মূল তথ্যসংক্ষেপ
- এক দশকের কম সময়ে, বাংলাদেশে জ্বালানি দক্ষতা ১৩.৬৪% বেড়েছে, বার্ষিক গড় বৃদ্ধি হয়েছে ১.৫২%। শুধু ২০২৩–২৪ অর্থবছরেই ৭ মিলিয়ন টন তেলের সমপরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এড়ানোর ফলে ৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আমদানি ব্যয় কমেছে।
- ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় দেশে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির একটি কাঠামো গড়ে উঠেছে। তবে ২০১৬–১৭ অর্থবছর থেকে প্রাথমিক অগ্রগতির পর জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির গতি কমে যায়; আবার ২০২০–২১ অর্থবছর পরবর্তী জ্বালানি সরবরাহে ব্যাঘাত ও উচ্চ মূল্য জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকারে পরিণত করে।
- বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই জ্বালানি দক্ষতা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে রয়েছে। যেহেতু মোট জ্বালানির দুই-তৃতীয়াংশ গৃহস্থালি ও শিল্পখাতে ব্যবহৃত হয়, এসব খাতে আরও বেশি জ্বালানি দক্ষতা অর্জনে জোর দেওয়া প্রয়োজন ।
- যন্ত্রপাতির যথাযথ মানদণ্ড ও লেবেলিং, এবং প্যাসিভ ডিজাইন বিভিন্ন ভবনে সর্বোত্তম জ্বালানি দক্ষতা নিশ্চিত করবে। শিল্পখাতে মোটর, মোটর ড্রাইভ ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং গ্যাস বয়লার থেকে ইলেকট্রিক বয়লারে রূপান্তর জ্বালানি ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাবে।
১৭ ডিসেম্বর ২০২৫ (আইইইএফএ দক্ষিণ এশিয়া): গত এক দশকে জ্বালানি দক্ষতা বাড়াতে নেয়া উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ । এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখলে, বাংলাদেশ সময়সীমার (deadline) আগেই জ্বালানি দক্ষতার লক্ষ্য অর্জন করতে পারে বলে নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)।
“বাংলাদেশ এনার্জি এফিশিয়েন্সি গোলস উইথিন রিচ” শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সাল থেকে জ্বালানি দক্ষতার উন্নতির ফলে বাংলাদেশ জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করেছে, যা দেশের জন্য অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সুফল এনেছে। আইইইএফএ দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ বিষয়ক প্রধান জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম এই প্রতিবেদনের লেখক।
প্রতিবেদনে গত এক দশকে বাংলাদেশের প্রাথমিক জ্বালানি ব্যবহার ও মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর বৃদ্ধির হার বিশ্লেষণ করে জ্বালানি দক্ষতার অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়েছে।
শফিকুল আলম বলেন, “অর্থবছর ২০১৪–১৫ থেকে ২০২৩–২৪ সময়ে জ্বালানি দক্ষতা ১৩.৬৪% বেড়েছে, যেখানে ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা ২০%। শুধু অর্থবছর ২০২৩–২৪-এ জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির ফলে, ৭.০২ মিলিয়ন টন তেলসমতুল্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমেছে, যা প্রায় ৩.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আমদানি ব্যয় এড়াতে সহায়তা করেছে।”
২০১৬–১৭ অর্থবছর থেকে প্রাথমিক অগ্রগতির পর, জ্বালানি দক্ষিতা বৃদ্ধি কমে যায়; তবে অর্থবছর ২০২১–২২- পরবর্তী সময়ে, বৈশ্বিক জ্বালানির ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধি ও জ্বালানি সরবরাহে সঙ্কট, জ্বালানি দক্ষতাকে জরুরি অগ্রাধিকারে পরিণত করে। এর আগে ২০১৬ সালে প্রণীত এনার্জি এফিসিয়েন্সি অ্যান্ড কনজারভেশন মাস্টার প্ল্যান এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
পরবর্তীতে অন্যান্য নীতিমালা প্রণয়ন, স্বল্প খরচে প্রাপ্ত অর্থায়ন ও সহায়ক কর্মসূচি বাংলাদেশকে তার জ্বালানি দক্ষতার লক্ষ্য অর্জন—এমনকি অতিক্রম—করার পথে এগিয়ে দিয়েছে।
শফিকুল আলম আরও বলেন, “বাংলাদেশে বার্ষিক গড় জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির হার প্রায় ১.৫২%, যা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
হালনাগাদ জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) এ ২০২২ সালের সাপেক্ষে ২০৩৫ সালের মধ্যে ১৯.২% জ্বালানি দক্ষতার লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ সেই লক্ষ্যও এক বছর আগেই অর্জনের পথে রয়েছে। প্রতিবেদনটি বলছে, দেশের মোট জ্বালানির দুই-তৃতীয়াংশ যে খাতে ব্যবহার হয় সেই গৃহস্থালি ও শিল্পখাতকে লক্ষ্য করে পদক্ষেপ নিলে আরও বেশি জ্বালানি সাশ্রয় সম্ভব।
গৃহস্থালি, বাণিজ্যিক ও শিল্পখাতে কমপ্যাক্ট ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্প (সিএফএল) ও ইনক্যান্ডেসেন্ট বাতির বদলে বিদ্যুৎ-সাশ্রয়ী বাল্ব (এলইডি)-এ রূপান্তর সচেতনতা-নির্ভর জ্বালানি দক্ষতার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। একইভাবে ভোক্তারা দক্ষ এয়ার কন্ডিশনারও গ্রহণ করছেন।
শফিকুল আলম বলেন, বাজারে ন্যূনতম জ্বালানি কর্মদক্ষতা মানদণ্ড সম্পর্কে তথ্যের অসাম্য থাকায়, জ্বালানি দক্ষতার লেবেল কার্যকর করা হলে, তা জ্বালানি দক্ষ যন্ত্রপাতি ব্যবহারে লোকজনকে আকৃষ্ট করবে ।”
তিনি আরও বলেন, এলইডি-এর মতো সহজলভ্য সাশ্রয়ী প্রযুক্তির ব্যাপক গ্রহণ এবং কিছু শিল্পে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সত্ত্বেও, শিল্পখাতে মোটর, মোটরচালিত সিস্টেম ও ক্যাপটিভ জেনারেটরে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং গ্যাস থেকে ইলেকট্রিক বয়লারে রূপান্তরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একইভাবে, বাণিজ্যিক খাতে—যেখানে এসি এর চাহিদা বেশি—জ্বালানির ব্যবহার কমাতে লেবেলিং ও প্যাসিভ ডিজাইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
এলইডি বাতির আমদানিকৃত যন্ত্রাংশের ওপর প্রায় ৬২% শুল্ক এবং ইনভার্টারযুক্ত কম্প্রেসরের ক্ষেত্রে উচ্চ ন্যূনতম আমদানি শুল্ক থাকায়, প্রতিবেদনে সরকারকে এসব শুল্ক কমানোর আহ্বান জানানো হয়েছে—যাতে মূল্য-সংবেদনশীল ভোক্তাদের জন্য দক্ষ যন্ত্রপাতি আরও সাশ্রয়ী হয়।
গত এক দশকের অগ্রগতির ভিত্তিতে প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে:
- নিয়মিত কর্মসূচির মাধ্যমে দেশব্যাপী জ্বালানি দক্ষতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো।
- বড় জ্বালানি ভোক্তাদের (Designated consumers) পরিসর বাড়ানো এবং তাদের জন্য জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ।
- নতুন ভবনে প্যাসিভ ডিজাইন উৎসাহিত করতে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ কার্যকরভাবে প্রয়োগ, যাতে প্রচুর বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় এমন যন্ত্রপাতি যেমন এয়ার কন্ডিশনার কম ব্যবহৃত হয় ।
- জ্বালানি দক্ষতা প্রকল্পের সব চ্যালেঞ্জ — জ্বালানি সাশ্রয়ের সুযোগ খোঁজা, ব্যবসায়িক মডেল তৈরী, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, অর্থায়নের প্রবাহ নিশ্চিতকরণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ—ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সুপার এনার্জি সার্ভিস কোম্পানি (ESCO) প্রতিষ্ঠা।
- জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির প্রকল্পের জন্য স্বল্পমূল্যের অর্থায়ন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংক-সমর্থিত সহজলভ্য অর্থায়নের সুযোগ তৈরী করা ।
শফিকুল আলম বলেন, “জ্বালানি দক্ষতা শুধুমাত্র খরচ বাঁচানোর বিষয় নয়; এটি দ্রুত জাতীয় জ্বালানি ব্যবস্থাকে রূপান্তর করতে পারে। তবে এ জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা, জ্বালানি ভোক্তা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি সরবরাহকারীদের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।”