শাকিরা: বিশ্বসংগীতে এক উন্মাদনা

অপরাজিতা জামান

মেয়েটি ছিল ভীষণ দুষ্টু। এ কারণে মাঝে মাঝেই ক্লাস থেকে শিক্ষক বের করে দিতেন তাকে। তবে অন্যান্য দিন তিরস্কার করলেও এই মেয়েকেই রোজ শুক্রবার বেশ কদর করতেন তারা। কেননা মেয়েটি বেলি ড্যান্সে বেশ পটু ছিল। এই বেলি ড্যন্স দেখতেই শিক্ষক ও সহপাঠীদের কাছে সমাদর বেড়ে যেত তার। পরবর্তী সময়ে তার এই বেলি ড্যান্সের জাদুতে মোহিত হয় গোটা বিশ্ব। তবে ছোট সে মেয়েটি শুধু নাচেই সেরা ছিল না। সংগীত প্রতিভাও ছিল সেই ছোট বয়স থেকেই। মাত্র চার বছর বয়সে কবিতায় সুর দিয়েছিলেন তিনি। আর আট বছর বয়সে বেঁধেছিলেন প্রথম গান। শিল্পী জীবনের শুরুতে এই গান দিয়েই শুরু হয়েছিল তার পথচলা।

শাকিরার কথা বলছিলাম। যিনি একই সাথে মোহনীয় কণ্ঠ ও বেলিড্যান্সের জন্য বিখ্যাত। তার নাম শুনলেই মনে পড়ে সেই জনপ্রিয় গান। ‘সামিনা মিনা এ এ ওয়াকা ওয়াকা এ এ..’। আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের গান এটি। গানটি এখনও আবেদন ছড়ায়। শাকিরা জন্মগতভাবে একজন কলোম্বিয়ান। তার পুরো নাম শাকিরা ইসাবেল মেবারাক রিপল। ১৯৭৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কলোম্বিয়াব বাররানকুইলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার মা নিদাইয়া দেল কারমেন। আর বাবা রিপোল তোর্বাদো। তিনি ছিলেন লেবানন বংশোদ্ভূত। শাকিরারা ছিলেন আট ভাইবোন। গানের আগে শাকিরার মাঝে উঁকি দিয়েছিল কাব্য প্রতিভা। মাত্র চার বছর বয়সে প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন তিনি। আর সংগীত তার ভিতরে বাসা বাঁধে বয়স যখন সাত। এর পেছনে একটি গল্প রয়েছে। সেসময় শাকিরার এক ভাই মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। এই শোক ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল তার বাবাকে। দীর্ঘ চার বছর কালো চশমায় আড়াল করে রেখেছিলেন নিজের চোখ দুটি। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছিল শাকিরাকে। এই ভাবনা থেকেই তিনি লিখেছিলেন নিজের প্রথম গান ‘তুস গ্রাফাস ওসকুরাস’ যার অর্থ ‘তোমার কালো চশমা’।

সংগীতাঙ্গনে শাকিরার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৩ বছর বয়সে। তবে তার চলার পথটা মসৃণ ছিল না। ১৯৯১ সালে বাজারে আসে তার প্রথম অ্যালবাম ম্যাগিয়া। আট বছর বয়সে বাবাকে নিয়ে লেখা সেই গানওটি ছিল এখানে। কলোম্বিয়ান প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সনি মিউজিকের ব্যানারে মুক্তি পেয়েছিল অ্যালবামটি। তবে ফলাফল প্রত্যাশিত ছিল না। বিশ্বব্যপী মাত্র ১২০০ কপি বিক্রি হয়েছিল। তবে ‘ম্যাগিয়া’ অ্যালবাম দিয়ে একটি পরিচিতি তৈরি হয়েছিল শাকিরার। ফলে চিলির একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে ল্যাটিন আমেরিকার উদীয়মান গায়িকা হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।

ভিনা ডেল মার ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যালে একজন উদীয়মান গায়িকা হিসেবে গান পরিবেশনের সুযোগ পান। এ উৎসব থেকে ফিরে শাকিরা মনযোগী হন তার দ্বিতীয় অ্যালবাম নিয়ে। ‘পেলিগরো’ নামের এই অ্যালবামটির প্রায়োজনায়ও ছিল সনি। আবারও ব্যর্থতা আসে তার ক্যারিয়ারে। তবে ম্যাগিয়ার চেয়ে ভালো ছিল দ্বিতীয় অ্যালবামটির বাজার। কিন্তু এতে মন ভরল না প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটির। তারা শাকিরার অ্যালবামে আর লগ্নি করবেন না এমন সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এবার ভাগ্য অনুকূলে ছিল তার। প্রতিষ্ঠানটির এই মান ভাঙাতে সক্ষম হন শাকিরা। এক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করে তার ‘ডোনড এসটাস কোরাজন’ গানটি। দ্বিতীয় অ্যালবামে ব্যর্থতার পর গানটি প্রকাশ হয়। বাজারে আসার পরপরই অভাবনীয় সাফল্য পায় এটি। এতে টনক নড়ে সনি’র। আরেকবার শাকিরার অ্যলবামে লগ্নি করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। শেষবারের মতো প্রতিষ্ঠানটি তার তৃতীয় অ্যালবামে লগ্নি করে। ঘটনাটি ১৯৯৫ সালের। এবার তৈরি করেন তৃতীয় অ্যালবাম ‘পিয়েস ডেসকালজোস’। সে বছরের অক্টোবরে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে মুক্তি পায় অ্যালবামটি। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এটি মুক্তি পায় মার্কিন মুলুকে। এবার আর ভাগ্য বিরোধিতা করেনি তার সাথে। সাফল্যের মুখ দেখেন শাকিরা। মুক্তির পরই শ্রোতাদের মাঝে আলোড়ন তৈরি করে অ্যালবামটি। এক লাফে ল্যাটিন আমেরিকার টপচার্টে রাজত্ব শুরু করে। এ অ্যালবামের প্রতিটি গানই অর্জন করেছিল ধুন্ধুমার জনপ্রিয়তা। ফলে তারকাখ্যাতি পেয়ে যান শাকিরা।

তৃতীয় অ্যালবামে অভাবনীয় সাড়া পাওয়ার পর ১৯৯৬ সালের মার্চে ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক সফরে বের হন শাকিরা। ‘ট্যুর পাইজ ডেসকালোজ’ নামের এ সফরে ২০টি শো’য়ে অংশ নেন তিনি। সফরটি শেষ হয় ১৯৯৭ সালে। বছরটি সাফল্যে ছিল ভরপুর। পিয়েস ডেসকালেজোস অ্যালবামটি তাকে এনে দেয় তিনটি ল্যাটিন মিউজিক অ্যাওয়ার্ড। পান বেস্ট নিউ আর্টিস্টের পুরস্কার। অ্যালবামটিও করেছিল ধুন্ধুমার ব্যবসা। মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে যায় এর পাঁচ মিলিয়ন কপি। এরপর পরিচিত কিছু গান নিয়ে দ্য রিমিক্স নামে একটি অ্যালবাম করেন শাকিরা। এটিও দেখে সাফল্যের মুখ।

পরপর দুটি অ্যালবামের সাফল্যে শাকিরা ততদিনে শ্রোতাদের কাছে হয়ে উঠেছেন ভালোবাসার নাম। পপ সংগীতে নিজের একটি জায়গাও হয়ে উঠেছে। ১৯৯৮ সালে তিনি এবার হাত দেন তার চতুর্থ অ্যালবামের কাজে। এবার আর সনি’র শরণাপন্ন হননি। অ্যালবাম প্রযোজনার করেন নিজেই। তার সঙ্গে এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার হিসেবে ছিলেন ইমিলিও ইস্তেফার। অ্যালবামটির নেপথ্যে একটি গল্প রয়েছে। সেসময় বিমানবন্দরে এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে গায়িকার সাথে। নিজের সুটকেস হারিয়ে ফেলেন তিনি। তাতে ছিল তার গানের খাতাটিও। এ ঘটনায় প্রভাবিত হয়েই অ্যালবামটি তৈরি করেন তিনি। ‘ডোনড ইস্টার্ন লস লাড্রোনস’ নামের এই অ্যালবামটিকে শাকিরার ক্যারিয়ারের মাইল ফলক বলা যেতে পারে। বিলবোর্ডে ১১ সপ্তাহ ধরে নিজের রাজত্ব ধরে রেখেছিল অ্যালবামটি। বিশ্বব্যাপী সাত মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছি এটি। ফলে আটটি গানে সাজানো এ অ্যালবামটি বেস্ট সেলিং স্প্যানিশ অ্যালবামের সম্মান অর্জন করে। পরের বছরই বিশ্ব সংগীতের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড’ থেকে নমিনেশন পান তিনি। এই নমিনেশন ছিল ‘বেস্ট লাটিন রক অর অল্টারনেটিভ’ অ্যালবাম ক্যাটাগরিতে। সংগীতের রেসে শাকিরা তখন প্রতাপশালী ঘোড়া। তার গানের জন্য মুখিয়ে থাকতেন শ্রোতারা। এই সাফল্যের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে পরের বছর আরও একটি অ্যালবাম বাজারে আনেন শাকিরা। ‘এমটিভি আনপ্লাগড’ নামের এই অ্যালবামটি ছিল তার ক্যারিয়ারের প্রথম লাইভ অ্যালবাম। অ্যালবামটি আজও তার লাইভ অ্যালবামগুলোর মধ্যে সেরা বলে বিবেচিত হয়।

এ অ্যালবামটি শাকিরাকে এনে দেয় ‘এমটিভি ভিডিও মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’। এছাড়া সেবছর ‘ল্যাটিন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে’ পাঁচটি ক্যাটাগরিতে মনোনীত হন তিনি। ডোনড ইস্টান লস লাড্রোনস ও এমটিভি আনপ্লাগড সাফল্যের পর ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করেন তিনি। হাত দেন ইংরেজি গানের অ্যালবাম তৈরির কাজে। এই অ্যালবামের ‘হয়ারেভার হয়ারেভার’ গানটি প্রথম মুক্তি দেওয়া হয় স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের মাঝে। পরে এ ইংলিশ অ্যালবামটি মুক্তি দেওয়া হয় ইংরেজি ভাষাভাষীদের মাঝে। প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে এটি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি শাকিরাকে। একের পর এক অ্যালবাম দিয়ে পপসংগীতের রানির আসনটি নিজের করায়ত্তে রাখেন তিনি। ২০০৮ সালে প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফোর্বসের জরিপে সর্বোচ্চ উপার্জনকারী নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে উঠে আসে তার নাম। সেবছরই লাইভ ন্যাশনের সঙ্গে দশ বছরের জন্য একটি চুক্তি করেন শাকিরা। এজন্য পারিশ্রমিক হিসেবে তার অ্যাকাউন্টে জমা হয় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ঠিক দশ বছর পরই শাকিরা পান তৃতীয়বারের মতো ‘গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড’। বেস্ট ল্যাটিন পপ অ্যালবাম বিভাগে তিনি এ পুরস্কার অর্জন করেন। এই বিজয়রথ এখনও অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে শাকিরার। প্রতারক প্রেমিক পিকে’কে নিয়ে লেখা তার সবশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত গানটির জনপ্রিয়তাই সে প্রমাণ দেয়।

বিশ্বখ্যাত পপ গায়িকা শাকিরা ব্যক্তিগত জীবনের একাধিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন। ২০০০ সালে মন দিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন আইনজীবী অ্যান্টোনিও ডে লা রুয়াকে। দীর্ঘ দশ বছর তার সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সংসার করেন তিনি। এরপর শাকিরা সম্পর্কে জড়ান স্পেনের তারকা ফুটবলার পিকে’র সঙ্গে। তার সঙ্গেও ছিল তার এক দশকের বিবাহবহির্ভূত সংসার। এ সংসারে দুটি সন্তানের জন্ম দেন শাকিরা। তারপরও শেষটা সুখের হয়নি। আফ্রিকায় আয়োজিত বিশ্বকাপের মাঠ থেকে যে প্রণয় শুরু হয়েছিল পিকে’র সাথে গত বছর তা তিনি ছিন্ন করেন পরকীয়ার অভিযোগ এনে। পিকেকে পরনারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছেন দাবি করেন তিনি।

তবে ব্যক্তিগত জীবনে শাকিরার সম্পর্কের উত্থান পতন থাকলেও ক্যারিয়ারে তা দৃশ্যমান না। তৃতীয় অ্যালবামটি যে তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছিল তাকে তা আর কখনও ছেড়ে যায়নি। তিনবার গ্র্যামি ও বারোবার ল্যাটিন গ্র্যামি কবজা করেছেন তিনি। এছাড়া অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার তো রয়েছেই। বহুমুখী গুণে গুণান্বিত শাকিরা। একাধারে সুরকার, গীতিকার ও সংগীতশিল্পী। অভিনয়েও দখল রয়েছে তার। বেশকিছু টেলিভিশন সিরিজ ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। শাকিরা এখনও পপসংগীতে উন্মাদনার আরেক নাম।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

18 − 14 =