ফুটবলের এক অবিস্মরণীয় মৌসুম

উপল বড়ুয়া

ইউরোপের শীর্ষ ফুটবলে এমন স্মরণীয় ও রোমাঞ্চকর মৌসুম শেষবার এসেছিল কবে! ৩৩ বছর পর ফুটবল ঈশ^র ডিয়েগো ম্যারাডোনার সাবেক ক্লাব নাপোলির সিরি’আ জয় থেকে আর্সেনালের হৃদয় ভেঙে ম্যানচেস্টার সিটির হ্যাটট্রিক প্রিমিয়ার লিগ। কিংবা ২০ বছর পর নিউক্যাসল ইউনাইটেডের চ্যাম্পিয়নস লিগে ফেরা। ১৩ বছর পর ইন্টার মিলানের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ওঠা; কোনটা রেখে কোনটার কথা বলবেন!

এমন একেক ঘটনার কারণে ২০২২-২৩ মৌসুমকে স্মরণীয়, রোমাঞ্চকর, নাটকীয় বললে খুব কমই বলা হয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উত্তেজনায় ঠাসা ছিল এবারের মৌসুম। তার মধ্যে গত ডিসেম্বরে কাতারে বিশ^কাপ যেন নতুন ব্যঞ্জনা দিয়েছে। ক্লাব ফুটবলের কারণে বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য দেশগুলো ছুটি পেয়েছে মাত্র ১০-১৫ দিনের। অনেকের কপালে সেটাও জুটেনি। ৭ দিনের প্রস্তুতি নিয়েই যেতে হয়েছে কাতারে। তবে শুরুর ধাক্কা সামলে ৩৬ বছর পর সোনালি শিরোপার স্বাদ পায় আর্জেন্টিনা। দুঃখ ঘুচে লিওনেল মেসিদের।

১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। আরেকটি বিশ্বশিরোপার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হলো সাড়ে তিন দশকেরও বেশি। ২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর অমর্ত্যলোকে পাড়ি দেওয়ায় সাবেক শিষ্য মেসির উল্লাস দেখে যেতে পারেননি ম্যারাডোনা। তবে ফুটবল ঈশ্বর হয়তো স্বর্গে বসে বুয়েনেস আইরেসের উদযাপন দেখেছেন। স্বর্গে বসে তিনি হয়তো উল্লাসে মেতেছিলেন নাপোলির স্কুদেত্তো জয়েও। ইতালিয়ান ক্লাবটির আগের যে দুটি সিরি’আ ছিল, দুটিই এনে দিয়েছিলেন ছিয়াশির মহানায়ক। শেষটি ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে। এবার লুসিয়ানো স্পালোত্তির অধীনে এল তৃতীয় লিগ শিরোপা। গত কয়েক মৌসুম ধরে লিগ জয়ের যে ইচ্ছে নেপলসবাসীর, সেটির পূর্ণতা পেল এবার। সিরি’আ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী (৬৪ বছর) কোচ হিসেবেও প্রথম শিরোপা জিতলেন স্পালোত্তি। নাপোলির অপেক্ষার ইতি টেনে দিয়ে তিনিও নেপলস ছাড়ছেন মৌসুম শেষে।

কেবল কি নাপোলির পুনর্জাগরণ? এ মৌসুমে রেনেসাঁ হয়েছে ইতালিয়ান ফুটবলেও। ১৭ বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল ইতালির তিন ক্লাব; এসি মিলান, ইন্টার মিলান ও নাপোলি। তার মধ্যে নাপোলিকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে মিলান। তবে সান সিরোতে দুই লেগেই নগর প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে ইন্টার। আগামী ১০ জুন, ইস্তাম্বুলে চতুর্থ চ্যাম্পিয়নস লিগের আশায় ম্যানচেস্টার সিটির মুখোমুখি হবে নেরাজ্জুরিা।

তবে সিটিজেনরাও ছেড়ে কথা বলবে না। পেপ গার্দিওলার অধীনে প্রথমবারের মতো ট্রেবল জয়ের স্বপ্ন দেখছে সিটি। টানা তৃতীয়বারের মতো প্রিমিয়ার লিগ জিতেছে তারা। ৩ জুন ম্যানচেস্টার ডার্বি জিতলেই এফএ কাপ চ্যাম্পিয়ন। আর ইস্তাম্বুলে প্রথমবারের মতো ইউরোপ ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট তো আছেই। নিজেদের মাঠ ইতিহাদে গত আসরসহ রেকর্ড ১৪ বারের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী রিয়াল মাদ্রিদকে শেষ চারের দ্বিতীয় লেগে গুঁড়িয়ে দিয়ে তারা যেভাবে ফাইনালে উঠেছে, বলা যায় ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে পড়তে যাচ্ছে ইন্টার। সিটিকে ক্ষুধার্ত বলাই যায়। ২০২০-২১ মৌসুমে চেলসির হাতে হৃদয় না ভাঙলে এতদিন তাদের শোকেসেও শোভা পেত ইউরোপ জয়ের মুকুট। সেবার গার্দিওলার অধীনে প্রথমবার ফাইনালে ওঠা। কিন্তু বিপুল অর্থব্যয়ে আমূল পাল্টে যাওয়া সিটি গত ছয় মৌসুমের মধ্যে পাঁচবার প্রিমিয়ার লিগ জিতলেও ইউরোপ জয় করতে পারেনি। এবার লিগ জয়ে তো নতুন এক রেকর্ডও গড়েছেন গার্দিওলা। তিন ক্লাবের (বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ ও ম্যান সিটি) হয়ে তিনবার করে তিনটি ভিন্ন লিগ জিতেছেন স্প্যানিশ কোচ। বার্সার হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলেও এখনো সিটির হয়ে সেই স্বাদ পাওয়া হয়নি তার। ইন্টার বাধা পেরোতে পারলে অমরত্বটা স্থায়ী করে নিতে পারবেন পেপ। নতুন ইতিহাস কি তিনি লিখতে পারবেন ইস্তাম্বুলে? সেই ইস্তাম্বুলে, যেখানে মাস কয়েক মাস কয়েক সময়ের স্মরণীয় ভূমিকম্প ঘটে গেছে। রাজনৈতিক কারণে ইস্তাম্বুল থেকে ভেন্যু সরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সেটি আর হচ্ছে না।

সিটি যেখানে নতুন স্বপ্নে বিভোর সেখানে আরেকটি বড় ধাক্কা খেয়েছে আর্সেনাল। বেশ কয়েক মৌসুম ধরে নিজেদের ছায়া হয়ে ছিল গানাররা। তবে এবার মিকেল আর্তেতার অধীনে ২০ বছর পর প্রিমিয়ার লিগ জয়ের স্বপ্নও দেখছিল তারা। কিন্তু ২৪৮ দিন শীর্ষে থেকেও তীরে এসে তরী ডুবে। এতদিন ধরে শীর্ষে থেকে লিগ জিততে না পারা আর কোনো ক্লাব নেই ইংলিশ ফুটবলে। হোঁচট খেয়ে খেয়ে আসা সিটির হাতে শেষ মুহূর্তে ব্যাটন তুলে দিতে হয় আর্সেনালকে। গানাররা শেষবার লিগ জিতেছিল ২০০৩ সালে, আর্তেতার গুরু আর্সেন ওয়েংগারের অধীনে।

কিন্তু এবার আশা জাগিয়েও দুইয়ে থাকতে হচ্ছে আর্সেনালকে। তবে শেষ পর্যন্ত তারা চ্যাম্পিয়নস লিগে ফিরছে, সেটিই স্বস্তির। সেরা চারে থাকতে না পারায় বেশ ক’বছর ধরে ইউরোপা লিগে খেলতে হয়েছে তাদের। তবে এবার আর্সেনালের পরিণতি হতে পারে লিভারপুলের। বেশ ক’বছর চ্যাম্পিয়নস লিগে দাপট দেখানো অলরেডদের সেরা চারে না থাকার সম্ভাবনা বেশি। প্রথমবারের মতো তাদের যে ইউরোপা লিগে খেলতে হতে পারে সেটিও ভালোভাবে বুঝে গেছেন কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। তার মধ্যে চলতি মৌসুম শেষে অ্যানফিল্ড ছেড়েছেন বেশ কয়েকজন তারকা। চলে গেছেন লিভারপুলের দীর্ঘদিনের সঙ্গী রবার্তো ফিরমিনো, জেমস মিলনার, নাবি কেইতারা।

শুধু লিভারপুল নয়, চলতি মৌসুমে ডুবেছে আরেক ইংলিশ জায়ান্ট চেলসিও। শীতকালীন দলবদলে স্টামফোর্ড ব্রিজের নতুন মালিক টড বোহেলি রেকর্ড অঙ্কের অর্থ খরচ করে খেলোয়াড় কিনেও সফলতা পাননি। লিগে কোনোভাবে অবনমন এড়িয়েছে ব্লুজরা। বরখাস্ত করেছেন একের পর এক কোচ। অবশ্য ২০২২-২৩ মৌসুমে কোচ ছাঁটাইয়ের রেকর্ডও করে প্রিমিয়ার লিগ। রেকর্ড পিছু পিছু দৌড়েছে আর্লিং হালান্ডেরও। বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ছেড়ে সিটিতে আসার প্রথম মৌসুমে গোলের পর গোল করে রেকর্ড বই ওলট-পালট করেছেন নরওয়জীয় স্ট্রাইকার। প্রিমিয়ার লিগে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড এখন তার। ঘটনার এখানে শেষ নয়, সৌদি অর্থায়নে আমূল পাল্টে যাওয়া নিউক্যাসল ২০ বছর পর ফিরেছে চ্যাম্পিয়নস লিগে। মৌসুমের শুরুর দিকে কোচ এরিক টেন হাগের সঙ্গে অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সৌদি প্রো লিগে চলে যাওয়া তো সবারই জানা।

বিতর্ক পিছু ছাড়েনি পর্তুগিজ উইংগারের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসিকেও। এই মৌসুমে তাকে পড়তে হয়েছে নিষেধাজ্ঞায়। গত মাসে পিএসজি কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে পর্যটনদূত হিসেবে সৌদি সফরে যাওয়ায় তাকে দুই ম্যাচ নিষিদ্ধ করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। এমন ধরনের নিষেধাজ্ঞায় পড়া মেসির জন্য একেবারে নতুন। তবে আর্জেন্টাইন তারকা পরে বিষয়টির জন্য ক্ষমা চান এবং তার নিষেধাজ্ঞা এক ম্যাচ কমানো হয়। আগামী জুনে পিএসজির সঙ্গে চুক্তি শেষ হচ্ছে ৩৫ বছর বয়সী তারকার। এখন জল্পনা-কল্পনাও চলছে তার পরবর্তী ঠিকানা নিয়ে। গুঞ্জন রয়েছে, সৌদি ক্লাব আল-হিলাল বিশ^রেকর্ড গড়া এক চুক্তির প্রস্তাবও দিয়েছে। পিএসজি ছাড়তে পারেন মেসির বন্ধু নেইমারও।

মেসি ফিরতে পারেন সাবেক ক্লাব বার্সাতেও। তার সাবেক সতীর্থ জাভি কোচ হিসেবে ক্যাম্প ন্যুয়ে ফেরার দ্বিতীয় মৌসুমে উদ্ধার করেছে লা লিগা। চার বছর পর লিগ জয় করে ক্লাব ছাড়ছেন বার্সার দীর্ঘদিনের সঙ্গী অধিনায়ক সের্হিও বুসকেতস ও জর্দি আলবা। গত নভেম্বরে সঙ্গী শাকিরার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ফুটবলকে বিদায় জানান বার্সার আরেক তারকা জেরার্ড পিকে। এই তিন স্প্যানিশ প্রায় ১১ বছর একসঙ্গে খেলেছেন। ক্যাম্প ন্যুয়ে এখন পুরোনো তারকাদের মধ্যে থাকলেন কেবল মিডফিল্ডার সের্হি রবের্তো ও গোলরক্ষক মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগান।

ইউরোপের তিন লিগের চলতি মৌসুমের শিরোপা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এই লেখা ছাপা অক্ষরে বের হওয়ার আগেই হয়তো শিরোপা নিশ্চিত হবে ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ান ও বুন্দেসলিগায়। লিগ ওয়ানে আর এক পয়েন্ট পেলেই আবারও শিরোপা উঠবে পিএসজির হাতে। তবে জার্মান ফুটবলে অপেক্ষা করতে হচ্ছে লিগের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত। ২৭ মে শেষ ম্যাচ খেলতে নামবে শিরোপা দৌড়ে থাকা দুই চিরশত্রু বায়ার্ন ও ডর্টমুন্ড। জিতলে বায়ার্নের পয়েন্ট হবে ৭১। তখন টানা ১১তম বুন্দেসলিগা জিততে হলে ডর্টমুন্ডের হার কামনা করতে হবে তাদের। মৌসুমের শেষদিকে এসে নিজেদের মাঠে লাইপজিগের বিপক্ষে না হারলে শিরোপা ধরে রাখতে পারত বাভারিয়ানরা। ১০ বছর পর বুন্দেসলিগার স্বাদ পেতে হলে জয়ই পেতে চাইবে ৭০ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থাকা ডর্টমুন্ড।

ইতালিয়ান ফুটবলে রেনেসাঁ ঘটলেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেছিল জুভেন্টাসের বিপক্ষে। এমনকি খেলোয়াড় কেনাবেচায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠে সিটি ও বার্সার বিরুদ্ধেও। মৌসুমের শুরুর দিকে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পদত্যাগ করেন জুভ কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকজন। পরে তুরিনের বুড়িদের পয়েন্টেও কেটে নেওয়া হয়। অবশ্য পরে পয়েন্ট ফেরত দেওয়া হলেও এখন নতুন করে আবারও একই শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছে জুভেন্টাস। এবারই তিন ইতালিয়ান ক্লাব উয়েফার তিন টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলবে। চ্যাম্পিয়নস লিগে ইন্টার, ইউরোপা লিগে রোমা ও কনফারেন্স লিগে ফিওরেন্তিনা। এখন দেখার বিষয়, কয়টি শিরোপা ঘরে তুলতে পারে গত দুই বিশ্বকাপে দর্শক হয়ে থাকা আজ্জুরিরা।

তবে সব চোখ থাকবে চ্যাম্পিয়নস লিগের ইন্টার-সিটি বা ‘আন্তঃনগর’ ফাইনালের দিকে। ইন্টার ইতিমধ্যে কোপা ইতালিয়া জিতে সিটিকে হুমকিও দিয়ে রেখেছে। তবে সেসব যেন থোড়াই কেয়ার করেন গার্দিওলা। সিটিজেনরা প্রথমবারের মতো ইউরোপের সিংহাসনে বসার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছেন। এক ক্ষুধার্ত বাঘের সঙ্গে অভিজ্ঞ কুমিরের লড়াই— ইস্তাম্বুল স্বাক্ষী হতে যাচ্ছে যার। ২০০৫ সালে এই ইস্তাম্বুলেই লেখা হয়েছিল ফুটবল বিশে^র সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ম্যাচটি। সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল হয়েছিল লিভারপুল ও এসি মিলানের মধ্যে। প্রথমার্ধে ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও দ্বিতীয়ার্ধে সমতায় ফেরে অলরেডরা। অনন্য কামব্যাকের গল্প লেখে টাইব্রেকারে জিতে উল্লাসে মাতে লিভারপুল। ইংলিশ-ইতালিয়ান লড়াইয়ে এবারও কি তেমন কিছু উপহার দেবে ইস্তাম্বুল।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন:খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fifteen + 18 =