মাহবুব আলম
সংস্কার আগে, না নির্বাচন আগে? জোরে সোরে এই বিতর্ক শুরু হয়েছে। এটা অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগে বিতর্কের মতো। আর এই বিতর্ক উসকে দিচ্ছে আমাদের গণমাধ্যম। উসকে দিচ্ছে বলা হলে যথার্থ বলা হবে না। বরং বলা উচিত, মিডিয়াই এই বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে, দিয়েছে। অবশ্য, এজন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই মূলত দায়ী। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাত্র তিন দিনের মাথায় অনুষ্ঠিত বিএনপির এক সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের দাবি জানান। পরে একাধিক সভা-সমাবেশে বলেন, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। এরপর বলেন, দ্রুততম সময়ে সংস্কার সম্পন্ন করে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দিতে হবে। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। তিনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত নিজেকে পরিবর্তন করে বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিশেষ করে তিনি সংবিধান সংস্কারের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, নির্বাচিত সরকার সংবিধান সংস্কার করবে। একই সঙ্গে বিএনপি সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদসহ সংবিধানের ৬১টি সংশোধনী প্রস্তাব তুলে ধরেছে। বিষয়টির সুযোগ নিচ্ছে গণমাধ্যম। সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে যেখানে যে নেতাকে পাচ্ছেন তাদের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে।
এখানে বলা দরকার, আত্মপ্রচারের সুযোগ হিসেবে নিয়ে ছোট বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। আর টিভি হলে তো কথায় নেই। পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে যাচ্ছেতাই বলে দেন। বিশেষ করে নির্বাচনের প্রশ্নে।
এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সাংবাদিকরা বুম এগিয়ে দিয়ে নেতাদের সংস্কারের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেছেন এমন ঘটনা খুবই কম। বরং নেই বললেই চলে। আশার কথা, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে? এই প্রশ্ন বিভ্রান্তিমূলক। কেবল একটি নির্বাচনের জন্য গণঅভ্যুত্থান হয়নি।’ এটা যেমন বাস্তবতা অপরদিকে দেড় দশকের নির্মম বাস্তবতা ছিল যে, জনগণকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন রেখে নির্বাচন ছাড়াই বারবার সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে পলাতক স্বৈরাচার দেশে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করেছিল।
শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে ছাত্র-জনতা অন্তর্বর্তী সরকার করে রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষণা দেয়। ঘোষণা অনুযায়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রথমে ছয়টি পরে আরো ছয়টি সর্বমোট ১২টি কমিশন গঠন করেছে।
এই কমিশনগুলো হচ্ছে, সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রম অধিকার ও শ্রমজীবী বিষয়ে সংস্কার কমিশন, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন, আর্থিকখাত সংস্কার কমিশন ও স্থানীয় সরকার বিষয়ক সংস্কার কমিশন। এতে অবশ্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে সমাজে আরও সমতার সঙ্গে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা সৃষ্টির কমিশন গঠন।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বিগত স্বৈরশাসন আমলে আমাদের দেশে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী বহির্ভূত অন্যান্য জাতিসত্তাকে কার্যত উপেক্ষা করা হয়েছে। তাদেরকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বর্ণনা করে তাদের প্রতি এক ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতন করা হয়েছে। তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। অতীতে যেখানে তাদের মর্যাদা ছিল উপজাতি সেখানে তাদের মর্যাদা নির্ধারণ করা হয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। এটা খুবই বিভ্রান্তিমূলক ও অপমানজনক। যাইহোক, এই বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই ভেবে দেখবে।
অবশ্য, এ কথা ঠিক যে, বিগত শাসনামলে আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এক কথায়, সর্বাঙ্গে ব্যথা মলম দেব কোথা? এই অবস্থায় সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র সংস্কার একটা দীর্ঘমেয়াদি বিষয়।
অবশ্য, একথাও মনে রাখতে হবে এ ধরনের সংস্কার একটা বিপ্লবের পর পরই করতে হয়। বিভিন্ন দেশে তাই হয়েছে। এক্ষেত্রে রুশ বিপ্লব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যা কিছু করার লেনিন তার জীবদ্দশায় করে গেছেন। তিনি ১৯২৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাৎ বিপ্লবের মাত্র ৬ বছর পর। আর তাইতো দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘উচ্চাকাক্সক্ষী সংস্কার বাস্তবায়নে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে।’ বিষয়টা রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলো বুঝে গেছে। আর তাইতো এরা দ্রুত নির্বাচনের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ক্ষমতার জন্য এদের তর সইছে না।
এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে নিঃসন্দেহে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে। তবে এক্ষেত্রে বিএনপি জাতিকে একটা বার্তা দিয়েছে, তা হলোÑ বিএনপি এককভাবে সরকার গঠন করবে না। বিএনপি সকল দলকে সাথে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের অথবা জাতীয় সরকার গঠন করবে। দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট করবে। সেই সঙ্গে একজন পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না বলে জানিয়েছে। ফলে দেশ ও জনগণের মধ্যে এক ধরনের আশাবাদের জন্ম হয়েছে। এতে করে ত্রিয়াশীল ডান বাম সকল রাজনৈতিক দল সরকার গঠনে শরিক হবে এই আশা নিয়ে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে মাঠ গরম করছে।
সম্প্রতি বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম নেতা সাইফুল হককে এ বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে বিএনপি জামায়াতে ইসলাম’কে ছেড়ে বৃহৎ ঐক্যের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। আমাদের দাবি ছাড়াও বিএনপি’র ভেতরেও দীর্ঘদিন ধরে দাবি ছিল জামাতে ইসলাম’কে সঙ্গী না রাখার বিষয়ে। যাইহোক বিএনপি যে জাতীয় ঐক্যমত্যের সরকার গঠনের কথা বলছে তার প্রতি আমাদের সমর্থন আছে, আস্থা আছে।
এই অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে সঙ্গে সকল দল প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি আগামী শীতইে নির্বাচন করতে চায়। এক্ষেত্রে বিএনপি’র টার্গেট আগামী নভেম্বরে নির্বাচন। এ বিষয়ে সাইফুল হকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, সম্ভবত আগামী শীতেই নির্বাচন হবে। সংস্কারের প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
এ থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, দ্রুততম সময়ে নির্বাচন হবে। এবং রাষ্ট্রসংস্কার সম্পূর্ণ করার আগেই এই নির্বাচন হবে। সম্প্রতি সরকারের নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়েই এই ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। এখানে উল্লেখ্য, নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এইসব কমিশনের রিপোর্ট দেওয়ার কথা। এমনকি কমিশনের জানুয়ারি পর্যন্তও সময় লাগতে পারে। কিন্তু আমরা দেখলাম, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট দেওয়ার আগেই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো। এটা বিস্ময়কর, রীতিমতো পিছু হটা। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের দাবির মুখে অন্তর্বর্তী সরকারের পিছু হটা।
নির্বাচন কমিশন গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, নির্বাচনী ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়েছে। অবশ্য, তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না বললেও কোনো কোনো উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় নিয়ে মাঝেমধ্যে কথাবার্তা বলেছেন। সর্বশেষ ২৮ নভেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানা হাসান ও মাহফুজ আলম বলেছেন, সরকারের দিক থেকে দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে সংস্কার, বাংলাদেশের জনগণ এর জন্য জীবন দিয়েছে, এই সংস্কারের একটি দৃশ্যমান প্রক্রিয়া হওয়ার পরে পরেই নির্বাচন হবে। এ বিষয়ে আসিফ নজরুল বলেছেন, অতি প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে নির্বাচন দেওয়া হবে।
এ থেকে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে যে, দ্রুততম সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছেÑএই নির্বাচন কোন সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে? নতুন সংবিধানের? পুনঃলিখিত সংবিধানে নাকি সংশোধিত সংবিধানের অধীনে? অথবা বর্তমান সংবিধানের অধীনে? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। যদিও সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। ফলে সব মিলিয়ে জুলাই আগস্ট অভ্যুত্থানের চেতনা রাষ্ট্র সংস্কার বাধাগ্রস্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এটা হবে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবী চেতনার পরিপন্থী। এ বিষয়ে আর্থিকখাত সংস্কার কমিশনের প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের একটি বক্তব্য খুবই দিকনির্দেশনা মূলক। তিনি বলেছেন, দুর্নীতির পাহাড় সরাতে না পারলে, ‘লুটপাটকারীদের সম্পদ অধিগ্রহণ করতে না পারলে কিসের বিপ্লব?’ তিনি দেশের আর্থিক খাতের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘বিগত হাসিনা শাসনামলে তারা বাংলাদেশের দুটো কিডনিই খেয়ে ফেলেছে।’ বর্ষিয়ান এই অর্থনীতিবিদ নির্বাচন নয় সংস্কারের উপর জোর দিয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও সংস্কার করেই নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদুদ্দিন মাহমুদ শনিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক উন্নয়ন কনফারেন্সে বলেন, আগামী বছরই হয়তো আমরা রাজনৈতিক সরকার দেখতে পাবো। আমরা খুব স্বল্পকালীন একটি সরকার। আর আগামী বছরই রাজনৈতিক সরকার আসার বিষয়টি আমার ব্যক্তিগত মতামত। জানি না আসলে কি হবে। অন্যদিকে গত ২৪ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, আগামী নির্বাচন কবে হবে, তা প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হবে। এ নিয়ে বাকি যারা কথা বলছেন, সেগুলো তাদের ব্যক্তিগত মতামত।
পরিশেষে মনে রাখতে হবে, দেশের প্রতিটি সেক্টরে দীর্ঘদিনের জমে থাকা জঞ্জাল জলোচ্ছ্বাসের মাধ্যমে পরিষ্কার করতে হবে। কোনো দলীয় সরকারের আমলে কোনো সংস্কারই সম্ভব হয় না বিভিন্ন কারণে। মূলত রাজনীতিকদের মদদ দিতে গিয়েই কোনো সংস্কার করা যায় না। একটি সুন্দর দেশ গড়তে চাইলে তার ভেতরে জঞ্জাল রেখে সফল হওয়া যায় না। দীর্ঘদিনের জঞ্জাল; তাই তা খুব সহজেই যে সাফ করা যাবে, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। তবে সাফ করতে হবে। নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিগত সরকারের পতনের করুণ চিত্র থেকে যেন সবাই শিক্ষা লাভ করতে পারে যে ক্ষমতা কারও জন্যই চিরস্থায়ী নয়। জনগণের ক্ষমতা একসময় তাদের কাছেই আবার ফিরে আসে। তখন আর পালানোর কোনো পথ থাকে না।
যদি দ্রুততম সময়ে অতি প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার যে বাধাগ্রস্ত হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সে ক্ষেত্রে যা হবে তা হলো – রাষ্ট্র সংস্কার অথৈ জলে জল।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ