এবারের বইমেলা

মাহবুব আলম: একুশে বইমেলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। করোনা মহামারির পর এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইমেলার উদ্বোধন করেছেন। অংশগ্রহণ করছে ৪৫৩টি প্রতিষ্ঠান। মেলা কর্তৃপক্ষ বলেছে, গতবারের মতো এবারও মেলার পরিসর ৬ লাখ বর্গফুটের। কিন্তু এই মেলা কেন্দ্র করে ঢাকার বাংলাবাজার সহ বইপাড়ায় যে সাজ সাজ রব দেখা যায় এবার তার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। উল্টো প্রকাশকরা গভীর দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন। এর কারণ, কাগজ সহ প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি। এই মূল্যবৃদ্ধি শতকরা ২০০ থেকে ৩০০ ভাগ। ফলে প্রকাশনা শিল্পের গত কয়েক বছরের সংকট এবার তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রকাশকদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। ম্লান মুখে প্রকাশকরা মেলার মাঠে স্টল সাজিয়ে বসে আছে। চীনা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, যদি মুখে হাসি না থাকে তাহলে দোকান খুলতে যেও না।

এখানে উল্লেখ্য ২০২০ এ করোনার জন্য প্রকাশকরা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হন। ২০২২ এ দেরিতে হলেও মাসব্যাপী মেলা হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারির মেলা মার্চের শেষ পর্যন্ত টেনে নেওয়ার পরও কোনো সুফল মেলেনি। কারণ বইমেলার ঐতিহ্য ও রীতিনীতি অনুযায়ী দেখা গেছে এই মেলা ফেব্রুয়ারির পর জমে না। প্রকৃতপক্ষে একুশে ফেব্রুয়ারির পর মেলা কার্যত ভাঙা হাটে পরিণত হয়। অন্যদিকে মেলাকে কেন্দ্র করে ন্যূনতম সরকারি সহায়তা নেই। এমনকি গত মেলার আগে খোদ সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ প্রকাশকদের আর্থিক সংকট বিবেচনা করে স্টল ভাড়া অর্ধেক করার জন্য বাংলা একাডেমিকে অনুরোধ করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর অনুরোধ মানে নির্দেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, বাংলা একাডেমি মন্ত্রীর এই নির্দেশ কার্যকর করেনি। ফলে এই সময় যারা স্টল ভাড়া অর্ধেক দিয়েছিল বাংলা একাডেমি সেই ভাড়ার বাকি অর্ধেক টাকা পরে আদায় করে। একেবারে বেনিয়াগিরি। এমনিতেই বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলার স্টল ভাড়া তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। এর কারণ বাংলা একাডেমি এটাকে সেবা হিসেবে নয় বাণিজ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এবং এই বাণিজ্যের ধরন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ছাড়িয়ে গেছে।

এক্ষেত্রে বলা দরকার, আমরা বলছি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করতে হবে। অথচ এই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে ভ্যাট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতীতের এই মেলায় মূল ভাড়ার উপর ভ্যাট ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে কর্তৃপক্ষ ভ্যাট চালু করেছে।

এছাড়াও বাংলা একাডেমির পুরো আচরণের মধ্যেও সেবা নয় ব্যবসার মনোবৃত্তি কাজ করে। এখানে বলার দরকার দিনকে দিন পাঠক কমছে, কমছে বইয়ের বেচাকেনা সেখানে কর্তৃপক্ষ একেবারে নির্বিকার। মেলায় শেষ দিনে বাংলা একাডেমি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা দিয়ে বলে, মেলায় এত টাকা বিক্রি হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এর জন্য কর্তৃপক্ষ কি করেছে বা করছে। কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলেই সংগঠিত করে ঢাকা মহানগরী ও এর আশেপাশের স্কুল ছাত্রদের মেলায় নিয়ে আসতে পারে। এর জন্য একটা বাসের দরকার। খুব বেশি নয়। কিন্তু কোনো উদ্যোগ নেই এ বিষয়ে। আমাদের প্রতিবেশী দেশে কলকাতা সহ বিভিন্ন বইমেলায় দূরদূরান্ত থেকে স্কুল ছাত্রদের সংগঠিত করে মেলায় আনা হয়। সেই সাথে বিশেষ বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হয়। করা হয় উন্মুক্ত ও যৌক্তিক কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। অথচ এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ একেবারে নির্বিকার।

এবার আসা যাক, লেখক পাঠকের বিষয়। লেখক পাঠকরা নিঃসন্দেহে উন্মুখ হয়ে আছেন। বিশেষ করে লেখকরা। কিন্তু তাদের চোখে মুখে এখন হতাশার ছাপ। কারণ কাগজ সহ প্রকাশনা উপকরণের মূল্য বৃদ্ধিতে এবার অধিকাংশ প্রকাশক নামমাত্র বই প্রকাশ করবে। পুরনো বইয়ের পুনঃমুদ্রণ হবে না। চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশনীর মালিক জামাল উদ্দিন বলেছেন, তিনি ৭০ থেকে ৮০টি বই প্রকাশ করেন। এবার তার পক্ষে ১৭ থেকে ১৮টির বেশি বই প্রকাশ সম্ভব হবে না। আর যদি ধার দেনা করে অধিক বই প্রকাশ করি তাতে লাভ হবে না। কারণ বইয়ের দাম দ্বিগুন হয়ে যাবে। আর্থিক সংকটের মুখে মানুষ এতো দামের বই কিনতে পারবে না।

শুধু এক বলাকা প্রকাশনী নয় অধিকাংশ প্রকাশনী এই বিষয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে। কোনো কোনো প্রকাশনা সংস্থা তো এমনও বলেছে এবার তারা কোনো নতুন বই প্রকাশ করবে না। এ বিষয়ে অনেক প্রকাশক রীতিমতো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রকাশ্যে জানান দিয়েছে। এমনি এক স্ট্যাটাসে অনার্য পাবলিকেশন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক রহমান বলেছেন, এবারের বই মেলা নিয়ে আমি বেশ আরাম বোধ করছি। ‘শফিক আমার বই কতদূর’ এই প্যারা থেকে এবার আমি মুক্ত। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই এবারের বইমেলা হচ্ছে নিষ্প্রাণ।

এখানে বলার দরকার ২০২০, ২১ ও ২২ এর বইমেলায় আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এবার। কিন্তু সবকিছু শেষ করে দিল বা দিচ্ছে আমাদের দেশের বাজার সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেট কাগজ, বোর্ড, মুদ্রণ প্লেট সহ প্রকাশনা শিল্পের উপকরণ আমদানি, উৎপাদন ও বেচাকেনা করে।

এ বিষয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার সংকটের কথা বলা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে আমাদের অর্থনীতিতে। নিঃসন্দেহে ডলার সংকট রয়েছে। কিন্তু কতটা, এ প্রশ্নের জবাব দেবে কে।

সবচাইতে বড় কথা আমরা যখন জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের কথা বলি, দেশ গড়ার কথা বলি, তখন একটুও ভাবি না সেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য বিনিয়োগ দরকার। বিনিয়োগ ছাড়া জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের ফাঁকা বুলি শুনতে শুনতে দেশের মানুষের কান পচে গেছে। আমি ও আমরা আশা করব, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, ব্যক্তি-গোষ্ঠী ও সরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। আমি নিশ্চিত সেই পদক্ষেপ নেওয়া হলে প্রকাশকরা অবশ্যই সরকারি প্রণোদনা পাবেন। যেমনটি পান গার্মেন্টস মালিকসহ বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো। এবং তা যে সরকারি প্রণোদনা এটা নিশ্চয়ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন নেই। তারপরও বলছি, দেশে করোনা শুরু হলে এক মাসেও কম সময়ের মধ্যে গার্মেন্টস মালিকরা শুরুতেই দশ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা লাভ করেন। অন্যদিকে প্রকাশকদের মেলার স্টল ভাড়া অর্ধেক করার দাবি উপেক্ষিত হয়। এবার দাবি উঠেছিল স্টল ভাড়া সর্বোচ্চ ১০ হাজার বেশি না করার। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আর শুনবেই বা কেন। বাংলা একাডেমি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো মাস গেলেই বেতন পাবেন। তারা কেন বাড়তি ঝামেলা করবেন।

অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। এটাই আমার বাংলাদেশ। এটাই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × 2 =