মোহাম্মদ জিগারুল ইসলাম
চট্টগ্রাম, ২৮ জুন ২০২৩ (বাসস) : বড়ছনখোলা, দুধপুকুরিয়া, ফলহারিয়া, ভোলারটিলা, কমলাছড়ি ও জিলানী পাড়া চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের দূর্গম গ্রাম। কেঁচো সার উৎপাদনে নিরব বিপ্লব ঘটিয়েছেন এসব গ্রামের নারীরা। উৎপাদনের সহজ কৌশল, গুণগত মান সম্পন্ন, মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর নয় ও ভাল দামের হওয়ায় কৃষকরা দিন দিন এই সার ব্যবহার ও উৎপাদনের প্রতি ঝুঁকছেন। গত কয়েক বছরে পদুয়া ইউনিয়নের অর্ধ শতাধিক নারী এই সার তৈরিতে সফলতা দেখিয়েছেন। তাদের দেখে পাশের গ্রামের নারী—পুরুষরাও এই সার উৎপাদনে এগিয়ে আসছেন। তবে এই সার তৈরিতে পুরুষের চাইতে নারীরা অগ্রগামী ভূমিকা রাখছেন।আর এ অঞ্চলের দুর্গম এলাকার দরিদ্র নারীসমাজকে এই কাজে উৎসাহ, সাহায্য—সহযোগিতা যুগিয়েছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। নামমাত্র সুদে বিনা জামানতে তাদের ঋণ দিচ্ছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক।
বড়ছনখোলা গ্রামের সিরাজী বেগম আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন কেঁচো চাষ বা ভার্মি কম্পোস্ট। নিজ বাড়িতে কেঁচো উৎপাদন করে মাত্র ছয় মাসে অর্ধলক্ষ টাকা আয় করেছেন তিনি। তার দেখাদেখি এলাকার আরও অর্ধশতাধিক নারী এ কাজে সম্পৃক্ত হয়েছে। তাদের কেঁচো চাষ শুধু অর্থ উপার্জন নয়, পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায়ও অবদান রাখছে। অথচ ৭/৮ বছর আগেও, এসব নারীরা সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে গাছ ও লাকড়ি কেটে জীবিকা নির্বাহ করতো। ২০১০ সালে রাঙ্গুনিয়ার দুধপুকুরিয়া বনাঞ্চলকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণার পর থেকে তাদের বনে প্রবেশাধিকার বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক সেই সময়ে তাদের জীবনে বিরাট অবলম্বন হয়ে এসেছিল সরকারের ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প’। এটি বর্তমানে ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
দুধপুকুরিয়া গ্রামের রাজিয়া বেগমও একইভাবে কেঁচো সারে মেতেছেন । তিনি বলেন, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক রাঙ্গুনিয়া অফিস থেকে কেঁচো সার উৎপাদনের প্রশিক্ষণ শেষে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সেই অর্থ দিয়ে উপকরণ কিনে তিনি তা কেঁচো সারের উৎপাদন এবং ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের কাজে ব্যবহার করছেন। বর্তমানে প্রতিমাসে তাদের এলাকায় ২টন কেঁচো সার উৎপাদিত হয়। সেটা তারা বিভিন্ন কৃষক ও কৃষি খামারে বিক্রি করেন। বর্তমানে তারা সারের পাশাপাশি কেঁচোও বিক্রি করছেন। প্রতি কেজি কেঁচো বিক্রি করে তারা তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পায়। কেঁচো ও জৈব সার উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ঘরে বসে বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে একজন নারী ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করছেন বলে জানান তিনি।
ফলহারিয়া গ্রামের মোহনা বেগম বলেন, কেঁচো চাষের বাড়তি আয় থেকে তারা পারিবারিক সঞ্চয় কার্যক্রম শুরু করেছেন। পারিবারিক খরচ মিটিয়ে প্রতিমাসে ডিপিএস ও ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ চলছে কেঁচো সার বিক্রির আয়ের টাকা থেকে। জিলানী পাড়া গ্রামের নিলু আকতার বলেন, বাড়িতে দুটি গরু থাকলে কেঁচোর মাধ্যমে ৪৫ দিনে ১২০ কেজি জৈবসার উৎপাদন করা যায়। একজন নারী যদি ৩ হাজার কেঁচো চাষ করে, তাহলে মাসে ১২০ কেজি জৈব সার উৎপাদন করতে পারবে। ৩ হাজার কেঁচো থেকে বছরে দেড় লাখ কেঁচো পাওয় যায়।
ফলহারিয়া গ্রামের নুর বানু বলেন, কেঁচো চাষের চাহিদা কৃষকদের কাছে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সার কেজি প্রতি ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাসায়নিক সারের চেয়ে জৈবসারে অন্ততপক্ষে ৫০ ভাগ অর্থ সাশ্রয় হয়। উৎপাদনও হয় অনেক বেশি।
পদুয়া ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবু জাফর বলেন, কেঁচো সার উৎপাদনে বড়ছনখোলা গ্রামের নারীদের সফলতা দেখে পাশের দুধপুকুরিয়া, ফলহারিয়া, ভোলারটিলা, কমলাছড়ি ও জিলানী পাড়া গ্রামে কেঁচো এবং সার উৎপাদনে আরো ৩০জন উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রশিক্ষণ নেন। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের গ্রুপ গুলোতে এসব নারীরা সদস্য হয়ে সেখান থেকে ঋণ নিয়ে এখন স্বাবলম্বিতা অর্জন করেছেন। পদুয়া ইউনিয়নের অর্ধ শতাধিক নারী এখন এপেশায় জড়িত।
রাঙ্গুনিয় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক রাশেদা বেগম জানান, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করার প্রত্যয় নিয়ে ২০০৯ সালে সৃষ্টি করেছিলেন একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প। বর্তমানে এটি ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক হিসিবে পরিচালিত হচ্ছে। পদুয়া ইউনিয়নের ৩০ জনের একদল নারীকে আমরা কেঁচো সার উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দিই। তারা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে এখন স্বাবলম্বিতা অর্জন করেছে।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউল গণি ওসমানি বলেন, ‘কৃষিতেও নারীরা সম্পৃক্ত হচ্ছেন। কেঁচো চাষের মাধ্যমে জৈবসার তৈরিতে নারীদের অসাধারণ অবদান অবশ্যই মূল্যায়নযোগ্য। ।