট নিয়ে রচিত হয়েছে, ‘বেলা বিস্কুট টুগুর গড়ি হঁর দিলি বুডুর গড়ি গুড়ি পড়ে। দুধ চার হাপত ভিজাই হাইলে বলে রসের গোল্লার মত লাগে, কেউ হদ্দে বেলা বিস্কুট আগের ঢইল্ল্যা নাই, হাইতো গেলি বলে দাঁত ভাঙ্গি ফেলার’। খনার বচনেও উল্লেখ আছে বেলা বিস্কুটের কথা, ‘বেলার বর ঠেলার গাড়ি এক ঠেলাতে দোহাজারি’!
প্রকারভেদ
প্রতিদিন গনি বেকারিতে ৬ থেকে ৮ হাজার পিস বেলা বিস্কুট তৈরি হয়। যা একসঙ্গে করে হয় দেড় শ থেকে দুই শ প্যাকেট। তবে বেলার মধ্যেও প্রকারভেদ রয়েছে। এরমধ্যে একটি মাখন বেলা, অন্যটি রোজ বেলা। দুই ধরনের বেলার দামে রয়েছে তফাৎ। মাখন বেলা ৩০ পিসের দাম ১৫০ টাকা আর রোজবেলা ৮৫০ গ্রামের দাম ১১০ টাকা।
চাহিদার শীর্ষে
গনি বেকারিতে রয়েছে বেলা ছাড়াও আরও বিভিন্ন পণ্য। সব মিলিয়ে ৩০ ধরনের হবে। তবে সবগুলোর মধ্যে চাহিদার শীর্ষে এই বেলা বিস্কুট। চট্টগ্রামের বিভিন্ন বয়সী ক্রেতা বিস্কুট কিনতে ভিড় জমায়। কেউ দাদার আমল থেকে খাচ্ছে। কারও নিজেদেরই প্রিয়। কেউবা আসেন ঐতিহ্য রক্ষায়। ক্লাসের ফাঁকে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও ভিড় করে এখানে।
সীমানা ছাড়িয়ে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বাস। সাত সমুদ্রের তেরো নদীর পাড়ে বসে তারাও বেলা বিস্কুটের অভাব বোধ করেন। ফলে ওই সব দেশগুলোতেও পাঠানো হয় বেলা বিস্কুট। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে সমান জনপ্রিয় এই বেলা বিস্কুট।
চাহিদায় ভাটা
তবে আজকাল চাহিদায় যেন ভাটা পড়েছে বেলা বিস্কুটের। কয়েক বছর আগে গনি বেকারির মালিক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম বলেছিলেন, ১০ বছর আগেও প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার পিস বেলা বিস্কুট বিক্রি হতো। তবে তা এখন অনেক কমে গেছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার পিস বেলা বিস্কুট বিক্রি হয়। সে হিসাবে মাসে বিক্রি হয় ৪০ লাখ টাকার। প্রতি পিস বেলা বিস্কুটের দাম সোয়া দুই টাকা।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খাদ্য কথন