মেট্রোরেল উদ্বোধনী যাত্রার জন্য প্রস্তুত

২৮ ডিসেম্বর দেশ প্রথম মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐ দিন মেট্রোরেল চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই যাত্রা শুরু করতে করছে মেট্রোরেলের আংশিক অপারেশন। বিদ্যুতচালিত এই রেল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে ২৯ ডিসেম্বর থেকে। পুরুষ চালকদের সঙ্গে অন্তত ছয় জন নারী চালক এই ট্রেন চালাবেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক।

তিনি বলেন, “মেট্রোরেল উদ্বোধনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সবগুলো ট্রেন চালানোর জন্য পর্যাপ্ত চালক নিয়োগ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে পাঁচ-ছয় জন নারী সদস্যও আছেন, তাদের প্রশিক্ষণও আমরা শেষ করেছি।

উদ্বোধনের দিন মেট্রেরেলের প্রথম যাত্রী হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর দায়িত্ব পেলে সেদিন ট্রেন চালানোর প্রস্তুতি নিয়ে রাখার কথা জানিয়েছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) থেকে কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে মেট্রোরেলের চালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মরিয়ম আফিজা।

গত বছরের ২ নভেম্বর চালক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। টানা এক বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকা চালক হিসেবে নিজেকে তৈরি করার কথাও তিনি জানিয়েছেন।

ইতোমধ্যে মরিয়ম আফিজা চট্টগ্রামের হালিশহরে রেলওয়ের ট্রেনিং একাডেমিতে দুই মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকায় ফিরে আরও চার মাস প্রশিক্ষণ নেন। বর্তমানে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেলের ডিপোতে কারিগরি ও প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সেখানে মেট্রোরেলের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জাপানের মিতসুবিশি-কাওয়াসাকি কোম্পানির বিশেষজ্ঞরা ট্রেন পরিচালনার কারিগরি ও প্রায়োগিক নানা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

ঢাকার মেট্রোরেলে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি

স্বপ্নের মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। জাপানের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে রাজধানীর এই মেট্রোরেলে, যা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম। এমনকি সেই প্রযুক্তি জাপানেও নেই।

জাইকার চিফ রিপ্রেজেন্টেটিভ ইচিগুচি টমোহুদি জানিয়েছেন, বিদ্যুতচালিত এই ট্রেনের সঙ্গে থাকছে ব্যাটারি ব্যাকআপ। যেটাকে বলা হচ্ছে এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম।

তিনি জানান, যদি কোনো কারণে বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ হয়ে যায়, তখন ট্রেনকে পরবর্তী স্টেশন পর্যন্ত টেনে নেবে এই প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। এছাড়াও এই ট্রেনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা জাপানেও নেই।

একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে ট্রেনে। যা শুধু বগির ভেতর নয়প্ল্যাটফর্ম ও স্টেশনের ওপরও নজর রাখবে।

প্রথম মেট্রো লাইন উত্তরা-মতিঝিল কেন

দেশের প্রথম মেট্রো লাইনে এই দুই বিপরীতধর্মী এলাকাকে কেন যুক্ত করা হলোজানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হকের কাছে। তিনি মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পেরও উপদেষ্টা।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘উত্তরা থেকে আগারগাঁও হলো মেট্রোরেলের উত্তর করিডোর, যার এক প্রান্ত শুধুই আবাসিক এলাকা। উত্তরা, পল্লবী, শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া; এগুলো পুরোপুরি আবাসিক এলাকা। এরপর শুরু হয়েছে অফিসপাড়া। আগারগাঁও, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, পল্টন ও মতিঝিল বিরাট বাণিজ্যিক ও অফিসকেন্দ্রিক এলাকা। এসব আবাসিক এলাকা থেকে ব্যস্ত সময়ে এখান থেকে প্রচুর ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাস আসে। এই যাত্রীদের যদি উপরে উঠিয়ে (মেট্রোরেলে) নিয়ে আসা যায়, তাহলে বিরাট একটি জট কমবে। তাদের মেট্রোরেলে ওঠার আগ্রহ তখনই হবে, যখন তাদের গন্তব্যে অর্থাৎ মতিঝিল অথবা আশপাশের কর্মস্থলে পৌঁছে দিতে পারবো।

মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও চালু করা হয়েছে, এই অংশের কার্যক্রম দিয়েই পুরো মেট্রোরেলের সক্ষমতা যাচাই করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন তিনি। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘উত্তরা থেকে আগারগাঁও এসে যখন অন্য একটি পরিবহনে তাকে যেতে হবে এটা একটা বিরাট অন্তরায় হবে। সে হিসেবে এখন খণ্ডিত অংশে মেট্রো চালিয়ে পরিচালনগত অসুবিধা নির্ণয় ও সমাধান করা যেতে পারে। পুরো দমে চলতে কোথায় পরিচালনগত, কোথায় এনফোর্সমেন্টের ঘাটতি হবে এবং যাত্রীদের নিতে স্টেশনের নিচে প্রচুর রাইড শেয়ার চালকরা আসবেন, তাদের কীভাবে ব্যবস্থাপনা করবেসেই অভিজ্ঞতা হবে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মেট্রোরেল লাইন বরাবর বিশেষ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ও উঁচু ভবন তৈরির অনুমতি দিলে সরকার ও জনগণ উভয়ই লাভবান হতো বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ড. শামসুল হক বলেন, ‘মেট্রো স্টেশনের পাশে আবাসন থাকলে পরিবহনের সময় ও খরচ দুটোই বেঁচে যায়। গাড়ি অতিরিক্ত রাখার আগ্রহ কমে যায়। ফলে রাস্তা বানানোর খরচ বেঁচে যায়। একে বলে ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট। মেট্রোকেন্দ্রিক অফিস আদালত, মেট্রোকেন্দ্রিক সেবা ও আবাসিক এলাকা।

মেট্রোর যাত্রী বহনে বিআরটিসির ৫০ বাস

মেট্রোরেলে চেপে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকা যাওয়া যাবে নির্বিঘ্নেই, তবে খানিক দূরের স্টেশনে পৌঁছানো কিংবা সেখান থেকে গন্তব্যে যেতে শুরু ও শেষের স্টেশনে থাকছে বিআরটিসির ৫০টি দ্বিতল বাস। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে ট্রেন চালুর আগেই বাসগুলো চলাচল শুরু করেছে বুধবার থেকে।

 দিয়াবাড়ি এলাকাটি উত্তরার পশ্চিমাংশে হওয়ায় উত্তরা ও আশপাশের বাসিন্দাদের মেট্রোরেলে চড়তে হলে কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে সেখানে। একইভাবে মেট্রোরেল থেকে নেমেও গন্তব্যে যেতে বাস বা অন্য কোনো পরিবহনের প্রয়োজন পড়বে। আগারগাঁওয়ে নেমে রাজধানীর অন্যান্য অংশে যাওয়ার জন্যও পরিবহনের দরকার হবে। এ প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে যাত্রী পরিবহনে গত ১৭ নভেম্বর বিআরটিসির সঙ্গে চুক্তি করে ডিএমটিসিএল।

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, উত্তরা ও আশপাশের এলাকার যাত্রীদের দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেলের স্টেশনে আনা-নেওয়া করবে বিআরটিসির বাস। একইভাবে আগারগাঁওয়ের যাত্রীদের পরিবহনের জন্যও মতিঝিল থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত বাস সেবা দেবে বিআরটিসি।

মেট্রোর যাত্রীদের শাটল সেবার জন্য দুটি রুট নির্ধারণ করেছে বিআরটিসি। একটি রুটে আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, শাহবাগ, গুলিস্তান হয়ে মতিঝিল যাবে। একইভাবে মতিঝিল থেকে গুলিস্তান, শাহবাগ, কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট হয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত আসা যাবে। আর দিয়াবাড়ি থেকে উত্তরার হাউজ বিল্ডিং বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসা-যাওয়া করবে বিআরটিসির বাস।

বিদ্যুতে চলবে মেট্রোরেল, প্রতিদিন লাগবে ৮০ মেগাওয়াট

উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচলে প্রতিদিন ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। প্রাথমিকভাবে চালু হতে যাওয়া উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত লাগবে ৮০ মেগাওয়াট। যা সরাসরি জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ করা হবে। পাওয়ার গ্রিড অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) মূল তত্ত্বাবধানে ডেসকো, ডিপিডিসি সমন্বিতভাবে মেট্রোরেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, কোনো কারণে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া না গেলে বিশেষ ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে মেট্রোরেলের এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম (ইএসএস) থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে মেট্রোরেলকে নিকটবর্তী স্টেশনে নিয়ে আসা হবে

সার্বিক বিষয়ে মেট্রোরেলের প্রকল্প পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে মেট্রোরেল চলাচল করছে।

‘মেট্রোরেলে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আমরা গ্রিড লাইনের ছয়টি সোর্স থেকে আলাদাভাবে বিদ্যুৎ নিচ্ছি। কাজেই যদি কোনো কারণে সবগুলো গ্রিড ফেল করে, তাহলে মেট্রোরেল পরিচালনায় কিছুটা অসুবিধা হবে। তখন আমাদের যে নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা আছে সেটি দিয়ে আমরা ট্রেনটিকে নিকটবর্তী স্টেশনে নিয়ে আসব। যদি সমস্যাটি দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে ভিন্ন একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।’

সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে মেট্রোরেল চলতে পারবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সৌরবিদ্যুৎ যে পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করে, তার মাধ্যমে মেট্রোরেল চলাচলের উপযোগী না। সোলার পাওয়ারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করাও সম্ভব নয়।

মেট্রোরেল নিয়ে রঙবেরঙ এর আয়োজন পুরোটা দেখতে নিচের লিংক অনুসরণ করুন: https://rangberang.tiny.us/Dec2022

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

15 + 4 =