এই দশকেই মানুষ বাঁচবে দেড়শ বছর

মাহবুব আলম

অমরত্বের প্রত্যাশা না থাকলেও মানুষ কিন্তু দীর্ঘায়ু কামনা করে। আমাদের দেশে নানা দাদা সহ মুরুব্বি স্থানীয় ব্যক্তিরা তাদের নিজ বাড়িতে প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়দের সন্তান হলে শতায়ু কামনা করে দোয়া আশীর্বাদ করেন। এখন নয়, অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে এই রীতিনীতি রেওয়াজ চলে আসছে। এমনকি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই শতকরা ৫০ ভাগের বেশি সন্তানের মৃত্যু হতো তখন এইভাবেই সদ্যজাতসহ বিভিন্ন বয়সী সন্তানদের দীর্ঘায়ু কামনা করা হতো। কিন্তু প্রত্যাশা আর বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় অগ্রগতির পরও আজকের বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু মাত্র ৭২ বছর ৬ মাস। জাতিসংঘের এক সমীক্ষা রিপোর্টে এই তথ্য জানান হয়েছে। সমীক্ষা রিপোর্ট বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বে জাপানে মানুষ বেশি দিন বাঁচে। জাপানিদের গড় আয়ু ৮৩ বছর। অন্যদিকে অশিক্ষা ও অভাবগ্রস্ত দেশ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়েতে মানুষ সবচেয়ে কম বাঁচে। এই দুই দেশের মানুষের গড় আয়ু ৪২ বছর। মাত্র ৭৬ বছর আগে আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪২ বছরের কম। এক গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩২ বছর। শরৎচন্দ্রের বিভিন্ন উপন্যাসসহ বিভিন্ন গল্পগ্রন্থেও এমনটি বলা হয়েছে। এক সময় এদেশে প্রবাদ ছিল কুড়িতেই বুড়ি। সত্যি তাই ছিল। মাত্র ৭৬ বছরে আমাদের দেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। সর্বশেষ সমীক্ষায় ২০২১ অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর ৩ মাস। ভারতের গড় আয়ু ৬৯ বছর ৭ মাস। পাকিস্তানের গড় আয়ু ৬৭ বছর ৩ মাস।

শুধু ভারতবর্ষ নয় বিগত শতাব্দীতে সারা দুনিয়ায় চিত্র কমবেশি একই রকম ছিল। এক গবেষণায় জানা গেছে ১৯ শতকের গোড়ার দিকে তৎকালীন বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩০ বছর। ১৭০০ সালে ইংল্যান্ডে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৭ বছর। ১৮ শতকের গোড়ার দিকে তা বেড়ে হয় ৪১ বছর। এরপর যখন ব্রিটিশ বেনিয়ারা সারা দুনিয়ার সম্পদ লুট করে তাদের দেশে জীবনমানের উন্নয়ন ঘটায় তখন ওই দেশে মানুষের গড় আয়ু আরো বাড়ে। বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, ১৮৫০ সালে ইংল্যান্ডে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয় ৫০ বছর। এখন বেড়ে হয়েছে ৭৭ বছর। উল্লেখ্য ১৭০০ সালে ইংল্যান্ডে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মারা যেত চল্লিশ শতাংশ মানুষ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স-এর এক গবেষণা সূত্রে বলা হয়েছে ২০ শতকে মাঝামাঝি সময়ে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও সংক্রামক রোগ প্রায় নির্মূল করতে পারায় মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। এই গবেষণায় সূত্রে বলা হয়েছে এই দীর্ঘায়ু হওয়া ধীরে ধীরে আরো বাড়বে। এবং এক সময় ১০০ বছর বেঁচে থাকা খুবই সাধারণ ঘটনায় পরিণত হবে।

মানুষের গড় আয়ু নিয়ে উন্নত বিশ্বে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। ওইসব গবেষণায় বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে মানুষের গড় আয়ু হবে ১১৫ থেকে ১২৫ বছর। তবে কোনো কোনো গবেষকের বক্তব্য হচ্ছে, ভবিষ্যতে মানুষের গড় আয়ু হবে ১৫০ বছর। অবশ্য এ নিয়ে গবেষকদের মাঝে মতপার্থক্য আছে। একদল গবেষকের মতে গড় আয়ু ১১৫-এর বেশি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

গড় আয়ু বৃদ্ধির বিষয়ে গবেষকরা বলেছে উন্নত জীবনযাপন ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে ১২২ বছর বয়স বেঁচে থাকা ‘জিন ক্লাইমেন্ট’র খাদ্যাভ্যাস ও এর শারীরিক পরিশ্রমের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। জিন ক্লাইমেন্ট সারা জীবন পোর্ট ওয়াইন ও সপ্তাহে দুই পাউন্ড চকলেট খেতেন। সেই সাথে তিনি প্রচুর পরিশ্রম করতেন। জিম ক্লাইমেন্ট ছাড়াও সবচেয়ে বেশি বাঁচা জাপানিদের খাদ্যাভ্যাস ও তাদের পরিশ্রমী জীবনের কথা তুলে ধরেছেন। মানুষের গড় আয়ু নিয়ে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত মার্কিন লেখক গবেষক ণাঁধষ ঘড়ধয ঐধৎধৎর তার বিখ্যাত বই ঐড়সড় উবঁং- অ ইৎরবভ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঞড়সড়ৎৎড়ি তে বলেছেন গত ১০০ বছরে মানুষ গড় আয়ু দ্বিগুণ হয়েছে। ১০০ বছর আগে কোনো অবস্থাতেই মানুষের গড় আয়ু ৪০ বছরে বেশি ছিল না। এখন দ্বিগুণ হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়ের দ্বিগুণ হবে। আর তাহলে মানুষের আয়ু হবে ১৪০ থেকে ১৫০ বছর। এবং তা এই শতকেই। একুশ দশকে।

মানুষের গড় আয়ু ৪০-এর বেশি না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, এই সময় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে ও যুবক অবস্থায় অনেক মানুষ মারা গেছে অপুষ্টি, দুর্ভিক্ষ, প্লেগ ও যুদ্ধসহ নানাবিধ কারণে। যা তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। তিনি বলেছেন, একথা সত্যি যে আধুনিক কোনো ওষুধ মানুষের আয়ু এক বছরও বাড়াতে পারে না। কিন্তু এটাও সত্য ও বড় ধরনের অগ্রগতি যে অস্বাভাবিক মৃত্যু রোধ করতে পারে। যা আমাদের পুরো জীবনকে ভোগ করার সুযোগ করে দেয়। এমনকি তখন আমরা ক্যান্সার ডায়াবেটিসহ নানান প্রাণঘাতি রোগকে রোধ করতে পারে। আর অর্থ হলো তখন কম-বেশি সকলেরই ৯০ বছরের জীবন পেতে পারি। কিন্তু এটা ১৫০ বছরের জন্য যথেষ্ট নয়। ১৫০ বা ৫০০ বছরের জন্য প্রয়োজন সেই ওষুধ যা মানবদেহের বিকল ও ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মেরামত করবে, পুনর্গঠন করবে। সেজন্য প্রয়োজন টিস্যু ও অঙ্গসমূহের পুনর্গঠন বা মেরামতি পদ্ধতি আবিষ্কার। অবশ্য তা সম্ভব কি না সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলেননি। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন এই শতকেই মানুষের গড় আয়ু হবে ১৫০ বছর।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × 5 =