তথ্য মানুষকে ক্ষমতায়িত করে বৈষম্য কমায়

স্বপন ভট্টাচার্য

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতিকে জাগ্রত করে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করেন। জনগণকে সকল ক্ষমতার মালিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। সংবিধানে মানুষের সকল মৌলিক অধিকারের সাথে ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার অধিকার তথা তথ্য অধিকারকে নাগরিকের অন্যতম মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। এভাবেই তিনি প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ অর্থাৎ বিশ্বসভার সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটান।

সংবিধানের সে শক্তিতে ভর করে পরবর্তীতে মানবাধিকার কর্মী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, একাডেমিসিয়ান, সুশীল সমাজ, বেসরকারি সংস্থা সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তথ্য অধিকার বিষয়ে আইনের খসড়া তৈরি হয়। ২০০৮ সালে অধ্যাদেশ হয়। ২০০৮ সালেই জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন বৃহৎ দলগুলির মধ্যে কেবল আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি মেনিফেস্টোতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার করে। ২০০৯ এর ২৯ মার্চ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই তথ্য অধিকার আইনটি পাশ করে, গেজেট প্রকাশ ও কার্যকর করে এবং কমিশন গঠন করে। সে থেকে বাংলাদেশে জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তাদের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আইনি স্বীকৃতি পায়। উল্লেখ্য ২০০৫ সালে ভারতে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও কার্যকর হয়। বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ একটি আধুনিক, অনন্য ও প্রাগ্রসর আইন। এই আইনে, জনগণ কর্তৃপক্ষের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে; কর্তৃপক্ষের কাজের, সেবার ও বাজেটের হিসাব চায়; অন্যান্য আইনে কর্তৃপক্ষ জনগণের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে।

আমাদের তথ্য অধিকার আইনটি নিঃসন্দেহে সার্বজনীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। জনগণের তথ্যে প্রবেশাধিকার অন্যান্য সকল মৌলিক মানবাধিকার পূরণে পরশ পাথর। কিন্তু আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা পিছিয়ে পড়া, সুবিধাবঞ্চিত, পঙ্গু/বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধী, অসুস্থ, বিধবা, বৃদ্ধ, চরম দারিদ্র্যপীড়িত, ভাসমান, ঝুঁকিপূর্ণ শিশু ও মহিলা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, নিরক্ষর, তারা মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের নিজের জন্য গৃহীত ও পরিচালিত কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে বুঝার ও প্রয়োগ করার ক্ষমতা, দক্ষতা বা প্রস্তুতি কোনটাই নেই। তাছাড়া তৃণমূল থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তথ্য স্বাক্ষরতার অভাব প্রকটভাবে বিদ্যমান রয়েছে। এ সুযোগে অনেক কর্তৃপক্ষও এ সকল জনগোষ্ঠীর প্রতি কাঙ্খিক্ষত মাত্রায় সংবেদনশীলতা প্রদর্শনের পরিবর্তে তথ্য প্রদান ও প্রকাশে ইচ্ছাকৃত অনীহা প্রদর্শন ও গড়িমসি করে থাকেন। অথচ সংবিধানের মূল কথাই হচ্ছে ‘জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার উৎস এবং প্রজাতন্ত্রের কাজে নিয়োজিত প্রত্যেক ব্যাক্তির কর্তব্য জনগণের সেবার চেষ্টা করা’। এসকল কারণে অনেক বোদ্ধা আমাদের আইনটিকে আধুনিক ও প্রাগ্রসর বলে মনে করেন। আইনের মূল চেতনার সাথে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য বা একে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করার জন্য সাধারণ মানুষ বা কর্তৃপক্ষের কিছুটা সময়ের প্রয়োজন আছে বৈকি।

সাধারণের ধারণা তথ্যের মালিক রাষ্ট্র বা সরকার তথা আইনের ভাষায় কর্তৃপক্ষ। এটা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব বিষয়, সর্বসাধারণ জানবে ততটুকুই, কর্তৃপক্ষ দয়া পরবশে যতটুকু যেভাবে জানাবে। আবার অনেকের ধারণা এগুলো উন্নত বিশ্ব বা পশ্চিমাদের বিষয়। অন্যদিকে তথ্য যারা দেবেন বা যাদের কাছে জনগণের তথ্য আছে তাদের অনেকের এক যুগেও তথ্য গোপন রাখার সংস্কৃতি বা মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি, গোপনীয়তার বেড়াজালে আটকে আছেন। বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ আইনটি পাশের মাধ্যমেই সকল নাগরিকের তথ্য চাওয়া, পাওয়ার, প্রয়োজনীয় সকল তথ্যে সাবলীল প্রবেশের এবং এর প্রয়োগে উপকারভোগী হওয়ার আবশ্যিক ও আইনি স্বীকৃতি লাভ করেছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি ও জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়নের পথ রচিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্র বিকাশের পথ সুগম হয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত, আধুনিক ও প্রাগ্রসর আইনের মধ্যে ভারতের তথ্য অধিকার আইন অন্যতম। এশিয়া মহাদেশের জন্য একটি মডেল ও এতদাঞ্চলের অন্যান্য দেশের আইন পর্যালোচনায় বেঞ্চমার্ক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এহেন শক্তিশালী আইন প্রণয়নের পটভূমিতে ছিল ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের তৃণমূলে তথ্য অধিকার আদায়ে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। তাছাড়া এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভারতেই ব্যাপক সংখ্যক নাগরিক সমাজ সংগঠন তথ্য অধিকার কর্মী হিসেবে সরাসরি দায়িত্ব পালন করে থাকে। বাংলাদেশে আইন প্রণয়নের পটভূমিতে বেসরকারি সংস্থাসমূহের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ । তবে জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠিত আইনটির বাস্তবায়নে যথেষ্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। অর্জনও নেহায়েৎ কম নয়। তথ্য প্রাপ্তি, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, প্রকাশ, প্রচার, অভিযোগ দায়ের, নিষ্পত্তি ইত্যাদি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রায় সকল বিধি, প্রবিধি, নির্দেশিকা, সহায়িকা ইত্যাদি প্রণীত হয়েছে। সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের ৪২ হাজারেরও বেশি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছে। এ সকল কার্যালয়ে বিকল্প দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও আপিল কর্মকর্তা নিয়োজিত আছে।

খ্রী: পূ: ১১-১৪ তে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে Town Criers নামে একদল লোক চিৎকার করে প্রতিদিনের খবর মানুষকে শোনাত। প্রশাসনিক কাজ যাতে নির্ভুল হয় এবং জনগণকে যাতে নির্ভুলভাবে তথ্য দেওয়া যায় তার জন্য ৪৪৯ খ্রী: রোমের Cress মানমন্দিরের সিনেটে প্রথম অফিসিয়াল রেকর্ড সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এটা ছিল তথ্য জানার অধিকারের প্রাতিষ্ঠানিক পর্ব। সাধারণ মানুষের অধিকার বঞ্চনার ইতিহাসের মতোই তথ্য বঞ্চনার পুরনো ইতিহাস রয়েছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের যে পর্যায়ে সমাজে শ্রেণি বিভাজন হয়েছে সে পর্যায়ে ক্ষমতাবানরা সাধারণ মানুষকে অন্ধ করে রেখেছে। তাদের বিত্তবৈভব, সম্পদ-স্বাচ্ছন্দ ও ক্ষমতাকে নিরাপদ রেখেছে। আবার সভ্যতার ক্রমবিকাশের যে পর্যায়ে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে তখন থেকেই জনগণের জানার অধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় এসেছে, তাই গণতন্ত্রের বিকাশের সাথে Press Freedom ও তথ্য অধিকারের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।

আজ থেকে প্রায় আড়াইশত বছর পূর্বে ফিনল্যান্ডের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ফিনিসীয় যাজক Andress Chydenius সেখানকার কোক্কেলা শহর থেকে তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিয়ে রীতিমত আন্দোলন শুরু করে দেন। তিনি বলেন, মানুষ তার প্রয়োজনে যা চায় তা কীভাবে, কোথায়, কোন অবস্থায় আছে তা তাকে জানাতে হবে। তার চাহিদা সে কতটুকু পূরণ করতে পারবে তাও মানুষকে জানাতে হবে। তাই বলা হয়, ফিনল্যান্ডই তথ্য অধিকার আন্দোলনের সূতিকাগার। তবে ফিনল্যান্ড তখন সুইডেনের আওতাভুক্ত ছিল। Andress Chydenius সুইডেনের সংসদে বিল উপস্থাপন করেন। পাশ হয় সুইডেনের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আইন ১৭৬৬ সনে। এ আইনের মাধ্যমে সুইডিশ জনগণকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সৃষ্ট অথবা প্রাপ্ত দলিল দস্তাবেজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। সরকার, সংসদ, চার্চ, স্থানীয় সরকারের আইন, আইনসভা সবকিছুই এর আওতাধীন। বিনামূল্যে এবং দ্রুত তথ্য দিতে সরকারকে বাধ্য করা হয়। নাগরিকের তথ্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে এটাই বিশ্বের প্রথম আইন। তথ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তথ্য জানার অধিকারকে প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দেয় ফ্রান্স, ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম অর্জন ছিল Liberty। “সরকারি করের প্রয়োজনীয়তা, করমুক্ত রাখার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান, আদায়কৃত করের ব্যবহার এবং এটির অংশ, উৎস বা ভিত্তি, সংগ্রহ এবং ব্যাপ্তিকাল ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে সকল নাগরিকের নিজের কিংবা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে জানার অধিকার রয়েছে।” “একজন সরকারি কর্মকর্তার কাছে তার প্রশাসন সংক্রান্ত হিসাব চাওয়ার অধিকার জনগণের রয়েছে।” তবে ফ্রান্সে তথ্য অধিকার আইন প্রণীত হয় ১৯৭৮ সালে। অন্যদিকে U.S সংবিধান প্রণেতারা ১৫ ডিসেম্বর ১৭৯১ সনে U.S Bill of rights এর First Amendment করে Press Freedom এর স্বাধীনতা সংরক্ষণ করেন, যেখানে বলা হয় “Congresshall make nolaw…..abriging the freedom of speech or the press”. পুরো ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে যখন এভাবে মানুষের তথ্যে অভিগম্যতা ও তথ্য জানার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল তখন পাকভারত উপমহাদেশ বৃটিশের উপনিবেশে পরিণত হয়।

১৭৫৭ তে পলাশীর প্রান্তরে যখন স্বাধীনতা অস্তমিত হচ্ছিল, জনগণ তখন ঘরে বসে হাততালি দিয়ে বলাবলি করছিল, ‘‘রাজায় রাজায় লেগেছে যুদ্ধ, দেখি কে হারে কে জেতে”। তথ্য জানার স্বাধীনতা দূরের কথা, পরাধীনতার ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত হচ্ছিল এতদাঞ্চল। অধিকন্ত বৃটিশ ভারতবর্ষে ১৯২৩ সালে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট’ জারির কারণে তথ্য গোপনের সংস্কৃতি পাকাপুক্ত হয়ে গেলো। পাকিস্তান আমলেও এর তেমন উন্নতি ঘটলো না। এদিকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলো। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৪৬ সালে রেজল্যুশনের মাধ্যমে তথ্য অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বলা হলো, “Freedom of information is a fundamental right and is the touchstone of all the freedom to which United Nations is consecrated.” পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা পত্র (UDHR) জারি হয়। ঘোষণা পত্রের ১৯ অনুচ্ছেদে তথ্যের স্বাধীনতাকে সার্বজনীন মানবাধিকার হিসাবে সুষ্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এটি অন্যতম ঘটনা। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৬৬ সালে গৃহীত জাতিসংঘের ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি’র (ICCPR) অন্তর্ভুক্ত করে তথ্য অধিকারকে আরও সুসংহত করা হয়। এছাড়া ‘কমনওয়েলথ তথ্যে স্বাধীনতার নীতিমালা’, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার কনভেনশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দলিলে তথ্য অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর থেকেই বিভিন্ন দেশে দেশে তথ্যের স্বাধীনতা বা তথ্য অধিকার আইন প্রণীত হয় যার সংখ্যা এ পর্যন্ত ১২৯ টি ।

জনগণকে তথ্য প্রদানের মাধ্যমে স্বছতা জবাবদিহি নিশ্চিত করে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য দুর্নিতমুক্ত সমাজ প্রতিষ্টাই বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম লক্ষ্য।

পিআইডি ফিচার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

19 − fifteen =