“নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার বায়ুমান ও জ্বালানি উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে”

সোমবার (১৭ই জুলাই) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর কনফারেন্স হলে, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউটঅব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর যৌথ আয়োজনে ‘বায়ুমান এবং জ্বালানি উন্নয়নে নবায়নযোগ্য শক্তির ভূমিকা’ বিষয়ক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সহ-আয়োজক ছিল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (সিথ্রিইআর), পিওর আর্থ বাংলাদেশ, নোঙর বাংলাদেশ ট্রাস্ট, সেন্টার ফর গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিইডি), পরিবেশ উদ্যোগ, এবং ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি বলেন, আমরা আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বাতাসকে দূষিত করছি, তাই এখন আর আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য নির্মল বাতাস পাই না। শুধু সরকার একা কাজ করে এই দূষণ কমাতে পারবে না। ব্যক্তি পর্যায়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে আগ্রহ দেখাতে হবে, দেশের নাগরিক হিসেবে সবাইকে সবার অবস্থান থেকে বায়ু দূষণ কমাতে সচেষ্ট হতে হবে এবং সরকারকে বায়ুমান ও জ্বালানির উন্নয়নে নির্ধারিত আইন প্রয়োগে সহযোগিতা করতে হবে। তিনি আরো বলেন, জনগণ যা বলে সরকার তা করতে বাধ্য, তাই পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে গণ আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে।

বিআইপি এর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমনের সভাপতিত্বে উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর সমন্বয়ক শরীফ জামিল এবং বিআইপি এর উপদেষ্টা পরিষদের আহবায়ক অধ্যাপক ড. মো. আকতার মাহমুদ।

গোলটেবিল বৈঠকে মূল বক্তব্য প্রদান করেন বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, বায়ুমান ও জ্বালানি উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎ শক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান সুবিধা হল বায়ুমন্ডলে ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস ও বায়ুর দূষক নিঃসরণ ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ক্ষমতা।

তিনি তার বক্তব্যে দেশে বায়ুমান উন্নয়নে ৪টি সুপারিশ প্রদান করেন যথা (১) বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২২ এ বস্তুকণা ২.৫ এর পূর্ববর্তী মান প্রতিঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম বজায় রাখা (২) উন্নয়ন সহযোগিতা প্রদানকারী দেশগুলো নিজ দেশে যেভাবে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে ইমিশনের মাত্রা বজায় রাখে একইভাবে বাংলাদেশেও তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে ইমিশনের মাত্রা বজায় রাখা (৩) পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রণীত বায়ু দূষণ নির্দেশিকার ১৬ নং পৃষ্ঠার ১৯ নং ক্রমে উল্লেখিত কম সালফারযুক্ত (৫০ পিপিএম) ডিজেল আমদানি ও ব্যবহার নিশ্চিত করা (৪) সকল কয়লা, তেল ও গ্যাস ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্লান্টকে পূর্বের মত লাল শ্রেণিভুক্ত রাখা।

নোঙর বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর চেয়ারম্যান সুমন শামস বলেন, রাজউক বিল্ডিং প্ল্যানের নির্দেশনা সোলার প্ল্যান বসানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে এই সোলার গুলির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারকে সঠিক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। বায়ু দূষণের ব্যাপারে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করতে হবে। আইন এর ব্যাপারে বিশেষ করে বায়ু দূষণের রোধে কঠোর হতে হবে।

পিওর আর্থ বাংলাদেশ এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর বাসুদেব চক্রবর্তী বলেন, লেড এসিড যুক্ত ব্যাটারি উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখার কারণে এটি দীর্ঘ সময়ে বায়ুকে দূষিত করে। এই দূষিত বায়ু এর পার্শ্ববর্তী এলাকার শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তিনি সরকারের কাছে বায়ু দূষণ রোধে জরিমানা ভিত্তিক আইন প্রয়োগের বিনীত অনুরোধ জানান।

সেন্টার ফর গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিইডি) এর নির্বাহী পরিচালক আব্দুল ওয়াহাব বলেন, বায়ু দূষণ একটি বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে, যা মানবজীবন ও পৃথিবী উভয়ের স্বাভাবিকতাকে ধীরে ধীরে হুমকির মুখে ফেলছে। জীবাশ্ম জ্বালানি দহন, শিল্প নির্গমন এবং যানবাহনের দূষণ এই বিপদের জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে, আমরা বায়ুতে নির্গত ক্ষতিকারক দূষকের পরিমাণ হ্রাস করতে পারি এবং মানব স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব হ্রাসও করতে পারি।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, তাই বায়ুকে দুষণমুক্ত রাখতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে ও জ্বালানি নিরাপত্তায় নবায়নযোগ্য শক্তির কোন বিকল্প নেই।

ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী বলেন, আমাদের অনেক বিধিমালা আছে কিন্তু বিধিমালা গুলোর মধ্যে সমন্বয় নাই। আমাদের নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বিধিমালা গুলোতে নিশ্চিত করতে হবে। দেশপ্রেম সকলের মধ্যে রয়েছে এখন প্রয়োজন এই দেশ প্রেমের সমন্বয়ের।

বিআইপি এর উপদেষ্টা পরিষদের আহবায়ক অধ্যাপক ড. মো. আকতার মাহমুদ বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারের মাধ্যমে বায়ুমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য গবেষণা সংগঠন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তিকে ব্যবসায়ীদের পন্য হিসেবে পৌঁছাতে পারলে এটির প্রসার করা সম্ভব। সরকারকে বায়ু দূষণরোধে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সচেষ্ট হতে হবে তা নাহলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছুই দেখে যেতে পারবো না।

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, বায়ুদূষণ বর্তমানে বাংলাদেশে একটি মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে। এই বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ পেতে জৈব জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করে নবায়নযোগ্য শক্তিকে প্রমোট করতে হবে। বাংলাদেশে সৌর শক্তির অনেক সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এর জন্য আমাদের আচরণগত ও মানসিককতায় পরিবর্তন আনতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আপাত দৃষ্টিতে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যয় বেশি হলেও, যে হারে অন্যান্য জ্বালানির দাম বাড়ছে খুব শিগগিরি এই সব জ্বালানি ব্যয় বহন করা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাবে। তখন দেখা যাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যয় কম এবং তাই আমাদের এখন থেকে এই নবায়নযোগ্য শক্তিকে প্রমোট করলাম। আইন ও বিধিমালা গুলোতে অনেক গ্যাপ আছে, এই ঘাটতি গুলোকে সমাধান করে বিধিমালা গুলোকে যুগউপযোগী করে তোলার দাবি জানান তিনি।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলে এককভাবে পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করে শেষ করতে পারবে না এর জন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয়কেও সাহায্য করতে হবে। বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের স্ট্যান্ডার্ড একই হওয়া উচিত, তবে দেশের পরিবেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিজস্ব একটি রোডম্যাপ ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২২ কে অকার্যকর ভাবার কোন সুযোগ নেই, এতে কিছু ত্রুটি আছে তবে আমাদেরকে বিধিমালা ভালো দিকগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকারি অন্যান্য সংস্থার তুলনায় আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তর কিছুটা হলেও কাজ করে। কিন্তু তাদের বড় সংকট রাজনৈতিক সমর্থনের অভাব। রাজনৈতিক সমর্থন পেলে ভালো কাজ করার নজির এ সংস্থাটি আগেও দেখিয়েছি।

সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, বিধিমালায় দূষক গুলোর আদর্শমানগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে মিল রেখে সংশোধনী জরুরি। তিনি সকল শিল্পকারখানা গুলোতে EIA এর পাশাপাশিই EMP বাধ্যতামূলক করার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানান।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × three =