‘হুর নুসরাত’ আমাকে একটা পরিচয় দিয়েছে

নাহিন আশরাফ: ফেনী শহরের মেয়ে নুসরাত আক্তার লোপা। মফস্বলের খুব সাধারণ একটি পরিবারে বেড়ে ওঠা তার। ভাই-বোনদের মধ্যে তিনি সবার বড়, তাই দায়িত্বের বোঝাটাও ছিল সবচেয়ে বেশি। পরিবারের সকল দায়িত্ব পালন করতে হতো। তাই ছোটবেলাটা অন্যদের মতো হইচই করে কাটানোর সুযোগ হয়নি।

উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন ফেনীতে, এরপর দুচোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসেন ঢাকাতে পড়ালেখা করতে। ঢাকায় এসে ভর্তি হন লালমাটিয়া মহিলা কলেজে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করতে। কিন্তু এই বিষয়টা তিনি উপভোগ করতেন না। কোনো উপায় ছিল না তাই এই বিষয় নিয়েই পড়ালেখা করতে হয়। প্রথমবর্ষে থাকা অবস্থায় পরিবারের ইচ্ছায় তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিয়ের পর তিনি থেমে যাননি। তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যান। পড়ালেখা শেষ করেন। কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার প্রতিনিয়ত মনে হতো আমি আসলে কি করছি, আমার স্বপ্ন তো আরো বড় ছিল।

প্রথমে নুসরাত আক্তার লোপার স্বপ্ন ছিল কর্পোরেট চাকরি করার। তিনি টেলিকম কোম্পানি গ্রামীণফোনে চাকরিও পান। কিন্তু কিছুদিন পরে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে গৃহিনী হয়ে যান। এই জীবন মেনে নিতে না পেরে তিনি বিষণ্ন থাকেন বেশ কিছুদিন। সময় কাটাতে তিনি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের নানা বিষয়ের উপর অনলাইনে কোর্স করেন। কোর্স করে তিনি অনুপ্রেরণা পান। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে একটা পেইজ খুলেন। নুসরাত আক্তার লোপা মনে করেন এই পৃথিবীর প্রতিটি মেয়েই হুর তাই তিনি পেইজের নামকরণ করেন হুর এবং তার পাশে নিজের নাম বসিয়ে দেন। জন্ম নেয় ‘হুর নুসরাত’ প্রতিষ্ঠানটি।

পোশাকের প্রতি তার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই। ছোট ভাইবোনদের পোশাক ডিজাইন করে দিতেন। বিয়ের পর স্বামীর পাঞ্জাবির ডিজাইনও তিনি করতেন। এইসব ডিজাইন সবার বেশ প্রশংসা কুড়াত। সেই থেকেই তার আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়। শুধু সাহস ছাড়া তার কাছে কিছুই ছিল না। পেইজ খোলার সময় তার বিনিয়োগ ছিল মাত্র ১২০০ টাকা। প্রথমে পেইজের জন্য নিজের ডিজাইন করা দুইটি কুর্তি নিয়ে আসেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার সাথে সাথে তিনি সেই কুর্তির ২৪টি অর্ডার পান। তখন নিজের প্রতি বিশ্বাস ও কাজের প্রতি আগ্রহ দুটোই আরো বেড়ে যায়।

হাঁটি হাঁটি পা করে ‘হুর নুসরাত’ এগিয়ে যেতে থাকে। এগিয়ে চলার পথ মসৃণ ছিল না। নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়। নুসরাত আক্তার লোপা ব্যাক্তিজীবনে খুব সহজ সরল হওয়াতে তার স্বামী ও পরিবারের সদস্যরা প্রথমে তাকে খুব একটা সহযোগিতা করেনি। কারণ তারা তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল যে, বাইরের এই কঠিন পৃথিবী তিনি সামলাতে পারবেন কি না। কিন্তু তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি, কাজ করেছেন নিজের স্বপ্ন নিয়ে। অনেক হতাশা আর মন খারাপের দিন কেটেছে তারও। ক্লান্ত হয়ে মাঝে মাঝে কেঁদেও ফেলতেন, তাও তিনি কখনো ভেঙে পড়েননি। চলার পথে একবার হোঁচট খেলে দশবার উঠে দাঁড়িয়েছেন, সাহস দিয়েছেন নিজেকে।

শূন্য থেকে শুরু করা ‘হুর নুসরাত’র রয়েছে এখন লাখো ভক্ত। সোশ্যাল মিডিয়াতে নুসরাত আক্তার লোপাকে আইকন হিসেবে দেখেন অনেকে তরুণী। নিজের নির্মিত পোষাকের পাশাপাশি সমানতালে নিজেও জনপ্রিয়। সকলের মাঝে তিনি নিজের সুন্দর বাচনভঙ্গি ও ব্যবহার দিয়ে সবার প্রিয় হয়ে উঠেন।

নুসরাত আক্তার লোপা জানান, হুর নুসরাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে সবার কাছে দেশি পোশাক পৌঁছে দেওয়া। তিনি খেয়াল করেন যে দেশি পোশাক ধীরে ধীরে সবার মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন দেশি পোশাককে বাঁচিয়ে রাখতে, এতে তার অনেক কাঠকয়লাও পোড়াতে হচ্ছে। কারিগরদের খুঁজে খুঁজে নিখুঁত সব কাজ করানো হয়ে থাকে। লোপা বরাবরই দেশি জিনিসের ভক্ত। তিনি নিজেও সুতির শাড়ি, জামদানি, মসলিন শাড়ি পরতে ভালোবাসেন। তিনি মনে করেন যারা দেশি পোশাক নিয়ে কাজ করেন তাদের কাজ সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং।

নুসরাত আক্তার লোপা আরও বলেন, মেয়েরা যত বড় চাকরি করুক কিংবা ব্যবসা করুক দিন শেষে ঘরে ফিরলে তারা একজন স্ত্রী এবং একজন মা। তাই সব কাজ শেষে ঘরে ফিরেও তাদের নতুন দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। আমি দুই সন্তানের মা। হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও আমি সন্তানদের সময় দিতে ভুলি না। ঘরে ফিরে তাদের নিজের হাতে খাইয়ে দেই। তাদের পড়াশোনা ও ব্যাক্তিজীবনের সব ধরনের খোঁজ নেই। সন্তানদের সাথে আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো। বর্তমানে তার বড় সন্তান কানাডার সায়নফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ছোট মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। ছেলেকে কাছে না পাওয়ায় তার প্রায় সময়ই বিষণ্নতায় কাটে। আর এই বিষন্নতার সময় তার পাশে থাকেন তার মেয়ে। তার সাথে খুনসুটি ও গল্প করে তিনি ক্লান্তি অনেকটা ভুলে যান।

নিজের দোষ বলতে গিয়ে নুসরাত আক্তার লোপা বলেন, তার ধৈর্য অনেক কম এবং ভীষণ আবেগী। খুব অল্পতেই তার চোখে পানি চলে আসে। তিনি পরিবারের সবার জন্য নিজের হাতে রান্না করতে ভালোবাসেন। অনেক কাজের ফাঁকেও তিনি রান্নার জন্য সময় বের করে নেন। এছাড়া তার গাছের শখ। অবসর পেলেই তিনি তার ছাদে গাছের সাথে সময় কাটান। এতো কাজের মাঝে চাপ কমানোর জন্য তিনি যখন যা ইচ্ছে হয় করেন। নুসরাত আক্তার লোপা বলেন, মানুষের গান গাইতে ইচ্ছা করলে তা করা উচিত কিংবা নাচতে ইচ্ছা করলেও নাচ করা উচিত। নিজের সব ইচ্ছাই পূরণ করা উচিত, এতে কোনো অন্যায় নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে কারো ক্ষতি যাতে না হয়। তিনি নিজেকে খোলা বই বলে দাবী করেন, কারণ তিনি তার রাগ অভিমান সুখ আনন্দ সব মানুষের কাছের প্রকাশ করেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেকে নিয়ে লিখতে তার ভালোলাগে, এতে তার মন হালকা হয়।

তার পেইজের বেশিরভাগ শাড়ির মডেল তিনি নিজেই। কারণ ‘হুর নুসরাত’র পাশাপাশি নুসরাত আক্তার লোপার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। নিজের পণ্য যেহেতু তিনি নিজেই উপস্থাপন করেন তাই নিজেকেও রাখতে হয় পরিপাটি। নিজেকে ফিট রাখতে তিনি চেষ্টা করেন প্রতিদিন ব্যায়াম করতে ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে। নুসরাত আক্তার লোপা বলেন, ‘হুর নুসরাত’ নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। কারণ ‘হুর নুসরাত’ তাকে একটা পরিচয় দিয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসা দিয়েছে। তিনি দেশ ও দেশের বাইরে হুর নুসরাতকে ছড়িয়ে দিতেন চান। তিনি কখনো একা বড় হতে বিশ্বাসী না, তিনি চান তার হাত ধরে আরো মানুষ স্বাবলম্বী হোক। তিনি সর্বক্ষণ নতুন যারা কাজ করছে বা করতে চায় তাদের পরামর্শদাতা হয়ে পাশে থাকেন ও তাদের সঠিক পথ দেখান।

নতুন যারা উদ্যোক্তা হতে চান তাদের তিনি বলেন, যদি পণ্য সম্পর্কে ধারণা না থাকে তাহলে এই পথে না আসাই ভালো। যেকোনো পেশা বেছে নেওয়ার আগে ভাবতে হবে আমি আসলে কোন কাজটা ভালোবাসি। কাজকে ভালোবাসলে সফলতা পাওয়া বেশ সহজ যায়। তিনি আরো বলেন, জনগণের জন্য কাজ করতে চাইলে চামড়া অনেক মোটা করতে হবে। কারণ অনেকেই আশপাশ থেকে ইট পাথর মেরে রক্তাক্ত করা চেষ্টা করবে। সেসব কিছু সামলে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। নুসরাত আক্তার লোপা মনে করেন কাজের কোনো ছেলে মেয়ে নেই। ইচ্ছাশক্তি থাকলে যে কেউ যেকোনো কাজ করতে পারে। তাও মেয়েদের যেন সব কিছুতেই বাধার সম্মুখীন হতে হয়, মেয়েদের যেকোনো স্বপ্ন দেখার আগেও ভাবতে হয়। তিনি বলেন, মেয়েদের আলাদা কোনো সুবিধা দিতে হবে না শুধু চলার পথে বাধা না দিলেই একটা মেয়ে বহুদূর যেতে পারবে। আজকের নুসরাত আক্তার লোপা সম্পূর্ণ অবদান তার নিজের, তিনি নিজেকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন চলার পথে, তিনি শুধু জানতেন থেমে যাওয়া যাবে না। এটাই তার সফলতার চাবি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে ক্লিক করুন: এন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

18 − 12 =