অ্যাঞ্জেলিনা জোলি মানবিক সুপারস্টার

অপরাজিতা জামান

অভিনয়টা ছিল যেন জোলির জন্মগত অধিকার। কেননা যে পরিবারের মা-বাবা ভাই-বোন সবাই অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত। সে পরিবারের সন্তান ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন এটা তো স্বাভাবিক। জোলির বেলায়ও ঠিক তাই হয়েছিল। কেননা তার জন্মই অভিনয়শিল্পীর ঘরে। তিনি ১৯৭৫ সালের ৪ জুন ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে অভিনেতা জন ভোইগট ও অভিনেত্রী মারসেলিন বারটানডের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ভোইগট। তবে জোলির বেড়ে ওটার গল্প অতোটা মসৃণ ছিল না। তার জন্মের এক বছর পরই কেটে যায় মা-বাবার ভালোবাসার সুতো। ফলে বাবা-মার হাত ধরে বড় হওয়াটা ভাগ্যে জোটেনি তার। জোলি থেকে যান মায়ের কাছে। তার মা বেড়ে উঠেছিলেন এক ক্যাথেলিক পরিবারে। তবে ধর্মীয় বিধি নিষেধের বেড়িতে বাধেননি নিজেকে। কোনোদিন চার্চেও প্রার্থনা করতে ঢুঁ মারেননি। এমন মায়ের মেয়ে হওয়ায় জোলির জন্যও কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। বরং মায়ের সঙ্গে বসে সিনেমা দেখে সময় কাটত তার। জলির বয়স যখন ছয় তখন তার মা ও তার চলচ্চিত্রনির্মাতা প্রেমিক বিল ডে নিউ ইয়র্কের পালিসেডস চলে আসেন। কিন্ত লস অ্যাঞ্জেলস যেন পিছু ছাড়ছিল না। ফলে পাঁচ বছর পর ফের অ্যাঞ্জেলেসে ফিরে আসেন তারা। এ সময় অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হন জোলি। অভিনয়ের ওপর দুই বছরের একটি কোর্স সম্পন্ন করেন। বয়স যখন ১৬ তখন অভিনয়ই করবেন এমন পাকা সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই লক্ষ্য পূরণে বাধা দাঁড়ায় অডিশন রাউন্ড। শত চেষ্টা করেও বিচারকদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারছিলেন না। জোলির আচার আচরণ অন্যদের মতো না। এমন অভিযোগ তুলছিলেন তারা। ফলে গোটা কয়েক মিউজিক ভিডিওতে কাজ করলেও অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন তার অধরাই রয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উদ্দেশ্যে তিনি তার বাবার কাছে অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। পাশাপাশি জোলি অন্যদের আচরণ লক্ষ্য করেন এবং তাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।

বাবা ভেইগটের প্রশিক্ষণই সম্ভবত তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও অভিনয়ের সত্তা তৈরি করে দিয়েছিল। ফলে ১৯৯৩ সালে তিনি পেশাদার অভিনয়শিল্পী হিসেবে দাঁড়ান ক্যামেরার সামনে। ‘সাইবর্গ’ নামের একটি সায়েন্স ফিকশন ছবিতে অভিনয় করেন। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না জোলির। সিনেমাটির ব্যবসায়িক অসফলতায় মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। এক বছর আর নতুন কোনো ছবির জন্য অডিশনে দাঁড়াননি তিনি। বছর দুয়েকের বিরতির পর ১৯৯৫ সালে জোলি দর্শকদের উপহার দেন ‘উইদাউট এভিডেন্স’ ও ‘হ্যাকার্স’ নামের দুটি চলচ্চিত্র। দুটোই ছিল বড় পরিসরের ছবি। এরমধ্যে হ্যাকার্স ছবিটি দিয়ে তিনি বোদ্ধাদের নজরে আসেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসে জোলির ভূয়সী প্রশংসা করেন জ্যানেট মসলিন। তিনি লেখেন, হ্যাকার্স ছবিতে জোলির চরিত্রটি ছিল অনবদ্য। তিনি তার সহশিল্পীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন এবং চরিত্রটিকে বাস্তবসম্মত করে তুলেছেন। হ্যাকার্স ব্যবসা সফলতা না পেলেও সফল হন জোলি।

পরের বছরগুলোতে বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেন জোলি। প্রতিটি ছবিতেই ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে দেখা যায় তাকে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘রোমিও জুলিয়েট’। এই চলচ্চিত্রে আধুনিক জুলিয়েট হিসেবে দেখা যায় তাকে। সে বছর ‘ফক্সফায়ার’ নামের একটি ছবিতে কোমল মনের জুলিয়েটকে দেখা যায় এক কঠোর প্রতিবাদী নারী চরিত্রে। ছাত্রীদের যৌন হেনস্তাকারী এক স্কুল শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে দেখা যায় তাকে। ছবিটি জোলির ক্যারিয়ারকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছিল প্রভাবক হিসেবে। সমালোচকদেরও বেশ প্রশংসা অর্জন করেন তিনি।

ক্যারিয়ার মসৃণ করার সুবর্ণ সুযোগ পান জোলি ১৯৯৭ সালে। সে বছর জোলির ছিল নিজের ভিত হলিউডে মজবুত করার সময়। ১৯৯৭ সালে টিএনটিস ‘জর্জ ওয়ালাস’ সিনেমার জন্য পান গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড। ছবিতে তিনি অভিনয় করেন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী জর্জ ওয়ালাসের স্ত্রী কর্নেলিয়ার চরিত্রে। ছবিটিতে অনবদ্য অভিনয় করে গোল্ডেন গ্লোবের পাশাপাশি এমি অ্যাওয়ার্ডও জিতে নেন তিনি। জর্জ ওয়ালাসের ভূমিকায় ছিলেন গ্যারি সিনিস। ছবিটি দর্শকের নিকটও বেশ সমাদৃত হয়েছিল। পরের বছরটিও জোলির জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। সে বছর তিনি অভিনয় করেন সুপার মডেল গিয়া’র বায়োপিকে। এতে তিনি রূপদান করেন এইডস আক্রান্ত গিয়ার চরিত্রে। চলচ্চিত্রটি ভূয়সী প্রশংসা এনে দেয় জোলিকে। দ্বিতীয়বার পান গোল্ডেন গ্লোব। পরের বছরগুলোতে বেশকিছু চলচ্চিত্রে কাজ করেন এ অভিনেত্রী। এরমধ্যে ‘র‌্যাপেড’, ‘হেলস কিচেন’, ‘প্লেয়িং বাই হার্ট’ উল্লেখযোগ্য। এই ছবিগুলো দর্শকের সমাদরের পাশাপাশি জোলিকে তার ক্যারিয়ার আলোকিত করতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। তবে তা ছিল শুধু হলিউডেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তখনও তিনি অচেনা। তাকে এই সুযোগ এনে দেয় ‘লারা ক্রফট: টুম্ব রাইডার’ সিনেমাটি। ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবি জোলিকে শুধু বিশ্ব সিনেমা প্রেমীদের সামনে তুলেই ধরেনি বরং তাকে সুপারস্টার হিসেবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিল।

এরপর থেকে সুসময় শুরু হয় জোলির। টুম্ব রাইডারের পর তিনি নিয়ে আসেন ‘নিউজ ডে’। এ ছবিতেও বিজয় রথ অব্যাহত ছিল তার। তিনি বিশ্ব মিডিয়া ও দর্শকের মনে জায়গা করে নেন অ্যাকশন স্টার হিসেবে। ছবিটি বিশ্বব্যাপী আয় করে ২৭৪.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরপর আরও কয়েকটি ছবিতে কাজ করলেও সেগুলো সেভাবে সফল হয়নি। ২০০২ সালে আবার রাজত্ব ফিরে পান জোলি। বছরটিতে ‘স্যাটিসফেকশন’ চলচ্চিত্রটির ব্যবসা সফলতা তার ক্যারিয়ারের পালে হাওয়া দিতে থাকে। পরবর্তী পাঁচ বছর দখল করে রাখেন হলিউডের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক নেওয়া অভিনেত্রীর জায়গা। ততদিনে হলিউডে নিজেকে মজবুত অবস্থানে নিয়ে গেছেন। অভিনয় করেছেন ‘মি. অ্যান্ড মিসেস স্মিথ’সহ বেশকিছু বিশ্বকাঁপানো চলচ্চিত্র। অস্কারও মুখ ফিরিয়ে থাকেনি জোলির দিক থেকে। ২০০৮ সালে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কারটি তাকে এনে দেয় ‘চেঞ্জলিং’ নামের একটি সিনেমা। সেইসঙ্গে তৃতীয় বারের মতো পান গোল্ডেন গ্লোব ও বিটিএফএ অ্যাওয়ার্ড। এই সফলতার ধারাবাহিকতা আজও ধরে রেখেছেন আবেদনময়ী এই নারী। মাঝে মাঝে ব্যর্থতা উঁকি দিয়েছে। তবে পরক্ষণেই সফলতার আলো জ্বেলে সেসব দূর করেছেন তিনি। তার ক্যারিয়ারে যোগ হয়েছে ‘দ্য টুরিস্ট’, ‘কুংফু পান্ডা’, ‘সল্ট’সহ দুনিয়া কাঁপানো একাধিক ছবি। পর্দার পেছনেও অনবদ্য জোলি। নির্মাণ করেছেন বেশকিছু চলচ্চিত্র। সেগুলোও পেয়েছে বোদ্ধাদের ভূয়সী প্রশংসা।

অভিনেত্রী জোলি অভিনয়দক্ষতা ও সৌন্দর্যের জন্য যেমন ভুবন বিখ্যাত তেমনই আরও একটি পরিচয়ের কারণে তিনি পৃথিবীজুড়ে প্রশংসিত। সেটি হচ্ছে তার মানবিক গুণ। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে মানবতা বিপন্ন হলেই কেঁদে ওঠে এই সুপারস্টারের প্রাণ। বিশেষ করে শরণার্থী শিশুদের আর্তনাদ সইতে পারেন না তিনি। যখনই কোনো যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে শিশুদের জীবন বিপন্ন হয়েছে তখনই তিনি হাজির হয়েছেন সেখানে। আফগানিস্তান থেকে শুরু করে সম্প্রতি যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউক্রেনেও দেখা গিয়েছিল তাকে। টানা ২০ বছর তিনি কাজ করেছেন জাতিসংঘের শরণার্থী দূত হিসেবে। দীর্ঘ এই সময় শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের কথা তিনি তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর কাছে। মিয়ানমার থেকে জীবনবিপন্ন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করলে সরকার তাদের দায়িত্ব তুলে নেয়। এজন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভূয়সী প্রশংসা করে চিঠিও লিখেছিলেন জোলি।

ব্যক্তিগত জীবনের একাধিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন জোলি। শুরুটা হয়েছিল মাত্র ১৪ বছর বয়সে। এই প্রেমে তার মায়েরও সম্মতি ছিল। মায়ের সম্মতিতেই প্রেমিকের সঙ্গে লিভ ইন করতেন তিনি। দুই বছর আয়ু ছিল এই সম্পর্কের। এরপর অনেকেই এসেছেন জোলির জীবনে। জোলি তাদের কয়েকজন সঙ্গে গাঁটছড়াও বেঁধেছিলেন। কিন্তু স্থায়ী হয়নি সেসব সম্পর্ক। জোলির জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘদিনের সঙ্গী বিবেচনা করা হয় হলিউড অভিনেতা ব্রাড পিটকে। ২০০৫ সালে ‘মি. অ্যান্ড মিসেস স্মিথ’ সিনেমা করতে গিয়ে পিটের সাথে পরিচয় হয় জোলির। পরিচয় প্রণয়ে গড়াতে খুব একটা সময় নেয়নি। দুজনে মিলে হন ব্রাঞ্জেলিনা। তাদের এ সম্পর্ক ভালোই চলছিল। দুজনে লিভ ইন করে কাটিয়ে দেন প্রায় একযুগ। এ সময় পিটের তিন সন্তানের মা-ও হন জোলি। অনুরাগীরাও এ জুটিকে মণিকোঠায় দেন স্থান। কিন্তু তবুও শেষরক্ষা হয়নি। একযুগের প্রেমের সম্পর্ক ২০১৪ সালের আগস্টে পরিণয়ে রূপ পেতেই বেজে ওঠে ভাঙনের সুর। ফলে দুই বসন্ত ঘুরতেই ভেঙে যায় তাদের নয় বছরের সম্পর্ক। আলাদা হয়ে যান তারা। প্রেমে পড়েন এক সমাজকর্মীর। ২০১৮ সালে প্রেমিককে বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানা গিয়েছিল। তবে বিয়ের বাদ্য বাজার খবর আর জানা যায়নি। তারপর থেকে একাই আছেন জোলি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

thirteen + 17 =