আমাদের দরকার অনেক পলান সরকার

মাসুম আওয়াল: ‘একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন, বইকে ভালোবেসে, বই পড়াতেন হেঁটে হেঁটে ঘরের কাছে এসে। কোথায় আছেন কেমন আছেন আপনাকে খুব দরকার, একটু হাঁটেন আমার সাথে, আসেন পলান সরকার।’ ছন্দে বোনা এই কথাগুলোর সঙ্গে আপনিও একমত হবেন হয়তো। আমাদের গর্ব, একজন পলান সরকারকে পেয়েছিলাম। তিনি ছিলেন আলোর ফেরিওয়ালা। স্বশিক্ষিত এই মানুষটি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। দেশের গ্রামীণ জনপদে পায়ে হেঁটে বই পৌঁছে দিতেন তিনি। মানুষকে আলোকিত করার এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন সারাটা জীবন। এমন একজন আলোকিত মানুষের গল্প আমাদের বারবার উজ্জীবিত করে।

হারেজ কে চেনেন
পলান সরকারের বাবা-মা তার নাম রেখেছিলেন হারেজ উদ্দিন সরকার। পলানের এই নামটা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। হারেজ উদ্দিন সরকার নামে না চিনলেও তাকে সবাই চেনেন ঝোলা কাঁধের বই দাদু, পলান সরকার হিসেবে। মা আদর করে ডাকতেন পলান নামে, সেখান থেকেই সবার কাছে পলান সরকার নামে পরিচিত হন তিনি ।

নাটোরের বনলতা, নাটোরের পলান
নাটোর জেলা বিখ্যাত হয়ে আছে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার চরিত্র বনলতা সেনের জন্য। বনলতাকে নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই পাঠকের। তাকে নিয়ে লোকমুখে ছড়িয়ে আছে নানা গল্পকল্প কথা। তেমনই নাটোর নিয়ে কথা হলে পলান সরকারের কথাও মনে পড়ে। রূপকথার গল্প না, আমাদের এই নায়ক বাস্তবের। মানুষ গড়ার কারিগর। ১৯২১ সালের ১ আগস্ট নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার নূরপুর মালঞ্চি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন পলান সরকার। তবে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে নাটোরে ও বাঘায়। নাটোরে বেশ আনন্দে কাটছিল পলান সরকারের শৈশব। কিন্তু সেই আনন্দ থাকে না বেশিদিন। তার পরিবারের উপর দিয়ে বয়ে যায় ঝড়।

বাবা হারালেন পলান সরকার
মাত্র পাঁচ মাস বয়সে পলান সরকারের বাবা হায়াত উল্লাহ সরকার মারা যান। তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তেন পলান। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে মা’য়ের সঙ্গে নানা বাড়ি রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে চলে যান তিনি। পলান সরকারের দাদার নাম ছমির সরকার। তাদের অন্য বংশধররা এখনও বাগাতিপাড়ার নূরপুর মালঞ্চি গ্রামেই বসবাস করেন। পলান সরকারের চাচাত ভাইয়ের ছেলের নাম মামুনূর রশীদ। অধ্যক্ষ মামুনূর রশীদ বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে শুনিয়েছেন পলান সরকারের গল্প। এক গণমাধ্যমে তিনি জানান, নূরপুর মালঞ্চি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পলান সরকারের হাতেখড়ি হয়। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর অর্থনৈতিক সংকটে লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। এরপর তার নানা ময়েন উদ্দিন সরকার, মা মইফুন নেসাসহ পলান সরকারকে বাউসা গ্রামে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে তিনি একটি স্কুলে ভর্তি হন যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণির পর লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে পলান সরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন। কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস থেকে যায় আজীবন।

খাজনা আদায় করতেন পলান
পলান সরকারের নানা ময়েন উদ্দিন সরকার ছিলেন স্থানীয় ছোট জমিদার। নানার কাছে বড় উঠতে থাকেন পলান। এক সময় নানার বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন। যৌবনে পলান সরকার নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন। দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে ১৯৬২ সালে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারীর চাকরি পান। এছাড়া নানার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪০ বিঘা সম্পত্তির মালিক হন পলান সরকার। শুধু এসবের মধ্যেই বন্দি ছিলেন না পলান সরকার। তার শিল্পীমন চাইতো অন্যকিছু করতে। আর পড়ার নেশা কোনোদিন ছেড়ে যায়নি তাকে।

মঞ্চকর্মী পলান
এক সময় মঞ্চকর্মীও ছিলেন পলান সরকার। ব্রিটিশ আমলেই তিনি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। ভাঁড় চরিত্রে অভিনয় করতেন। তিনি যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। অন্যদিকে মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দিতেন। পলানের বলা সংলাপ শুনে মঞ্চে অভিনয় করতেন শিল্পীরা।

উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি
পলান সরকার ছিলেন সকলের কাছে ভীষণ প্রিয়। সমাজসেবা করা ছিল পলান সরকারের নেশা। তার দান করা জমিতেই গড়ে উঠেছে বাউসা হারুন অর রশিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন পলান সরকার। ১৯৬৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় ৫২ শতাংশ জমি দান করার পর প্রচারবিমুখ পলান সরকার স্থানীয়দের অনুরোধে সভাপতি পদে আসীন হন। দীর্ঘদিন এই দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

সবার প্রিয় পলান সরকার
পলান সরকার দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বিলিয়েছেন শিক্ষার আলো। ১৯৯০ সাল থেকে বাউসা হারুন অর রশিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর যারা মেধাতালিকায় থাকতো তাদের মধ্যে প্রথম দশ জনকে বই উপহার দিতেন পলান সরকার। এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও তার কাছে বইয়ের আবদার করলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন; তাদেরও বই দেবেন তবে তা ফেরত দিতে হবে। এরপর গ্রামের মানুষও তার কাছে বই চাইতে শুরু করে। ১৯৯২ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় পলান সরকারকে হাঁটার অভ্যাস করতে হয়। তখনই তার মাথায় এক অভিনব চিন্তা আসে। তিনি স্কুলকেন্দ্রিক বই বিতরণের প্রথা ভেঙে বাড়িতে বাড়িতে বই পৌঁছে দেওয়া এবং ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি তিনি বইও উপহার দেন। এছাড়া যারা তার বাউসা বাজারে থাকা চাল কলের দেনা পরিশোধ করতেন তাদেরও তিনি বই উপহার দিতেন। এলাকার চায়ের দোকানি পর্যন্ত হয়ে ওঠে বইপাগল। বিকালে তার দোকানে বসে বই পড়ার আসর। বই পড়ার আগ্রহ মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন এই গুণী মানুষটি।

পাঠাগার প্রতিষ্ঠা
পলান সরকার এখন এক উদ্দীপনার নাম। বইপ্রেমীদের হৃদয়ে বাস করেন তিনি। ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। পলান সরকারের নিজ বাড়িতে সরকারি ভাবে গড়ে তোলা হয় পলান সরকার পাঠাগার। ব্যবস্থা করা হয় সৌর বিদ্যুতের। যেখানে রাত দিন সব সময় মানুষ আসে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে। তবে পায়ে হেঁটে বই বিলি করাই ছিল তার নেশা। বই ফেরি করতে পলান সরকারের সুবিধার জন্য একটি ভ্যান বানিয়ে দেওয়া হলেও তিনি সেই ভ্যান ব্যবহার করতেন না। এক সময় বয়সের ভারে নুয়ে পড়ার কারণে প্রতিদিন গ্রামে যেতে পারতেন না পলান সরকার। তখন গ্রামে গ্রামে বইপাগল মানুষদের নিয়ে গড়েন কেন্দ্র। যারা বই ভালোবাসেন তাদের বাড়িতে বা দোকানে রাখেন বই। মাঝে মাঝে সেসব কেন্দ্রে যেতেন ছেলের মোটরসাইকেলে চেপে। পুরাতন বইগুলো নিয়ে দিয়ে আসতেন নতুন বই। প্রথমে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মানুষই জানত পলান সরকারের এই শিক্ষা আন্দোলনের গল্প। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি তাকে আলোকিত মানুষ হিসেবে তুলে ধরে। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে পলান সরকারের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অল্পদিনের মধ্যেই সবার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।

অর্জন ও সম্মাননা
বইপড়া আন্দোলনের জন্য সরকার ২০১১ সালে পলান সরকারকে প্রদান করে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘একুশে পদক’। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষ্যে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে বিটিভির জন্য গোলাম সারোয়ার দোদুল নির্মাণ করেন ঈদের নাটক ‘অবদান’। বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সবার মধ্যে বইপড়ার আগ্রহ সৃষ্টির জন্য ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে ‘সাদা মনের মানুষ’ খেতাবে ভূষিত করে।

না ফেরার দেশে পলান সরকার
বাউসা গ্রামের বাড়িতে ২০১৯ সালের ১ মার্চ না ফেরার দেশে চলে যান পলান সরকার। ২ মার্চ নিজগ্রামেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন এই সাদামনের মানুষটি। ২০১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর প্রিয়তমা স্ত্রীর চিরবিদায় হয়তো মেনে নিতে পারেননি প্রায় শতবর্ষী পলান সরকার। পলান সরকার কাজ করে গেছেন এই দেশের মানুষের জন্য, তাদের অন্তরে বইয়ের জন্য ভালোবাসা তৈরি করতে। করেও গেছেন সেই কাজ নিজের সবটুকু দিয়ে। ওপারে ভালো থাকুন পলান সরকার। তার মতো মানুষ গড়ে উঠুক ঘরে ঘরে। কারণ বই না পড়লে কোনো জাতিই আলোকিত হয় না। সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। ওই যে দূর থেকে বই হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে আসছেন কেউ। একটা বই পড়ে শেষ করে আরও একটা নতুন বইয়ের জন্য অপেক্ষা করে আছে খোকা। বই হাতে নিয়ে হেঁটে আসা লোকটা কি পলান সরকার না কি তার পথ ধরে হেঁটে আসছেন অন্য কোনো আলোর মানুষ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × 2 =