ভিউতে আটকে গেছে সব

কয়েক বছরের মতো সর্বশেষ কোরবানির ঈদের নাটকেও ছিল যথারীতি ভিউর রাজত্ব। টেলিভিশন ও অনলাইন মিলিয়ে এই ঈদে প্রচারিত হয়েছে পাঁচ শর বেশি নাটক। সংখ্যার তুলনায় স্বল্পসংখ্যক নাটক আলোচনায় এসেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ফিমেল ৩’, ‘কিডনি’, ‘জায়গায় খায় জায়গায় ব্রেক’, ‘পুনর্জন্ম অন্তিম পর্ব’, ‘জামাই শ্বশুরের কুরবানি’, ‘কাছের মানুষ’, ‘কপি পেস্ট’, ‘ঢাকাইয়া কুরবানি’, ‘কবর’, ‘কঞ্জুস-২’, ‘লাভ ইউ ম্যাডাম’ ইত্যাদি। অভিনয় বা নির্মাণকেন্দ্রিক নয়, বেশির ভাগ নাটক আলোচনায় এসেছে ভিউর বিবেচনায়। কোন নাটক কত ঘণ্টায় কতসংখ্যক ভিউ হয়েছে, কে কার আগে মিলিয়নের ঘরে প্রবেশ করতে পেরেছে, তা নিয়েই সবার মাথাব্যথা। সর্বোপরি নাটক যেন আটকে গেছে ভিউর গণ্ডিতে।

একসময় নাটক ও চরিত্রের নাম মানুষের মুখে মুখে থাকত। কোন কোন অভিনেতা ভালো অভিনয় করলেন, আর কোন নির্মাতা গল্পটি কত ভালো উপস্থাপন করতে পারলেন, তা নিয়ে চলত আলোচনা। সেই জায়গা দখল করেছে ভিউ। ভিউর গুরুত্ব এতটাই বেড়েছে যে নাটকের গল্প, শিল্পী, নাম নির্বাচনে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে ভিউকে। ভালো অভিনয়শিল্পীরা কাজ পাচ্ছেন না তাঁদের ভিউ নেই বলে। অন্যদিকে যেসব শিল্পীর ভিউ আছে, তাঁদের শিডিউল পাওয়া দুষ্কর।

ভিউ নিয়ে উচ্ছ্বাস থাকলেও এ নিয়ে চিন্তিত নাট্যসংশ্লিষ্ট অনেকে। তাঁদের মতে, ভিউর পেছনে ছুটতে গিয়ে বাংলা নাটকের মান কমছে, হারাচ্ছে ঐতিহ্য। বাড়ছে রুচিহীন নাটকের সংখ্যা। নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত বলেন, ‘সমস্যাটা মূল্যবোধের। সবাই যদি ভালো কাজ করি, তাহলে কিন্তু কেউ রুচিহীন কাজ দেখবে না। যদি রুচিহীন কাজ বানাতেই থাকেন, তাহলে তো মানুষ সেখানে যাবেই। ল্যাংটা হয়ে ঘোরেন, লাখ লাখ মানুষ পেছনে দৌড়াবে। এটা তো জনপ্রিয়তা নয়।’

এ বিষয়ে নির্মাতা ও অভিনেতা সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘প্রযোজক ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো শিল্পের পরিবর্তে বাণিজ্যকে বড় করে দেখে বলেই ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট ৫-৬ জন শিল্পীকে বারবার পর্দায় দেখা যায়। যেখানে কাজ করার কথা ২০০ থেকে ২৫০ জন শিল্পীর। ইউটিউব চ্যানেল আসার পর থেকে এই প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে। যার ভিউ বেশি, তার পেছনে ছুটছে সবাই। কে ভালো কাজ করছে, সেটা এখন বড় বিষয় নয়। এটা কোনো সুস্থ প্রক্রিয়া হতে পারে না। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিল্পের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।’

পরিচালক সকাল আহমেদ বলেন, ‘ইউটিউব ও ওটিটির যুগে সবার ফোকাসে থাকে ভিউ। নাটকের গল্প, শিল্পীদের অভিনয়, পরিচালকের নির্দেশনা—এসব ওই অর্থে আর নেই। ভিউ হয় এমন নাটকের পেছনে ছুটছে সবাই। নির্মাতা থেকে প্রযোজক, অভিনয়শিল্পী—সবাই নিজেকে সেরা প্রমাণ করার জন্য দৌড়াচ্ছে। অনেকে পোস্ট করে লেখেন, আলহামদুলিল্লাহ, এক দিনে এক মিলিয়ন ভিউ। দর্শক কিন্তু পোস্ট দিচ্ছে না, যাদের নাটক তারাই পোস্ট দিচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। আজকে যেমন নাটকের ভিউ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, ঠিক সেভাবে নাটকের গল্প, নির্মাণ, অভিনয় নিয়েও আবার আলোচনা হবে, এটা আমার বিশ্বাস।’

সম্প্রতি অভিনেত্রী তানজিন তিশার ৫০টি নাটক কোটি ভিউর মাইলফলক স্পর্শ করেছে। তিনি বলেন, ‘ভিউ একটা সংখ্যামাত্র। অনেক ভিউ হলো মানে কাজটা অনেক দর্শক দেখেছেন, পছন্দ করেছেন। আমি মনে করি, ভিউ আর মান—দুটো আলাদা বিষয়। আমি মানটা আগে দেখি। একটা ভালো কাজ কম ভিউ হলেও সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি। বেশি কাজ করার চেয়ে ভালো মানের কাজ কম হলেও দর্শকের মনে থেকে যায়।’

অভিনয়শিল্পী জোভান বলেন, ‘অস্বীকার করা যাবে না, এবার ঈদের নাটক নিয়ে আলোচনা কম ছিল। কারণ, ঈদে ভালো ভালো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। সেগুলো নিয়ে দর্শকের মাতামাতি বেশি। এটাও আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভালো দিক। আর ভিউর ব্যাপারটি একেবারেই আলাদা। এটি শুধু সংখ্যা।’

এ ছাড়া ইউটিউবের পাশাপাশি দিন দিন দর্শকের আরেকটি ভরসার জায়গা হয়ে উঠছে হালের ওটিটি মাধ্যম। দর্শকের পাশাপাশি শিল্পী, নির্মাতাও ছুটছেন বিনোদনের নতুন এ মাধ্যমের দিকে। সব মিলিয়ে বলতে হয়, টিভি নাটক এখন সংকটের মুখে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seven − four =