প্রস্থেটিক মেকআপ শিল্পী স্বর্ণা ভৌমিক

নিজের ফেসবুক পরিচিতিতে লিখেছেন: ‘পেন্সিল, কাগজ, রঙ, আঠা, সুতা, মাটি, সিরামিক, টেক্সচার পেস্ট, সিমেন্ট, তার, কলম এই সবকিছুর মিশেলে স্বর্ণা ভৌমিক।’ আসলেই তাই। একজন প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টিস্টের জীবনের সঙ্গে এই বিষয়গুলো ওতপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে। স্বর্ণা ভৌমিক একজন প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টিস্ট। দেশে প্রস্থেটিক নিয়ে কাজ হচ্ছে বিগত কয়েক বছর যাবত। প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টিস্ট স্বর্ণা ভৌমিকের হাত ধরে হয়েছে এর সূচনা। শোবিজ অঙ্গনে নিয়মিত কাজ করছেন বিগত তিন বছর যাবত। তার সম্পর্কে জানাচ্ছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত

২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওটিটি প্লাটফর্ম ‘হুলু’তে মুক্তি পায় নুহাশ হুমায়ূনের ‘ফরেনারস অনলি’ নামের ইংরেজি ভাষার শর্টফিল্ম। টোয়েন্টিন্থ ডিজিটালের অ্যান্থলজি সিরিজ ‘বাইট সাইজ হ্যালোইন’-এর তৃতীয় সিজনে দেখানো হয়েছে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি। নুহাশ হুমায়ূনের এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশি অভিনেতা মোস্তফা মনওয়ার। চলচ্চিত্রে তার ভয়ংকর এক রূপ দেখা যায়।

পর্দায় অভিনেতা মোস্তফা মনওয়ারের ভয়াবহ রূপ দেখা সম্ভব হয়েছে প্রস্থেটিক মেকআপের দ্বারাই। ১৫ মিনিট ৩ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্রটিতে প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন স্বর্ণা ভৌমিক। কনটেন্টটি রিলিজ হওয়ার পর তার কাজের প্রশংসা হয়েছে সবখানে।

স্বর্ণা ভৌমিক শুরুতে পরিচিত মানুষদের প্রস্থেটিক মেকআপ করার মাধ্যমে নিজের হাত পাকানো শুরু করেন। তারপর ছবি তুলে নিজের সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন। ‘ঝড়িৎহধ’ং ইৎঁংয ইড়ী’ নামের ফেসবুক পেইজে তার সব কাজ একসঙ্গে দেখতে পারবেন। সেখান থেকে অনেকেই তার কাজ সম্পর্কে জানতে শুরু করে। একদিন রেহান উদ্দিন নামের একজন নির্মাতা তার নাটকে কাজের জন্য স্বর্ণাকে অনুরোধ জানান। ২০২০ সালে ‘আয়না’ নামের নাটকটি প্রচারিত হয় চ্যানেল আইতে। স্বর্ণা ভৌমিকের মিডিয়াতে প্রথম বারের মতো কাজ করা হয় ‘আয়না’ নাটকে কাজ করার মাধ্যমে।

২০১৪ সালে ভূত সাজার জন্য হ্যালোইন মেকআপ করতে গিয়ে খেয়াল করেন তাকে নকল ভূত লাগছে। লুক কীভাবে আরো বাস্তব করা যায় এ নিয়ে জানতে গিয়েই স্বর্ণা ভৌমিকের পরিচয় হয় প্রস্থেটিক মেকআপের সঙ্গে। তারপর প্রস্থেটিক মেকআপ বিষয়ে অনেক ইংরেজি ভাষার বই পড়েছেন তিনি। বইগুলো অনেক এক্সপেনসিভ বলে পিডিএফ ভার্সন পড়তে হয়েছে তার।

শুরুটা এভাবেই। তারপর প্রস্থেটিক মেকআপ নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে দিনে দিনে। তিনি অনলাইন কোর্স করছেন ‘স্টেন উইন্সটন স্কুল অব ক্যারেক্টার আর্ট’ থেকে। বিশ্বের জনপ্রিয় প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টিস্ট স্টেন উইন্সটন মারা যাওয়ার পর তার ছাত্ররা এখন স্কুলটা পরিচালনা করছেন। এছাড়া তিনি ইউটিউবের মাধ্যমে সূক্ষ বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন ফেসবুক কেন্দ্রিক গ্রুপে যুক্ত হোন তিনি যেখানে প্রস্থেটিক মেকআপের একটা বিশাল কমিউনিটি রয়েছে। বর্তমানে তিনি ৩ জন মেন্টরের কাছ থেকে শিখছেন আরও পরিপক্ব হয়ে কাজ করার জন্য। তারা তিনজনেই হলিউডে কাজ করেছেন লম্বা একটা সময়।

২০২১ সালে অনলাইনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রস্থেটিক মেকআপ প্রতিযোগিতা ‘গ্রেপ রিভিউ’-এ অংশগ্রহণ করেন স্বর্ণা ভৌমিক। নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয় এই আয়োজন। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে দেশের বাইরে তার যোগাযোগটা বেড়েছে। টেরর ভিশন ও এএফআপ নামের দুইটি প্রডাকশন হাউজ থেকে তিনি প্রথমে কাজের প্রস্তাব পেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে গিয়ে কাজ করে পারিশ্রমিক নিতে গেলে বাজেট অনেক বেড়ে যায় তাই সবকিছু মিলিয়ে তার এই কাজটা করা হয়নি।

ছোটবেলা থেকে চারুকলায় আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল। পরিবারের চাপে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ তে পড়াশোনা করেন। তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর আগ্রহ ধরে রাখতে পারেননি তিনি। তারপর তিনি প্রস্থেটিক মেকআপ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। বর্তমানে অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস করছেন সেখানে। সামনে মাস্টার্স করার পরিকল্পনা করে এই বিষয়ের ওপরে দেশের বাহিরে থেকে। পাশাপাশি খুব শীগ্রই বিবিএ বিষয়ের ওপর গ্রাজুয়েশনটা শেষ করবেন।

স্বর্ণা ভৌমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ডাটা এন্ট্রিয়ার হিসেবে একটা কোম্পানিতে কাজ করেছেন। একটা বিউটি পার্লারের ম্যানেজার হিসেবেও কাজ করেছেন। আইসিটি ডিভিশনের শেখ রাসেল প্রজেক্টে কাজ করেছেন তিনি। আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট শেখানোর একটি কোচিংয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। সবকিছুর মাঝে নিজেকে তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারপর প্রস্থেটিক মেকআপ নিয়ে কাজ করার পর নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই ভৌতিক ও হরর সিরিজ, সিনেমা, গল্পের প্রতি তার ভীষণ আগ্রহ ছিল।

উদ্যোক্তা হিসেবে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছেন স্বর্ণা ভৌমিক। ‘ঈৎবধঃরড়হ ওহংবপঃং’ নামের একটা ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে তিনি নিজের হাতে তৈরি নানা সামগ্রী বিক্রি করে থাকেন। হ্যান্ড ক্রাফট পণ্যগুলো শুরুতে অফলাইনে দোকানে বিক্রি করতেন তিনি। তারপর অনলাইনে বিক্রি শুরু করেন। মাঝে লম্বা একটা সময় ব্যবসা বন্ধ ছিল। এখন আবার নিয়মিত ব্যবসাটা নিয়ে কাজ করবেন বলে জানান। ভবিষ্যতে ‘ঈৎবধঃরড়হ ওহংবপঃং’ একটা শো-রুম নিতে চান রাজধানীর যেকোনো এলাকায়। তিনি জানান, প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট করেছি মেকআপ নিয়ে। ভিন্ন লুক ক্রিয়েট করার চেষ্টা করেছি। শুরুতে মেকআপ মেটেরিয়াল পেতে খুব কষ্ট হয়েছে। অনেক মেকআপ বাংলাদেশে ছিল না। এখন অনলাইনের মাধ্যমে প্রায় সব মেকআপ পাওয়া যায়। আমি সবসময়ই কাজ করার সময় রিয়ালিস্টিক লাগে যাতে সেদিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছি। পরিবার থেকে শুরুতে সহযোগিতা পাইনি। ধীরে ধীরে সফলতা পাওয়ার পর সকলে উৎসাহ দিয়েছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জানান, আমি মেডিকেল প্রস্থেটিক নিয়ে কাজ করবো। আমার সৃষ্টি মানবকল্যাণে কাজে লাগুক সেটা আমি চাই। এছাড়া আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রস্থেটিক মেকআপে নিজের শৈল্পিকতা কাজে লাগিয়ে কিছু ব্যতিক্রম কিছু করার ইচ্ছে আছে।

রেহান উদ্দিনের নাটক ‘আয়না’, কাজল আরেফিন অমির নাটক ‘হেল্প মি’, জিহাদ আহমেদের ওয়েব সিরিজ ‘কানাগলি’, মাহাদি হাসানের ফিচার ফিল্ম ‘স্যান্ড সিটি’, নাহিয়ান সিদ্দিকের শর্ট ফিল্ম ‘রিসিভড এন্ড চেকড’, ভিকি জাহেদের ওয়েব সিরিজ ‘দ্য সাইলেন্স’-এ কাজ করেছেন প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে। এছাড়া জিয়াউল হক পলাশের একটি ওভিসিতে কাজ করেছেন স্বর্ণা ভৌমিক।

হলিউডে প্রস্থেটিক মেকআপ শেখার অনেক ইনস্টিটিউশন রয়েছে। এমনকি পাশের দেশ ভারতেও এ নিয়ে চর্চা চালাচ্ছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তবে আমাদের দেশে প্রস্থেটিক মেকআপ শেখার এমন সুযোগ নেই। তবে বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে তা অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। প্রস্থেটিক মেকআপ আর্ট সহজ কোনো বিষয় নয়। যেকোনো ভৌতিক কিংবা থ্রিলার ঘরানার গল্পে এই ধরনের মেকআপের চাহিদা বেশি দেখা যায়। একজন আর্টিস্ট নিজের সৃজনশীলতার সঙ্গে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পর্দায় তুলে ধরেন একজন শিল্পীকে। যতটা নিখুঁতভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারবেন তিনি ততটাই বাস্তবসম্মত মনে হবে চরিত্রটা। সেজন্য এই ধরনের কাজে পরিপক্বতা বড্ড প্রয়োজনে। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতরভাবে কাজটা উপস্থাপন করাই মূল লক্ষ্য। পরিপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেলে স্বর্ণা ভৌমিকের মতো অনেক তরুণ শিল্পী বের হয়ে আসবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

17 + 7 =