মা দিবসের কিছু অজানা তথ্য

পৃথিবীর সব দেশেই উদ্্যাপিত হয় মা দিবস তবে ভিন্ন ভিন্ন দিনে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত দিনটি হচ্ছে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার। আর সে অনুযায়ী এবছর ১৪ মে সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হবে মা দিবস। মা দিবসে মা’কে নিয়ে অজানা কিছু তথ্য খুঁজে বের করেছি আমরা। তা নিয়েই আজকের আয়োজন।

আনা মারিয়া জার্ভিস যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস প্রতিষ্ঠাতা

আনা মারিয়া জার্ভিস ১৮৬৪ সালের ১লা মে ভার্জিনিয়ার টেলর কাউন্টির ওয়েবস্টারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন সমাজকর্মী ছিলেন। মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। আনা জার্ভিস তার মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। তিনি বিয়ে করেননি সেহেতু তার মা-ই ছিল তার সবকিছু। ১৯০৫ সালে আনার মা মারা যাওয়ার পর একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে যান তিনি। তার মা জীবিত অবস্থায় প্রায়শই মা দিবসকে কেন্দ্র করে ছুটি প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। ১৯০৭ সালে মা দিবসের প্রয়োজনীয়তা প্রথম অনুভব করেন এই আমেরিকান। তিনি অনুভব করলেন মা বেঁচে থাকতেই সবার উচিত মায়ের সঠিক মর্যাদা দেওয়া। আর এই লক্ষ্যেই আনা তার মায়ের মৃত্যু দিনটিকে মা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যান। ১৯০৮ সালের ১০ই মে, তার মায়ের মৃত্যুর তিন বছর পর, জার্ভিস অ্যান্ড্রুজ মেথডিস্ট এপিস্কোপাল চার্চে তার মা এবং সমস্ত মায়েদের সম্মান জানাতে একটি স্মরণসভা করেন। তার সাত বছরের চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় মা দিবস। ১৯১১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যে মা দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের আনা জার্ভিস ও তার মেয়ে আনা মারিয়া রিভস জার্ভিসের উদ্যোগে প্রথম মা দিবস পালিত হয়।

সর্বপ্রথম মা দিবসে ছুটি ঘোষণা

উড্রো উইলসন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম সমাদৃত প্রেসিডেন্ট। উড্রো উইলসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৮তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি একজন পণ্ডিত ও শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন এবং পরবর্তীতে নিউ জার্সির সংস্কারমনা গভর্নর হিসেবে জাতীয় স্বীকৃতি লাভ করেন। গভর্নর হওয়ার দুই বছর পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি সর্বপ্রথম মা দিবসকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন।

মা দিবসের প্রতীক কার্নেশন ফুল

মা দিবসের উপহার হিসেবে সাদা কার্নেশন ফুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে পশ্চিমা বিশ্বে। মূলত কারণটা হচ্ছে আনা জাভিয়ার্সের মায়ের পছন্দের ফুল ছিল কার্নেশন ফুল। তাই এই ফুলটিকে মা দিবসের প্রতীকও বলা হয়। তবে এখন সাদা ও লাল রঙের কার্নেশন ফুল দেওয়া হয়। লাল ফুল যাদের মা বেঁচে আছেন তাদের জন্য আর সাদা ফুল যাদের মা বেঁচে নেই তাদের জন্য। কার্নেশন বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম ডায়ান্থাস ক্যারিওফাইলাস। ডায়ান্থাস শব্দের অর্থ হচ্ছে স্বর্গীয় ফুল। বাগানে তিন প্রকার কার্নেশনের চাষ হয়ে থাকে। বর্ডার কার্নেশন, পারপ্যাচুয়েল ফ্লাওয়ারিং এবং মার্গারিট। ফুলটি দেখতে অনেকটা গোলাপের মতো। গোলাপি, লাল, হলুদ, সাদা এই চার রঙের হয়ে থাকে ফুলটি। আকারে ও বর্ণে গোলাপ ফুলের পরেই এই ফুলের অবস্থান।

একজন মা গড়ে কত ঘণ্টা কাজ করেন

প্রতিটি মা একেকটা অলরাউন্ডার। তারা পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। তাদের কাছে সবকিছুই সম্ভব। একজন মা সন্তান গর্ভে আসার পর বড় হওয়ার পর পর্যন্ত প্রতিটি দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন শুধুমাত্র সন্তানের মঙ্গলের জন্য। সময় যতই গড়াতে থাকে মায়েদের সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, শিশু রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিবার পালনসহ একজন মা গড়ে প্রতিদিন ১৪-১৮ ঘণ্টা কাজ করেন।

একজন মা গড়ে প্রতিদিন কতবার সন্তানের কথা ভাবেন

আপনি হয়তো এইতো তথ্যটা জেনে অবাক হবেন। আপনার ছানা দুটো বড় হয়ে যাবে কিংবা চোখ কপালে উঠে যাবে তবুও এটাই সত্য। প্রতি চার মিনিটে একজন মা একবার তার সন্তানের কথা ভাবেন। এই সমীকরণে প্রতিদিন গড়ে ২১০ বার সন্তানের কথা চিন্তা করেন একজন মা। এই তথ্যটা জানা যায় এক গবেষণায়। আপনি হয়তো ভাববেন আসলেই এটা সম্ভব। এই পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে বেশি আর কেউ আপআকে নিয়ে ভাবে না। একজন মা সবসময়ই তার সন্তানকে নিয়ে ভাবে। এটা তার নিঃশ্বাস নেওয়ার মতোই।

মা দিবসে সবচেয়ে বেশি ফোন কল হয়

মা দিবসে দিনের যেকোনো মুহূর্তে মায়ের সঙ্গে কথা বলা চাই। হয়তো সারাবছরে একবারও ফোন করে মায়ের খোঁজ নেওয়া হয়নি কিন্তু এই দিনে মায়ের সঙ্গে কথা বলতেই হবে। সবচেয়ে বেশি ফোন কল আসে বিদেশে থেকে। কেননা মা দিবসে ফুল বা কার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে পারে না তারা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য বিশেষ দিনগুলোর চেয়ে এ দিনটিতে সবচেয়ে বেশি ফোন কল হয়। মে মাসের দ্বিতীয় রোববার সারাবিশ্বে প্রায় ১২০ মিলিয়ন কল করা হয়।

২০২৩ সালে মা দিবসের উদযাপন

এক রিপোর্টে জানা যায়, সারাবিশ্বে ২০২৩ সালে মা দিবস উপলক্ষ্যে ব্যয় করা হবে ৩৫.৭ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি কিংবা এরচেয়ে বেশি। একজন ছেলে কিংবা মেয়ে ২৭৪.০২ ডলার খরচ করার পরিকল্পনা করছে তার মায়ের জন্য যা ২০২২ সালে ছিল ২৪৫.৭৬ ডলার। বিশ্বব্যাপী জুয়েলারি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলে ধারণা করছে মাদার্স ডে তে জুয়েলারি কেনার জন্য সন্তানেরা প্রায় ৭.৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করবে।

মাদারিং সানডে

রবিবার মা দিবস উদ্যাপন করার জন্য বিশ্বের অনেক দেশে মাদারস ডে ‘মাদারিং সানডে’ নামেও পরিচিত। ২০২১ সালে ‘মাদারিং সানডে’ নামের একটি সিনেমা নির্মাণ করেন ইভা হুসন। সিনেমাটির চিত্রনাট্য লিখেন অ্যালিস বার্চ। ব্রিটিশ রোমান্টিক ড্রামা ফিল্মটি গ্রাহাম সুইফটের একই নামের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে। ছবিতে অভিনয় করেছেন ওডেসা ইয়াং, জোশ ওকনর, অলিভিয়া কোলম্যান এবং কলিন ফার্থ।

মা দিবসে কত কার্ড বিলি করা হয়

মাদারস ডে কার্ড কিন্তু বেশ জনপ্রিয় বহির্বিশ্বে। আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে এটার চাহিদা কম। বন্ধুবান্ধব বা কাছের মানুষদের বিশেষ দিন কিংবা কোনো উপলক্ষ্যে কার্ড গিফট দেওয়া হয় হরহামেশাই। কিন্তু সব উপলক্ষ্যে মাকে আর কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয় না। তবে প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে মা দিবসে প্রায় ১৫ কোটির বেশি কার্ড বিলি হয় মায়েদের কাছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ ধ্বনি মা

‘মা’ ধ্বনিটি সবচেয়ে সহজ। হয়তবা এই কারণে পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষায় মা অর্থবোধক শব্দে ‘মা’ শব্দটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কারণ, মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে সবচেয়ে সহজ ভাষায় ডাকতে পছন্দ করে। অধিকাংশ ভাষায়ই ‘মা’ শব্দের সমার্থক শব্দটি শুরু হয় ‘ম’ দিয়ে। ইংরেজি ভাষায় বাংলা ‘মা’ এর শব্দ হল, মাদার। দেখা যাচ্ছে, ‘ম’ রয়েছে। আরবী ভাষায় ‘মা’ এর শব্দ হল ‘উম্ম’, দেখা যাচ্ছে ‘ম’ আছে। উর্দু ভাষায় ‘মা’ এর শব্দ হল ‘মা’ এখানেও ‘ম’ আছে। সংস্কৃত এবং হিন্দি ভাষায় ‘মা’ এর শব্দ হল ‘মাতা’ এখানেও ‘ম’ আছে। রাশিয়ান ভাষায় বলা হয়, ‘মাতি’ এখানেও ‘ম’ রয়েছে। গ্রীক ভাষায় বলা হয়, ‘মাতা’ এখানেও ‘ম’ আছে। হলেন্ডী ভাষায় বলা হয় ‘মড্যের’ এখানেও ‘ম’ আছে। ফ্রেঞ্জ ভাষায় বলা হয় ‘ম্যারে’ এখানেও ‘ম’ আছে। জার্মানি ভাষায় বলা হয় ‘মুতার’ এখানেও ‘ম’ আছে। ফার্সি ভাষায় বলা হয়, ‘মাদার’ এখানেও ‘ম’ আছে। এছাড়া আমাদের দেশে মাকে আরও বলা হয় আম্মা, আম্মু, আম্মি বা মাম্মী। এখানেও দেখা যাচ্ছে ‘ম’ আছে।

এক মায়ের ৬৯ জন সন্তান

সবচেয়ে বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড এ নাম রয়েছে তার। রাশিয়ার মস্কোর সুইয়া নামক গ্রামের এক কৃষক ফেদেরাও ভাসিলিয়েভের স্ত্রী মিসেস ভাসিলিয়েভ ৬৯ জন সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। তিনি তার জীবনে সর্বমোট ২৭ বার গর্ভধারণ করেন। ১৭২৫ সাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ বছর তিনি গর্ভধারণ করেই কাটিয়েছেন। তিনি একসাথে ৪ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন ৪ বার, একসাথে ৩ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন ৭ বার, যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন ১৬ বার। ৬৯ জন জন্ম দেওয়া শিশুর মধ্যে ২ জন শৈশবে মারা যায়। বাকি ৬৭ জন সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে ছিলো। ১৭ শতকের এই রাশিয়ান নারী আজকের দিনে জীবিত থাকলে মনে হয় সবচেয়ে বেশি মা দিবসের শুভেচ্ছা তিনি পেতেন। কারণ ৬৯ সন্তানের জননী ছিলেন তিনি।

একসঙ্গে নয় সন্তানের জন্ম দিয়ে বিশ্বরেকর্ড

একসঙ্গে দুটি সন্তানের জন্ম দেওয়া সাধারণ ব্যাপার। তিনটি সন্তানের একসঙ্গে জন্ম দেওয়ার কথাও শোনা গিয়েছে। তবে একসঙ্গে নয়টি সন্তানের জন্ম দেওয়ার ঘটনা কখনো শুনেছেন কি। বাস্তবে এমনটাই ঘটেছে মরক্কোয়। একসঙ্গে কেবল নয়টি সন্তানের জন্ম দেওয়া নয়, মা এবং নয়টি শিশু প্রত্যেকেই সুস্থ ছিল। যা বিরল। আর তাই ২০২২ সালে গিনেস বুকে নাম তুলে রেকর্ড গড়েছিলেন মরক্কোর নারী হালিমা সিজে। ৯ সন্তানের মধ্যে ৫টি শিশুকন্যা এবং চারটি শিশুপুত্র। আরেকটা তথ্য জানিয়ে রাখি, প্রতি ৯০ সেকেন্ডে গর্ভপাত ও সন্তান জন্মদানের কারণে একজন মা মারা যান।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 + sixteen =