‘ফ্যাশন বাবু’ মনিরা ইমদাদ

নাহিন আশরাফ: ছোটবেলা থেকেই তার পারফেকশন থাকা চাই সবকিছুতে। বাবা তাকে ‘ফ্যাশন বাবু’ বলে ডাকতেন। মনিরা ইমদাদের শৈশব কেটেছে কুমিল্লা শহরে। শৈশব থেকেই পোশাকের ব্যাপারে সচেতন তিনি। বাড়িতে মায়ের সেলাই মেশিন থাকায় নিজে ডিজাইন করে পোশাক বানাতেন। ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা থেকে সমাজকল্যাণ বিষয়ে বিএ পাস করেন মনিরা ইমদাদ। এরপর বসলেন বিয়ের আসরে। স্বামী ইমদাদুল হক ছিলেন প্রকৌশলী। বিয়ের পর স্বামী তাকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন একটি কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেন। তারপর বেইলি রোডে একটি টিনের ঘরে ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসাও শুরু করেন তিনি। কিন্তু তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। স্বামীকে জানালেন ভাবনার কথা।

একদিন টাঙ্গাইলে বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি, সময়টা ১৯৮০ সাল। গাড়ি তখন পাথরাইল ইউনিয়ন দিয়ে যাচ্ছিল। তার চোখ আটকে গিয়েছিল তাঁতিদের দিকে। গাড়ি থামিয়ে তাঁতিদের গ্রাম ঘুরে শাড়ি বুনন দেখেন তিনি। সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি কাজ করবেন তাঁতশিল্প নিয়ে। স্বামীকে বলেন, আমি তাঁতিদের নিয়ে কাজ করতে চাই। আমার উপর বিশ্বাস রাখো, আমি ভালো করব। স্বামী বিশ্বাস রেখেছিলেন বলে আজ বৃহৎ একটা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা হতে পেরেছেন তিনি তা অকপটে স্বীকারও করেন। স্বামী ৩০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন শুরুতে। তারপর তিনজন তাঁতিকে সঙ্গে নিয়ে ১৩০টা শাড়ি দিয়ে ১৯৮২ সালের কোন এক রৌদ্রস্নাত দিনে শুরু হয় ‘টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির’র যাত্রা। শতাধিক শাড়ি বিক্রি হওয়ার পর তাঁতের শাড়ি নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার উৎসাহ পেলেন। মনিরা ইমদাদের হাত ধরে এভাবেই তাঁতের শাড়ি ঢাকায় জায়গা করে নিয়েছে। স্বামী ইমদাদুল হক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১১ সালে মারা যান।

টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের যাত্রা শুরু হওয়ার পর প্রায়ই স্বামী আর সহকারীকে নিয়ে ছুটে যেতেন তাঁতিদের কাছে। দিনে দিনে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী খ্যাত পাথরাইল ইউনিয়নের তাঁত শাড়ি উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মানুষরা তার আপন হয়ে উঠে। কাজ করতে গিয়ে একটা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি বারবার। টাঙ্গাইলের তাঁতিরা শাড়ি বানাতেন ঠিকই তবে তারা সময়োপযোগী ডিজাইন, রঙ, নকশা বুঝতেন না। ফলে তিনি নিজেই তাঁতিদের ডিজাইন দিতে লাগলেন। প্রথমে তিনি শুধু তাঁতের শাড়ি আনতেন। তখন দেশি শাড়ির এতো ভালো শো-রুম ছিল না, তাই বেশ সাড়া পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, এক পহেলা বৈশাখে আমার কর্মচারী ফোন করে বলে, দিদিমনি দোকানে তো কোনো কাপড় নাই! আমার চোখ কপালে উঠে যায়। আমি ভাবি, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলো নাকি। ছুটে এসে দেখি সব শাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে! তখন আমি আমি বুঝতে পারি ঢাকায় দেশি শাড়ির চাহিদা কত।

ধীরে ধীরে মনিরা ইমদাদের টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির বড় হতে থাকে। একটি, দুটি করে এখন টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের ছয়টি শো-রুম। প্রথম বেইলি রোডে তারপর শান্তিনগরের ইস্টার্ন প্লাজাতে দ্বিতীয় শো-রুম। প্রথমে শুধু তাঁতের শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করলেও ধাপে ধাপে জামদানি, বেনারসি, মনিপুরি সহ আরো হরেক রকমের শাড়ি শোভা পায় এখানে।

বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান দেশি শাড়ি নিয়ে কাজ করছে। এখন কেমন চাহিদা রয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের জানতে চাইলে মনিরা ইমদাদ বলেন, এখন অনেকেই কাজ করছেন। কিন্তু মান ধরে রাখতে আসলে সবাই পারছেন না। কয়টা মানুষ তাঁতিদের নিয়ে কাজ করছে এই প্রশ্ন রয়েই যায়। আমি চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত মান ধরে রাখতে। সকলের সঙ্গে আমার পার্থক্য এখানেই।

দেশের বৃহত্তর ফ্যাশন হাউজের প্রধান কর্মকর্তা তিনি। হাজারো মানুষের আয়ের উৎস টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। এখন অবশ্য তার ছেলে-মেয়েরা নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু একটা সময় ছেলে-মেয়ে, স্বামী-সংসারসহ এতো বড় প্রতিষ্ঠান তার একা সামলাতে হতো। কিভাবে পারতেন? তিনি জানান, আমি সব সময় পরিবারকে প্রাধান্য দিয়েছি। যখন শাড়ির জন্য টাঙ্গাইল যেতাম তখন ছেলেকে সাথে করে নিয়ে যেতাম। তাছাড়া আমার স্বামী আমাকে বন্ধুর মতো সবসময় সহযোগিতা করেছে। ছেলে-মেয়ে দু’জনেই এখন আমেরিকা প্রবাসী। তিনি ঘুরতে ভালোবাসেন। বিশ্বের নানা অঞ্চলে ঘুরেছেন স্বামী আর বন্ধুদের সঙ্গে। বর্তমানে একাকী সময় কাটে বেইলি রোডে অফিসের উপরের নিজ বাসভবনে। অবসরে ছুটে যান কুমিল্লায় মা’কে দেখতে।

তিনি কখনো অন্যায় মেনে নিতে রাজি নন। নিজের প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মচারীর সাথে তার সুসম্পর্ক। স্নেহ আর শাসন নিয়ে তিনি সবসময় তাদের পাশে আছেন। তিনি একটি ঘটনা জানান, এখানে কদবানু নামে একটা মেয়ে কাজ করে। তার স্বামী তাকে অত্যাচার করতো। টাকা যা আয় করতো স্বামী সব কেড়ে নিতো। একবার কদবানু এসেছে কাজের টাকা নিতে। তার স্বামী বাইরে অপেক্ষা করছে। আমি যেহেতু জানতাম ব্যাপারটা, তাই আমি ইচ্ছে করে অর্ধেক টাকা দেই কদবানুকে। আমি ওকে বললাম, বাকি টাকা তুই পরে নিয়ে যাস। সে টাকাটা নিয়ে বের হবার সাথে সাথে তার স্বামী তাকে মারধোর শুরু করে। স্বামীর অভিযোগ কেন সে পুরো টাকা নিয়ে আসলো না। এরপরে মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে আবার আমার কাছে আসে। আমি এটা সহ্য করতে না পেরে দোকান থেকে বের হয়ে তার স্বামীর কাছে যাই এবং আমার পায়ের স্যান্ডেল খুলে তাকে ছুড়ে মারি। তার এতো বড় সাহস কিভাবে হয়। যারা এখানে কাজ করে তারা সবাই আমার মেয়ে। আমার মেয়ের গায়ে কেউ হাত দিলে আমি তা মেনে নিব না।

আজকাল দেখা যাচ্ছে দেশি শাড়ির চাহিদা কমছে। মানুষ ঝুঁকছে ভারতীয়, পাকিস্তানি পোশাক বা ডিজাইনের দিকে। দুঃখ ভরা কণ্ঠে মনিরা ইমদাদ বলেন, এই শিল্প-ঐতিহ্য আর কতদিন টিকে থাকবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান। মানুষের রুচির পরিবর্তন আসছে। উৎসবে-পার্বণে একটা দেশি শাড়ি রাখা উচিত, বিয়ের কেনাকাটায় থাকুক একটা জামদানি শাড়ি। তাহলে তাঁতিরা বেঁচে থাকতে পারবে। এখন অনেকেই দেশি পোশাক নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তাদের উদ্দেশ্যে মনিরা ইমদাদ বলেন, প্রথমে কাজকে ভালোবাসতে হবে। আমি কাজ ভালোবাসতে পেরেছিলাম বলেই আজ এই অবধি আসতে পেরেছি। নারীরা যদি চায় তারা সবই করতে পারে। ঘরে-বাইরে তারা দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সফল হতে পারে।

মনিরা ইমদাদ নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করেন। কারণ তিনি এমন একটা বিষয় নিয়ে কাজ করছেন যার মাধ্যমে মানুষের বিশেষ দিনের সাক্ষী হতে পারেন। কারো বিয়ে, কারো বিবাহবার্ষিকী কিংবা ফাগুন-বৈশাখ। প্রতিটি নারীর শাড়ির একটা গল্প থাকে। প্রতিটি শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে থাকে আবেগ আর মায়া। সেই মায়ার অংশ ‘টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির’। এটা ভাবলে মনিরা ইমদাদ আবেগি হয়ে পড়েন। এটি তার জীবনের বড় প্রাপ্তি।

বাকের ভাই খ্যাত অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর প্রায়ই ঘুরে ঘুরে শাড়ি দেখেন বলে জানালেন দোকানের এক কর্মকর্তা। ৮০-৯০ দশকের জনপ্রিয় সব তারকারা এখানে আসেন শাড়ি কিনতে। সুর্বণা মুস্তাফা, সারা জাকের, দিলারা জামান সহ নাটক-চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেক পরিচিত মুখের আনাগোনা এই দোকানে। ভারতের কিংবদন্তি গায়িকা আশা ভোসলে আশির দশকে বাংলাদেশে এসে ঘুরে গিয়েছেন বেইলি রোডের শো-রুম। টালিউডের বুম্বাদা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বাংলাদেশে এসে স্ত্রীর জন্য এক ডজন শাড়ি কিনে নিয়ে যান।

মনিরা ইমদাদ তার কাজের জন্য ‘বিচিত্রা পুরস্কার’, ‘অনন্যা শীর্ষ দশ সম্মাননা’, ‘শেল্টেক্’, ‘ইন্ডিয়া অ্যাওয়ার্ড’, ২০০৪ সালে ইউনেসকো আয়োজিত হ্যান্ড স্কার্ফ প্রতিযোগিতায় ও ২০১৪ সালে ‘সিল অব এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ সহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ক্র্যাফট কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি থাকাকালীন বাংলা একাডেমি, ডিজাইনার বিবি রাসেলসহ বিভিন্ন জনের সহযোগিতায় তারা বাংলাদেশের জামদানিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণার জন্য ইউনেসকোতে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে জামদানিকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো, ঐতিহ্যবাহী নকশা ও বুননের কারণে।

আশির দশকে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির আমাদের পরিচয় করায় তাঁতশিল্পের সাথে। ঈদ, পূজা, বৈশাখ কিংবা বিয়ে যেকোনো আয়োজনেই বাঙালির মাথায় প্রথম আসে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের কথা। বারোশো টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা দামের শাড়ি পাওয়া যায় এখানে। তাঁত বা টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির বা মনিরা ইমদাদের নাম অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকবে আরও বহু বছর।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × 5 =