মোতাহার হোসেন
বিগত ৫৮ বছরের রের্কড ভেঙ্গে ঢাকাসহ সারাদেশের তাপমাত্রা এবার পৌঁছেছে প্রায় ৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। তীব্র তাপদাহে মানুষ, প্রাণীকূল,পশুপাখীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। তীব্র তাপদাহে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাটি চিরে চৌচির। সঙ্গে হাওর,বাওর, পুকুর,খাল,বিল,জলাশয়ের পানি হ্রাস পাচ্ছে দ্রুতগতিতে। এ অবস্থায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা,উপজেলায় বোরোতে পানি সেচ দিতে নলকূপ থেকে প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছেনা। অনুরুপ পুকুর,জলাশয়ও শুকিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। গ্রামে নলকূপ থেকে পানি ওঠছেনা। খাবার পানির সংকট হচ্ছে। আবার অনেক সময় আমরা নিজেদের স্বার্থে পুকুর,জলাশয় নদী নালা ভরাট করে নির্মাণ হচ্ছে স্থাপনা। এতেও তাপদাহকে আরও তীব্র করে তুলছে। আর তাছাড়া এবার গরমের আদ্রতা,প্রখরতা চলছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। এরমধ্যে কিছু কিছু বৃষ্টি হলেও বৃষ্টি শেষ হলে আবার গরমের আধিক্য বাড়ে।
মাত্রাতিরিক্ত গরমে মানুষ যেমন হিটস্ট্রোক করে, তীব্র তাপদাহে গাছগাছাািলর সঙ্গে চলমান বোরো মৌসুমে ধানগাছও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে বোরো মৌসুমে বোরো উৎপাদন মারাত্নক ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন কৃষি বিশেষজ্ঞ ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা,উপজেলায় তীব্র তাপদাহের কবলে পড়ে ধানের সবুজ বর্ণ পাতায় লাল বর্ণ ধারন করে, ধানের ফুল পুড়ে দানা চিটা হয়ে যায়। মূলত ধানের ফুল ফোটার সময়ই এ ধরনের ক্ষতি হয়। বর্তমানে এ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের প্রধান ফসল বোরো উৎপাদন। এপ্রিল-মে দেশের কৃষির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই মাস। হাওরের ধান পেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। কারণ কাটার জন্য দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিশ্রমিকেরা সেখানে যেতে পারছেন না।
তদুপরি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বাড়ছে ভারি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। গলছে হিমালয়ের বরফ। বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। এ সব কারণে সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত আসছে বাংলাদেশের কৃষি খাতের উপর। যদিও বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান হচ্ছে ১৪.২২ শতাংশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে এবং বৃষ্টিপাতের ধারা পরিবর্তন হয়ে দেশে ঘন ঘন জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। দেখা দিচ্ছে তীব্র খরা। যা দেশে কৃষি উৎপাদনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ’র (আইপিসিসি) হিসেব অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ৩২ শতাংশ এবং গম উৎপাদন আট শতাংশ হ্রাস পাবে।
বোরো মৌসুম শুরু হয় শীতে নভেম্বর (কার্তিক-অগ্রাহয়ণ) মাসে। আর শেষটা হয় চরম গরমের এপ্রিল-মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসে। ধানের জন্য ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা হলে পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ফুল ফোটার সময় এক-দুই ঘণ্টা এ তাপমাত্রা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়। দেশে ২০২১ সালে এ ধরনের হিটশকের ঘটনা ঘটে। ওই বছর প্রায় অর্ধলাখ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে যায়।
‘অতিরিক্ত তাপমাত্রা বাড়া অথবা কমার কারণে হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিটশকের মাত্রা ধরা হয়। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। এমন হতে পারে। ঝুঁকি রয়েছে। ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজে এটা ক্ষতি খুব বেশি করে। এ সময়কে সবচেয়ে ভার্নারেবল অবস্থা ধরি আমরা। সে সময় গরম বাতাসের কারণে ধানের শীষ থেকে পানি বেরিয়ে যায়। ফুল শুকিয়ে যায়। ফলে ধান চিটা হয়ে যায়। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। এ ঘটনা আগেও হয়েছে। তবে এত বিস্তর এলাকায় ক্ষতি হয়নি।
‘হিটশক’ দেশে নতুন নয় উল্লেখ করে গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তার মন্তব্য, ২০১২ সাল থেকে হিটশকের তথ্য রয়েছে। এ পর্যন্ত যশোর সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে হিটশক হয়েছে। তবে কখনো গ্রামের এক-দুটি মাঠে বা কোনো একটি এলাকার ক্ষেতে হয়েছে। বড় হিটশক ২০২১ সালে প্রথম হয়। ওই বছর ৪ এপ্রিল একসঙ্গে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা, গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ জেলাসহ কিছু অঞ্চলে হিটশক হয়েছিল। এ বছর বৈশাখ মাসেও বৃষ্টি না থাকায় সে আশঙ্কা রয়েছে। বৈশাখি গরম হাওয়া হলে ক্ষতি হয়। সাধারণত কালবৈশাখের পরে বৃষ্টি হয়। তাই তাপমাত্রা কমে যায়, এবছর সেটা হচ্ছে না।
এখন সারাদেশেই তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে কৃষি ও মাঠ ফসলের সুরক্ষায় বেশ কিছু সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। বিশেষ করে যেখানে এখন ধান ফ্লাওয়ারিং স্টেজে রয়েছে, সেখানে হিটশকের আশঙ্কা বেশি। সে কারণে তাপ প্রবাহের ক্ষতি থেকে ধান রক্ষার জন্য বোরো ধানের জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই দুই থেকে তিন ইঞ্চি পানি রাখতে হবে। প্রসঙ্গত:দেশে বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে মোট উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশের বেশি আসে বোরো মৌসুম থেকে। তাই খাদ্য নিরাপত্তায় এ মৌসুমকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় সরকার। চলতি মৌসুমে মোট ৫০ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ টন। এ জন্য চাষ করা হচ্ছে হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের ধান। গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ লাখ ৭২ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৪৯ লাখ ৫১ হাজার হেক্টর জমিতে। গত বছর চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই কোটি নয় লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ টন।
চলতি মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ প্রায় চার শতাংশ বেড়েছে। এ বছর মোট কম বেশি ৫০ লাখ ৭৭ লাখ ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর বোরো মৌসুমে সফলভাবে ধান ঘরে তোলা খুবই চ্যালেঞ্জিং। কারণ আকস্মিক বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে হাওরের ধান ঠিকমতো ঘরে তোলা নিয়ে প্রতিবছরই আতঙ্কে থাকতে হয় কৃষকদের। আর এবার বোরোর জন্য নতুন আতঙ্ক হচ্ছে,‘হিটশক’। এমনিতেই কৃষি জলবায়ুর প্রভাব নির্ভর একটি অনিশ্চয়তার পেশা, বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য জয়ের লড়াইয়ে নিয়োজিত দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের একটি তীব্র ঘনবসতিপূর্ণ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১১৪৬ জন মানুষ বসবাস করে। এ দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ কৃষি এবং শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ মানুষ কৃষি খাতে নিয়োজিত। মাত্র ৮৭ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমি থেকে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের অন্ন সংস্থান হচ্ছে। এমনিতে বাংলাদেশে কৃষিজমির পরিমাণ প্রতিবছর অন্তত ১ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক চাষযোগ্য জমিতে চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের বীজ ও জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে। আর আবাদযোগ্য কোনো জমি পতিত রাখা যাবে না। এসব নিশ্চিত করা গেলে দেশের খাদ্য উৎপাদন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে।পুষ্টি একক কোনো কাঠামো নয়। এটি একটি বহুমুখী বিষয়। আসলে খাদ্য ছাড়া পুষ্টি সম্ভব নয়। আবার খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হলে খাদ্য সরবরাহ,প্রাপ্যতাও ব্যাহত হবে। খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে দুর্যোগ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন সরাসরি সম্পৃক্ত। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য নির্মম বাস্তবতা। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নির্ভর কৃষি একটি অনিশ্চয়তার পেশা। একই সঙ্গে কৃষি উৎপাদনেও ঝুঁকি বাড়ায়। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জীবন-জীবিকা ৪টি খুঁটির উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, এর অন্যতম হচ্ছে কৃষি। যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে তীব্র তাপদাহে ( ৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস) চলতি বোরো উৎপাদনকে হুমকিতে ফেলছে। এমনি অবস্থায় ভবিষ্যতে এ ধরনের তীব্র তাপদাহ হতে পারে এই বিবেচনায় নিয়ে বোরোসহ সব রকম কৃষিজ ফসল উৎপাদনে তাপ সহনীয় জাতের ধান,ফসলের বীজ উৎপাদন, গবেষণায় মনোযোগী হওয়া দরকার কৃষি বিজ্ঞানীদের। তা শুরু করতে হবে এখন থেকেই। অন্যথা খাদ্য নিরাপত্তায় সংকট দেখা দেবে, তখন টাকা হলেই চাল পাওয়া যাবেনা।
লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম
পিআইডি ফিচার