মঙ্গল শোভাযাত্রা-ঈদযাত্রা ও দ্রব্যমূল্য

মাহবুব আলম

অতি সম্প্রতি দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটেছে এপ্রিল মাসে (২০২৩)। এপ্রিল মাসে ঘটা ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে; মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের চেষ্টা, ঈদযাত্রার ভিন্ন চেহারা এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি।

মঙ্গল শোভাযাত্রা

মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। কারণ এই শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার বিভিন্ন লোকজ উপাদান উপস্থাপন করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস মাত্র চার দশকের। এই অল্প সময়ের মধ্যে বাঙালি জাতি এই শোভাযাত্রাকে তাদের ইতিহাস ঐতিহ্যে ধারন করেছে। শুধু তাই নয়, এই শোভাযাত্রা আধুনিক বিশ্বের সংস্কৃতিপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে জাতিসংঘের। আর তাইতো ইউনেস্কো ২০১৬ সালে একে বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে পহেলা বৈশাখের উৎসবে আরও একটা নতুন পালক যুক্ত হয়েছে। যা বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গৌরবের। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এই মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এই চক্রান্তের অংশ হিসেবে এক শ্রেণির মৌলবাদী শুরু থেকেই এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও কুৎসা রটনা শুরু করে। বলে এটা ইসলাম ধর্মে জায়েজ না। কারণ এটা এসেছে হিন্দু সংস্কৃতি থেকে।

চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বক্তৃতা বিবৃতির পাশাপাশি ওরা এখন হাইকোর্টে হাজির হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের এক আইনজীবী মো. মাকসুদুল হাসান ৯ এপ্রিল মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের দাবিতে সরকারকে আইনি নোটিশ দিয়েছে। ওই নোটিশে বলা হয়েছে ‘মঙ্গল শব্দটি একটি ধর্মীয় শব্দ। ওই শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলমান জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে। যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২-ক-এর সরাসরি লঙ্ঘন। এটা দণ্ডবিধির ২৯৫ ক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এখানেই থেমে নেই চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারীরা। এরপর ১১ এপ্রিল রাজধানীর মনিপুর স্কুলের এক ছাত্রের অভিভাবক খালিদ জাহান হাইকোর্টে রিট করে স্কুল কলেজে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিষিদ্ধের দাবি করেছেন। তিনিও বলেছেন, এটা ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী।

এ বিষয়ে তার আইনজীবী মো. অজিউল্লাহ ও আজিম উদ্দিন পাটোয়ারি বলেছেন, আলেম সমাজের মতামত অনুসারে এটা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই আলেমদের আপত্তি আছে… ইত্যাদি। আসলে তাদের উদ্দেশ্য হলো বিভেদ-বিভ্রন্তি ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ান। এরা প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। অশুভ শক্তি। পাকিস্তান আমলে যারা আরবি হরফে বাংলা চালুর সুপারিশ করেছিল। এরা তাদের প্রেতাত্মা। এই প্রেতাত্মাকে সমূলে বিনাশ-উচ্ছেদ ছাড়া এদেশে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা আজ হোক, কাল হোক বাধাগ্রস্ত হবেই। তাই এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে এই অপপ্রচারকারীদের শক্তি ও অর্থের উৎস।

তবে এ বিষয়ে আশার কথা হলো এই যে, হাইকোর্টে রিট ও সরকারকে উকিল নোটিশ এবং মৌলবাদী শক্তির মঙ্গল শোভাযাত্রা বিরোধী বক্তব্য বিবৃতিকে পদদলিত করে এদেশের তরুণ ও যুবকরা অতীতের মতোই নববর্ষের দিন বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছে। এটাই আশা, এটাই ভরসা, এটাই সম্ভাবনা।

ঈদযাত্রা

ঈদযাত্রা অর্থাৎ ঈদে ঘরে ফেরে হাজার হাজার লাখ লাখ নয় কয়েক কোটি মানুষ। নগর-মহানগর থেকে নিজ গ্রামে ফেরে স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে। এক হিসাবে জানা গেছে, শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরী থেকেই এক কোটিরও বেশি মানুষ গ্রামের উদ্দেশে নগর ত্যাগ করে। ঢাকা মহানগরীর পাশাপাশি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা থেকেও এক কোটির বেশি মানুষ গ্রামে যায় ঈদ করতে। এছাড়া বিভিন্ন জেলা শহর থেকেও যায় বিপুল সংখ্যক মানুষ। যা বিশ্বের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। বিশ্বে দেশে দেশে উৎসবের সময় মানুষ ছুটে যায় বিভিন্ন শহর ও পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টা। এমনকি প্রতিবেশি পশ্চিমবঙ্গে পূজার সময় লোকে লোকারণ্য হয় কলকাতা শহর। যার বড় অংশ আসে গ্রামবাংলা থেকে কলকাতায় পূজা দেখতে।

এ বিষয়ে আমার এক তরুণ সাংবাদিক বন্ধুর মন্তব্য, ‘প্রায় দুই কোটি মানুষ ঢাকা মহানগরীতে বাস করলেও তার খুব কম সংখ্যকই নাগরিক। আর তাইতো তারা এই নগরকে নিজের নগরী মনে করে না। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো ঢাকা একটা আবর্জনার নগরীতে পরিণত হয়েছে।’ বিষয়টি একবোরে উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই। একবার ভাবুন তো আমরা কারও সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করি, দেশ কোথায়? এবং সে ব্যক্তিও নির্দ্বিধায় উত্তর দেয় ময়মনসিংহ, ঈশ্বরদী নয়তো কিশোরগঞ্জ। আসলে একটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।

যাই হোক ঈদে ঘরে ফেরা ঈদযাত্রায় ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। কারণ মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এক কোটির বেশি মানুষের শহর ছাড়ার জন্য যে পরিবহন ব্যবস্থা ও সড়কের প্রয়োজন তা নিশ্চিত করা সহজ তো নয়ই বরং খুবই কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ। আর তাইতো পরিবহন মালিকরা সুযোগ নেয়। ইচ্ছমতো ভাড়া আদায় করে।  তারপরও মানুষের বাড়ি যাওয়া চাই-ই। এই চাওয়া হয়তো আরও কয়েকশ বছর অব্যাহত থাকবে। যতদিন না তারা নাগরিক হচ্ছে। তবে অন্যান্য বারের তুলনায় ২০২৩-এর এপ্রিলে ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের ভোগান্তি তুলনামূলক কম হয়েছে। এর অন্যতম কারণ পদ্মা সেতু ও সেতুর উপর দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচলের সুযোগ দেওয়া। ঈদের দু’দিন আগে ২০ এপ্রিল ভোর থেকে এই সুযোগ দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এই সুযোগ দেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে এ জন্য প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ প্রাপ্তির দাবি রাখে।

এ ছাড়াও এবারের ঈদ যাত্রার স্বস্তির কারণ সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা ভালো ও যথাযথভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এবং ঈদের ছুটির মধ্যে নির্বাহী আদেশে এক দিনের ছুটি বৃদ্ধি অর্থাৎ লম্বা ছুটি।

দ্রব্যমূল্য

বিশ্বের দেশে বিভিন্ন উৎসবে নিত্যপণ্যসহ সকল পণ্যের মূল্য হ্রাস করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে ঈদ-পূজা-পার্বনসহ বিভিন্ন উৎসবে নিত্যপণ্যসহ সকল পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটে। অতীতের সেই ধরাবাহিকতায় এবারের রোজার ঈদে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করা হয়। এই নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে প্রশাসন স্রেফ দর্শকের ভূমিকা পালন করে। নেতা-মন্ত্রীরা কিছু বক্তৃতা বিবৃতিতে ব্যবসায়ীদের অনুনয় বিনয় করে রোজায় মূল্যবৃদ্ধি না করার আবেদন জানান। কিন্তু কথায় আছে চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। আর তাইতো ২০০ টাকার খেজুর বিক্রি হয় হাজার টাকায়। মাছ-মাংসের অবস্থা অনুরূপ। সবচেয়ে দুঃখজনক প্রতিবছর রমজান মাসকে কেন্দ্র করে খোদ সিটি কর্পোরেশন মাংসের মূল্য বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন।

সম্প্রতি এক প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, দেশের মানুষের ত্রাহি অবস্থা, পকেটে টাকা নেই। বাজারে গিয়ে মানুষ কাঁদে। নির্ভেজাল সত্য কথা বলেছেন এবং তিনি দায় চাপিয়েছেন বাজার সিন্ডিকেটের ওপর। নিঃসন্দেহে বাজার সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসন কী করে? সিন্ডিকেট ভাঙার দায়িত্ব কার? সে বিষয়টিও তিনি উপেক্ষা করেছেন। এভাবে সরকার ও প্রশাসন দায় দায়িত্বমুক্ত হতে পারে না।

এ বিষয়ে শুধু একটা কথাই বলা যায়, মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ, একেবারে শোচনীয়। এই অবস্থায় মন্ত্রী মহোদয় যে উপলব্ধি করেছেন তার জন্য তাকে ধন্যবাদ। কিন্তু তারপর? এই তারপরের জন্য নিঃস্ব জনগণ, সর্বসাধারণ কী নিয়তির হাতেই সব কিছু ছেড়ে দেবে? হয়তো দেবে। হয়তো না। দেখা যাক কি হয়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × three =