জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়: আবৃত্তি, অভিনয়ে অনন্য

সংশপ্তক হাসান

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় একদিকে তুখোড় আবৃত্তিকার, কবিতা কণ্ঠে তুললে দর্শকাসনে নেমে আসে পিতনপতন নীরবতা। অন্যদিকে পর্দায় তিনি সাবলীল। যখন যে চরিত্রে থাকেন তাকেই জীবন্ত করে তোলেন নিপুণ অভিনয় দক্ষতায়। হোক মঞ্চ, ছোটপর্দা বা বড়পর্দা। যেখানে দাঁড়ান সেখানেই আশ্চর্য যাদু ছড়ান অভিনয়ের এই যাদুকর। এক লহমায় পর্দার কর্তৃত্ব নিয়ে নেন নিজের হাতে। লেখক হিসেবেও বেশ সুনাম রয়েছে তার। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মুক্তগদ্য লেখার পাশাপাশি কবিতায়ও লিখেছেন। আর মানুষ হিসেবে তো অতুলনীয়। যেভাবে নরম করে ভরাট কণ্ঠস্বরে কথা বলেন, তেমনই নরম তার মন।

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ১৯৪৭ সালের ২৮ জুলাই খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনা। পরিবারের সবাই কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল শিল্পের সঙ্গে। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের বাবা কালিকানন্দ চট্টোপাধ্যায়ে ছিলেন একজন গুণী আবৃত্তিকার। তার নিজের একটি নাটকের দলও ছিল। বছরে কয়েকটি যাত্রা ও নাটক মঞ্চস্থ করতে থিয়েটারটি। এতে অভিনয় করতেন জয়ন্তর পরিবারের সদস্যরা। ফলে অভিনয়শিল্পী হিসেবে তার পথচলাটা বাবার থিয়েটারের মাধ্যমে ছোট বয়সেই হয়েছিল। তিনি প্রথম মঞ্চে উঠেছিলেন বিবেকের সহচর একানির ভূমিকায়। পরবর্তী সময়ে বড় হতে হতে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যায় তার। তিনি ঝুঁকে পড়েন আবৃত্তি ও অভিনয়ের দিকে। পাশাপাশি গান ও তবলায় আগ্রহ ছিল।

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে কলকাতায়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। কলকাতায় পড়াকালীন সময় তার জীবনে বেশকিছু ঘটনা ঘটে। এখানে তিনি যুক্ত হন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে। কাজী সব্যসাচীর সান্নিধ্যেও আসেন কলকাতা পড়াকালীন। আবার কলকাতা বিশ্বাবিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীনই তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। বাম রাজনীতিতে যোগদানের সুবাদে কলকাতার একটি সংস্কৃতিক দলের সঙ্গেও জড়িত হন। এই দলের সঙ্গে একাধিক নাটকেও অভিনয় করেন তিনি। এ সময়ই আবৃত্তি শিল্পের দিকে গভীরভাবে ঝুঁকে পড়েন জয়ন্ত। তার বাচিকশিল্পী হওয়ার নেশায় পেয়েছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বড় ছেলে কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তি শুনে। সব্যসাচীর আবৃত্তিতে অনুপ্রাণিত জয়ন্ত তারই আবৃৃত্তি সংগঠন অগ্নিবীণায় নাম লেখান আবৃত্তিতে পাঠ গ্রহণ করতে। এটি ১৯৬৬ সালের ঘটনা। এরপর আবৃৃত্তিই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। চর্চার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতেন তিনি। দেশের বাইরে জয়ন্ত প্রথম একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান করেন কলকাতায়। এটি ছিল বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের বছর, ১৯৬৯ সাল। লেনিনের জন্মবার্ষিকীতে রঞ্জি ইনডোর স্টেডিয়ামে তিনি নজরুল-তনয় কাজী সব্যসাচীর সঙ্গে দ্বৈত ও একক আবৃত্তি করেন।

দেশের আবৃত্তি শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম জয়ন্ত। তাকে এই স্বীকৃতি দিয়েছে দর্শক শ্রোতা। দেশে যে কজন আবৃত্তিশিল্পীর সঙ্গে শ্রোতাদের যোগাযোগ রয়েছে তাদের মধ্যে জয়ন্ত অন্যতম। সত্তরের দশকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে আবৃত্তিকার হিসেবে গেছেন জয়ন্ত। তার আবৃত্তি তৃপ্তি দিয়েছে সাহিত্যপ্রেমী শ্রোতাদের। শ্রোতাদের মূল্যায়ন করে জয়ন্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মূলত শ্রোতাদের প্রশংসা এবং স্বীকৃতিই আমাকে আবৃত্তিকার করে তুলেছে।’ আবৃত্তিকার হিসেবে গুণী এ সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বের ক্যারিয়ার যথেষ্ঠ বর্ণিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তার কণ্ঠ মেতে উঠেছে আবৃত্তিতে। ভারত-বাংলাদেশের পাশাপাশি ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আবৃত্তি অনুষ্ঠান করেছেন। তার ‘আত্মপ্রকাশ’, ‘আগুনের ডালপালা’, ‘শুধুই রবীন্দ্রনাথ’, ‘দ্বিতীয়া’, ‘দোঁহে’, ‘লিলুয়া বাতাস’ শিরোনামের আবৃত্তি অ্যালবামগুলো ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে।

আবৃত্তিকারের মতোই শক্তিশালী অভিনেতা জয়ন্ত। অভিনেতা হিসেবে পথচলা যে ছোটবেলায় হয়েছিল এরই মধ্যে তা জেনেছি আমরা। তার কলাকাতা অধ্যায়ের অভিনয়জীবন সম্পর্কেও আমরা অবগত। সে তো ছিল থিয়েটারের কথা। ছোট ও বড় দুই পর্দায়ই সাবলীল গুণী এই অভিনেতা। চলচ্চিত্রে তার যাত্রা শুরু হয় আশির দশকে। সে দশকের মাঝামাঝিতে মোরশেদুল ইসলামের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘সূচনা’য় অভিনয়ের মাধ্যমে সিনেমায় লেখান তিনি। এরপর অনেক ছবিতে অভিনয় করেন জয়ন্ত। এরমধ্যে ‘মাটির ময়না’, ‘নিরন্তর’, ‘অন্তর্যাত্রা’, ‘রূপান্তর’, ‘বৃত্তের বাইরে’, ‘দূরত্ব’, ‘দ্য লাস্ট ঠাকুর’, ‘কীর্ত্তনখোলা’, ‘রানওয়ে’, ‘অপেক্ষা’ উল্লেখযোগ্য। জয়ন্ত টিভি নাটকেও অভিনয় করেছেন। সিনেমার মতো তার ক্যারিয়ারে বেশকিছু নাটকও রয়েছে। এর মধ্যে ‘বিশাখা’, টেলিছবি ‘মাউথ অরগান’, নাটক ‘মাটি’ উল্লেখযোগ্য।

পেশাগত জীবনে অনেক নির্মাতার নির্দেশনায় ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন জয়ন্ত। অভিনয় করেছেন সবমিলিয়ে ৭০টি চলচ্চিত্রে। এসব কাজগুলোতে বিভিন্ন চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। তবে অভিনেতা জয়ন্তের সদ্ব্যবহার করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার নির্মিত ‘ঘেটুপুত্র কমলা’য় ঘেটুর বাবা আর ধারাবাহিক নাটক ‘কালা কইতর’র মজিদ কসাই তার প্রমাণ। চরিত্র দুটি এ অভিনেতার নিজেরও পছন্দের। তাই হুমায়ূন আহমেদকে ভুলতে পারেন না তিনি। সেইসঙ্গে গভীরভাবে তার স্মৃতিতে আছেন নির্মাতা তারেক মাসুদ। এই দুজনের অভাব অভিনেতা জয়ন্তকে পোড়ায়। তার ভাষায়, হুমায়ূন ও তারেক মাসুদ তাকে একাকিত্বে ভোগান। তিনি বলেন, ‘এটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হুমায়ূন আহমেদ-তারেক মাসুদ আমায় একাকিত্বে ডুবিয়ে চলে গেছেন। ব্যক্তিগতভাবেও এখন আমি ভীষণ একাকিত্বে ভুগি। হুমায়ূন আহমেদের সাথে কাজ করলে যে প্রাণশক্তি পেতাম, যে আনন্দে কাজ করতাম তা কোথায় পাব। আর তারেকের কথা ভাবলে তো কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। ও সর্বশেষ ‘কাগজের ফুল’ নামে যে চলচ্চিত্রের কথা চিন্তা করছিল, এটা অনেক বড় বাজেটের চলচ্চিত্র; প্রায় ২ থেকে ৩শ কোটি টাকা বাজেটের চলচ্চিত্র ছিল। ইয়াশ চোপড়ার সাথেও চুক্তি হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশি কোনো চলচ্চিত্রের অস্কার তারেকই আনতে পারত। আর সবচেয়ে বড় কথা তারেক কখনও ওই একটি-দুটি হলে মুক্তি দেওয়ার পক্ষে বা টিভিতে ছবি মুক্তির পক্ষে ছিল না। এ কারণে সারাদেশ চষে বেড়িয়েছে। ক্যাথরিন অবশিষ্ট কাজ করছে। কিন্তু ওদের দুজনার যে কম্বিনেশন ছিল, তা বলার না। আমরা বাংলাদেশি শোবিজ কর্মী হিসেবে অনেক অপূরণীয় ক্ষতিতে পড়েছি।’

কাব্যেও দখল রয়েছে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের। তার ফেসবুকে চোখ রাখলেই স্পষ্ট হয় তা। নিজের আইডি থেকে মাঝেমাঝেই নিজের লেখা কবিতা-গল্প প্রকাশ করে থাকেন তিনি। সেখানে প্রিয়তমার সৌন্দর্যের বর্ণনা থেকে প্রকৃতির কোলাহল সবই থাকে। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের সম্প্রতি লেখা একটি কবিতা তুলে দেওয়া হলো তার ফেসবুক থেকে।

দিবাস্বপ্ন
তারপর সেই অনামিকাটি এক
অপার্থিব সুরে আমাকে গান শোনাল।
আমার হালকা দিবানিদ্রা ভেঙে গেলো।
এক প্রাচীন নারীবৃক্ষের প্রশাখায় গড়া
তার অনামিকার একটিমাত্র আলতো
ছোঁয়ায় চমকে উঠে আমি বললাম,
– কে তুমি- নাম কী?
সে বলল, – আমার আগের নাম সুর্পনখা।
এখন বদলে রেখেছি- মারীচ।
তখনই সে আমার কানে কানে শোনালো
স্বরবিন্যাসে তিনটির বদলে তেরোটি শ্রুতি।
হিব্রুর চেয়েও দুর্বোধ্য ছিলো সেই গানের বাণী।
বাণীগুলি সাতটি প্যাপিরাস পাতায়
চিত্রার্পিত হয়ে পেন্ডুলামের মতো
আমার চোখের সামনে দুলতে লাগলো।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, – এটা কোন ভাষা?
সে বললো, – কিশোর তুতেনখামেনের।
এই ভাষায় ক্লিওপেত্রা সিজারের চোখে
চোখ রেখে বলেছিলো, – ভালোবাসি।
কিন্তু তার পরিণতি ভালো হয়নি।
বললাম, – ভালোবাসার পরিণতি ভালো হয়না?
আমার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে শুদ্ধ রসশৃঙ্গারের
গান থামিয়ে সেই চঞ্চল অনামিকা
পরাবাস্তব যাদুর পায়রার মতো
হঠাৎই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।
হতবাক আমি সেই তীব্র ঝাঁঝালো দুপুরে
আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম।
সে ঘুম আমার এখনও ভাঙেনি।
আর কখনও ভাঙবে কি না- জানিনা!

শিল্প-সাহিত্যের শাখা-প্রশাখায় বিচরণরত জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের দেশপ্রেম প্রবল। এর প্রমাণ তিনি দিয়েছেন ১৯৭১ সালে। দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে জয়ন্ত তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। দেশ মাতৃকার এই বিপদের দিনে স্বার্থপরের মতো পড়ার টেবিলে বসে নিজের জন্য সময় খরচে মন সায় দেয়নি তার। কলমের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনে। যে ভরাট কণ্ঠ তার গমগম করতো কবিতায় সেই কণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগান তুলে শত্রুর বুক বরাবর ছুড়েছেন গুলি। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করে তবেই ফিরেছেন ঘরে। মা’কে মুক্তির স্বাদ দিয়ে ফের ছুটে গিয়েছেন শিল্পের কাছে। কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন কবিতা। সদ্য ভূমিষ্ঠ দেশের বুকে দাঁড়িয়ে করেছেন আবৃত্তি। মুক্ত বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছেন তার সুবাস। আবৃত্তিকার হিসেবে এ সময়ই জনপ্রিয়তার শুরু হয়েছিল জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের।

কেউ তার অভিনয়ের ভক্ত। আবার কেউ তাকে ভালোবাসেন অভিনেতা হিসেবে। আবার কেউ লেখালেখি। আর ভালোবাসার টানেই জয়ন্ত বারবার ফিরে এসেছেন। কখনও পর্দায়, কখনও কবিতা কণ্ঠে নিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও পেয়েছেন স্বীকৃতি। ২০২৩ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক দেওয়া হয় তাকে। শিল্পে সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য আবৃত্তিতে এই সম্মাননা অর্জন করেন তিনি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twelve + 18 =