সাজাদুল ইসলামের ‘ইনক মি’

নাহিন আশরাফ

বক্সাদের শরীরে আঁকা ট্যাটু দেখে প্রথম ট্যাটুর প্রতি আগ্রহ জন্মায় সাজাদুল ইসলাম মুনের। কিন্তু কখনোই ট্যাটু নিয়ে ঘটা করে ভাবেননি। তাহলে কীভাবে আগ্রহের জায়গা থেকে ট্যাটু করা পেশা হয়ে গেল?

সাজাদুল ইসলাম মুনের ছোটবেলা কেটেছে দারুন। বাবা-মা তার প্রতিটা সিদ্ধান্তে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন ছোটবেলা থেকেই। মুন স্কলাস্টিকা স্কুল থেকে এ লেভেল ও লেভেল শেষ করে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনে পড়ালেখা করতে দেশের বাইরে পাড়ি জমান। লন্ডনে যাওয়ার পর তার ট্যাটুর আগ্রহ বেড়ে যায়। লেখাপড়া করার পাশাপাশি লন্ডনের একটা শপে তিনি কাজ করতেন, তার শপের পাশেই আরেকটা শপে ট্যাটু করানো হতো। তিনি সেখানে গিয়ে ট্যাটু করানো দেখতেন ও মুগ্ধ হতেন। তিনি ভাবতেন, চমৎকার আর্ট। এরপর তিনি তাদের কাছে ট্যাটু শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের সাথে কাজও শুরু করেন।

বিগত কয়েক বছর ধরে ট্যাটু ফ্যাশনের অংশ দাঁড়িয়েছে। ফ্যাশন সচেতন অনেকের কাছেই ট্যাটু একটি শখের নাম। বহু বছর আগে জাপানের আদি জাতিগোষ্ঠী আইনু ঐতিহ্য অনুযায়ী তাদের মুখে ট্যাটু ব্যবহার করতেন। ট্যাটুকে বংলায় বলা হয় ‘উল্কি’। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের অনেক চিত্রতে উল্কি অঙ্কিত দেখা যায়। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ট্যাটুর ব্যবহার আজকে নতুন নয়। বহু যুগ আগে থেকেই ট্যাটু মানুষের শরীর সাজানোর একটি অংশ।

এখন আধুনিক মানসিকতার সব দেশের মানুষের কাছে ট্যাটু ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ছাত্র-ছাত্রী, গায়ক-গায়িকা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের দেহও ট্যাটুর নানা রঙে রঙিন হয়েছে। জার্মানিতে করা এক জরিপে জানানো হয়েছে, ৩৫ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের পাঁচজনের মধ্যে একজনের গায়ে ট্যাটু আঁকা রয়েছে।

ইউরোপ বা আমেরিকার মতো দেশে ট্যাটু খুব সাধারণ বিষয় হলেও বাংলাদেশের মানুষ এখনো ট্যাটুকে খুব সাধারণভাবে নিতে পারেনি। ঠিক এই পরিস্থিতেই মুন লন্ডন থেকে পড়ালেখা করে ফিরে এসে ট্যাটু নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করেন। তার সাথে ছিল আরো দু’জন, নাইম ও জয়। ২০১৬ সালে যখন প্রথম কাজ শুরু করেন তখন তাদের বেশিরভাগ ক্লায়েট ছিলেন বিদেশি। তারা যেসব হোটেলে থাকতেন তারা সেই সব হোটেলে গিয়েই সার্ভিস দিতেন। এরপর তারা ফেসবুকে ‘ঢাকা ট্যাটু’ নামে একটি পেইজ খুলেন। কিন্তু নামটি অনেক বেশি কমন হবার কারণে বদলে রাখা হয় ‘ইনক মি’। ‘ইনক মি’ অর্থ হচ্ছে ‘আমাকে রাঙিয়ে দাও’। মানবদেহে ট্যাটু করতে নানা রঙের খেলা খেলতে হয়। এই রঙের কথা মাথায় রেখেই তারা তাদের নামকরণ করেন ইনক মি। চাহিদা দেখে তারা ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বেইলি রোডে প্রথম নিজেদের স্টুডিও খোলেন। এভাবেই ইনক মি ট্যাটু স্টুডিও ঢাকা’র যাত্রা শুরু।

বন্ধুসুলভ হওয়ায় অল্প সময়ে এই জেনারেশনের সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেন তারা। আশেপাশের স্কুল কলেজের সব ছেলেমেয়েরা বসে তাদের সাথে আড্ডা দিত। এই আড্ডার মাধ্যমেই ধীরে ধীরে তাদের প্রচার হতে থাকে। নিজেদের প্রচারের জন্য আলাদা করে তারা আর কিছুই করেননি। খুব বেশি না হলেও তারা লক্ষ্য করলেন, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে ট্যাটুর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। সাজাদুল ইসলাম মুন জানান, দেশে ট্যাটু আর্টিস্টদের তেমন কদর নেই, কিন্তু দেশের বাইরে তাদের আলাদা একটা সম্মানের জায়গা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, অনেকেই মানতে চায় না যে ট্যাটুও একটা শিল্প। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশ এখনো এ শিল্পের কদর করতে জানে না।

তিন জন দিয়ে শুরু করা ইনক মি এখন রয়েছে ১২ জন স্টাফ। ইনক মি ট্যাটু স্টুডিও প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে দুইজন ট্যাটু শিল্পী রয়েছেন। তারা দুইজনই ইনক মি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করছেন। কিন্তু শুরুর দিকে ট্যাটু শিল্পী না থাকায় ভারতের দু’জন ট্যাটু আর্টিস্টকে নিয়ে তারা কাজ শুরু করেছিলেন।

সাজাদুল ইসলাম মুনের পাশাপাশি ‘ইনক মি’র পেছনে যার ভূমিকা রয়েছে তিনি হচ্ছে নঈম মাহমুদ। নঈম একজন ফ্রিল্যান্সিং ট্যাটু আর্টিস্ট। দু’জনের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ট্যাটু, সেখান থেকেই তাদের পরিচয়। ট্যাটুর প্রতি গভীর টান থেকেই দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দু’জন এক সাথেই নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন।

এই পেশাতে আসবার আগে পারিবারিক সহযোগিতা কেমন পেয়েছেন জানতে চাইলে মুন বলেন, ‘আমাকে কোনোদিন বাসা থেকে কোনো কাজে বাধা দেওয়া হয়নি, এক্ষেত্রেও তেমন বাধার সম্মুখিন হইনি পরিবার থেকে। কিন্তু সমাজের অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেছে। আমাদের নিয়ে সমালোচনা করেছে। এটাকে পেশা হিসেবে অনেকেই মেনে নিতে পারে না। এছাড়া প্রচলিত নানা কুসংস্কার রয়েছে। কিন্তু আমরা তো কাউকে জোর করে ট্যাটু করে দিচ্ছি না। যারা ট্যাটু করতে আগ্রহী তারাই নিজে থেকে আমাদের কাছে আসেন।’

ট্যাটুর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি ‘পিয়ার্সিং’ অর্থাৎ নাক, কান, ভ্রু, নাভি ও দেহের বিভিন্ন জায়গায় ছিদ্র করে রিং পরানোর সার্ভিস দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও তারা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। কারণ তারা সুঁইয়ের মাধ্যমে ছিদ্রের কাজ করে থাকেন যা অত্যন্ত নিরাপদ উপায়। এ সময়ের জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর রাবা খান, মেকআপ আর্টিস্ট শাহনাজ শিমুল সহ অনেকেই তাদের কাছে সার্ভিস নিয়েছেন। কিছুদিন হলো প্রতিষ্ঠানটি লেজার ট্রিটমেন্ট চালু করেছে। লেজারের মাধ্যমে পূর্বে করা ট্যাটু ভ্যানিশ অর্থাৎ মুছে ফেলা সম্ভব হবে। কিন্তু বিষয়টি অনেকটা পীড়াদায়ক ও বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রায় ৫/৬টি সেশন প্রয়োজন একেকটি ট্যাটু মুছে ফেলার জন্য। অর্থাৎ প্রায় বছরখানেক লেগে যাবে এটি করতে। এছাড়াও মাইক্রোব্লিডিং ট্রিটমেন্ট ও শ্বেতাঙ্গ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ত্বকের ভারসাম্য রক্ষায় রঙ ফিরিয়ে দেওয়ার সার্ভিসও এখানে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের তরুণরা এখন ট্যাটুর ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। কথা হয় তানিয়া সুলতানার সাথে তিনি তার কাঁধে ছোট করে একটি গোলাপ ফুল ট্যাটু করিয়েছেন। প্রথমে তার পরিবার এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘ট্যাটু করতে আসবার আগে খুব ভয়ে ছিলাম যে কেমন ব্যথা লাগবে তা নিয়ে। ব্যথা ঠিকই পেয়েছি কিন্তু কথায় আছে শখের দাম ৮০ টাকা। খুব আগ্রহ আর শখ থাকবার কারণে ব্যথাকে তেমন পাত্তা দেইনি।’

তানিয়া সুলতানার বন্ধু কানাডা থেকে ট্যাটু করিয়ে আসেন। তা দেখে তার আগ্রহ হয় ট্যাটু করার। কিন্তু প্রথমে তিনি কিছুটা বিভ্রান্ত ছিলেন যে বাংলাদেশে কেমন কাজ হবে তা নিয়ে। কিন্তু তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেন, বাংলাদেশের ট্যাটুশিল্পীরা এখন যথেষ্ট ভালো কাজ করছে এবং সবাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

ট্যাটু শরীরের জন্য ক্ষতিকারক কি না তা নিয়ে সাজাদুল ইসলাম মুন জানান, অনেকেই মনে করেন ট্যাটু করলে স্কিন ক্যান্সার হয়। কথাটি পুরোপুরি সত্য না। কারণ তাহলে দেশের বাইরে এটা এতো জনপ্রিয় হতো না, তারা অনেক বেশি সচেতন। তবে অবশ্যই ট্যাটু করার পর সঠিক উপায়ে যত্ন নিতে হবে। ট্যাটু করা স্থানে প্রথম কিছুদিন ক্লোরিন ওয়াটার, সাবান, সমুদ্রের লবণাক্ত পানি, নখের আঁচড় দেওয়া যাবে না। ট্যাটু করা স্থানে ইনফেকশন দেখা দিলে আমরা তাদেরকে এন্টিবায়োটিক মলম ব্যবহার করতে বলি। এসব নিয়ম মেনে চললেই কারো তেমন কোনো সমস্যা হয় না। অনেকের মধ্যে ভুল ধারনা রয়েছে যে ট্যাটু করলে রক্তদান করা যায় না। ট্যাটু করেও অনেকে দিব্যি রক্ত দিয়ে অন্যদের সাহায্য করছেন।

‘ইনক মি’ নিয়ে সাজাদুল ইসলাম মুনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে তিনি ইনক মি কে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চান। সবসময় এ শিল্পের সাথেই থাকতে চান। তার সবার প্রতি আহ্বান সবাই যেন সবধরনের শিল্পের মর্যাদা ও তাদের প্রাপ্য সম্মান দেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিয়র

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 − 14 =