বৃষ্টিতে যত রোগ

ময়ূরাক্ষী সেন

তীব্র গরমের পর হঠাৎ বৃষ্টি সবাইকে স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু এই কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি অনেক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বৃষ্টির সময়ের রোগ নিয়ে কথা হলো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হারুন অর রশিদের সাথে। তিনি বলেন, আমরা শীত কিংবা গ্রীষ্মের জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিলেও কখনো বর্ষা নিয়ে তেমন ভাবি না। যদিও অনেক কঠিন রোগ বয়ে নিয়ে আসে এই বর্ষা ঋতু। ডা. রশিদ বলেন, বর্ষাকালে কিছু প্রচলিত রোগ রয়েছে যা ৬০% মানুষের হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গু মশা জমে থাকা পানিতে জন্মে। এ জাতের মশাকে এসিড মশা বলা হয়। এছাড়া ফুলের টব, বোতল, বাগান পরিচর্যার জিনিসপত্রসহ ইত্যাদি আরো অনেক স্থানে ডেঙ্গু মশা জন্মায়। বৃষ্টির কারণে এদের বংশবৃদ্ধি অনেক সহজ হয়ে যায়। বৃষ্টির সময় নানা স্থানে পানি জমে থাকে। এর ফলে সেসব স্থানে এসিড মশার বংশবৃদ্ধি হয়। তবে এসিড মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হবে এমন না। যে মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে তার কামড়েই ডেঙ্গু হবে। এডিস মশা খুব সহজে খালি চোখে দেখা যায়। এর গায়ে সাদা রঙের ডোরাকাটা দাগ থাকে। আবার এই মশা কিন্তু যখন তখন কামড়ায় না। বলা হয়, দিনের বেলাতেই এসিড মশা সবচেয়ে বেশি কামড়ায়। তবে রাতে যে একদমই এই মশা কামড়ায় না তার নিশ্চয়তা নেই। তাই সবসময় সাবধান থাকতে হবে।

বর্ষায় আরেকটি রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় তা হলো ডায়রিয়া। প্রতিদিন কমপক্ষে তিনবার পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া হিসেবে ধরে নিতে হবে। ডায়রিয়া সাধারণত ৩ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়। অবস্থা গুরুতর হলে তার থেকেও বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে। এতে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। শুরু থেকে সচেতন না থাকলে ডায়রিয়া রোগে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ডায়রিয়া মূলত রোটাভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। খাবার পানি ও খাদ্যের মাধ্যমেই এই ভাইরাস আমাদের পাকস্থলিতে প্রবেশ করে থাকে। বর্ষায় অনেক সময় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়। তখন ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। এছাড়া বাইরের খাবার, অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাবার, বাসি খাবার ইত্যাদি কারণে ডায়রিয়া হতে পারে।

বর্ষার মৌসুমে পানিবাহিত টাইফয়েড রোগ বেড়ে যায়। এটি এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগ। শরীরে ব্যাক্টেরিয়া প্রবেশের ৬ থেকে ২০ দিন পর লক্ষণ প্রকাশ পায়। এর কয়েক দিন পর জ্বর বাড়তে থাকে। স্যালমোনেলা টাইফি ও প্যারাটাইফি নামের ব্যাকটেরিয়া এর জন্য দায়ী। দূষিত পানি ও অস্বাস্থ্যকর খাবারের মাধ্যমে টাইফয়েড জীবাণু দেহে প্রবেশ করে। টাইফয়েড হলে জ্বরের পাশাপাশি প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকবে। বমি হবে, অরুচি, কাশি, পেটে ব্যথা, পিঠে ও পেটে দানা দেখা দিতে পারে। জ্বর বাড়তে থাকলে হৃদস্পন্দন কমতে পারে, শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। কারো ডায়রিয়া আবার কারো কোষ্ঠকাঠিন্যও হতে পারে।

বৃষ্টি হলে ঠান্ডা আবার রোদ উঠলে ভ্যাপসা গরম। আবহাওয়ার এই ওঠা-নামায় অনেকের হাঁপানির সমস্যা দেখা দেয়। যাদের আগে থেকে হাঁপানি সমস্যা থাকে, তাদের ঘনঘন হাঁপানির প্রকোপ হতে থাকে। হাঁপানি শ্বাসনালির অসুখ, একে অ্যাজমা নামেও অনেকে চেনে। ঠান্ডা আবহাওয়া, পরিশ্রমের কাজের পর, কড়া মসলার গন্ধ, সিগারেটের গন্ধ, ধুলাবালি ইত্যাদি কারণে শ্বাসকষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেকের ক্ষেত্রে খাবারও হাঁপানি বেড়ে যাবার কারণ হতে পারে। যেমন গরুর মাংস, ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ, বেগুন ইত্যাদি। ঋতু পরিবর্তনের সময় শ্বাসকষ্ট সাধারণত বেড়ে যায়। হাঁপানি রোগ কেন হয় তার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। বংশগত কারণেও অনেকের হাঁপানি হয়ে থাকে।

ফুসফুসের আরেকটি রোগ সিওপিডি। যার পুরো নাম ‘ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ’। এটি বায়ুপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে ও শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। যত বয়স বাড়ে এ রোগের প্রকোপ তত বাড়তে থাকে। পুরোপুরি ভালো না হলে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। দীর্ঘদিন ধূমপান সিওপিডি’র অন্যতম কারণ। ধূমপায়ীদের সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তির সিওপিডি আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। বর্ষার এই সময়টা এর তীব্রতা বেড়ে যেতে দেখায় যায়। সিওপিডি’র প্রধান লক্ষণ শ্বাসকষ্ট। শারিরীক পরিশ্রমের ফলে এটি বেড়ে যায়। ৪০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের সিওপিডি বেশি দেখা যায়। বয়স যত বাড়তে থাকে এ রোগের উপসর্গ তত বাড়তে থাকে। তাই এই মৌসুমে বয়োজ্যেষ্ঠদের চাই বাড়তি যত্ন।

বর্ষাতে বেড়ে যায় ইনফ্লুয়েঞ্জা। এটি শ্বাসতন্ত্রের অসুখ। লক্ষণগুলো সর্দি জ্বরের মতো হলেও এটি গুরুতর। ইনফ্লুয়েঞ্জারের জন্য অর্থোমিক্সোভিরিডি দায়ী। বছরের যে যেকোনো সময় এটি হতে পারে। কিন্তু শীত ও বর্ষাতে এর প্রভাব বাড়ে। ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত হলে মাথা ও গলা ব্যথা হবে। হালকা জ্বর থাকবে। শরীর ব্যথা, অরুচি হবে, নাক বন্ধ থাকবে। ফলে ঘ্রাণের অনূভুতি কমে আসবে। এছাড়া এই সময়ে অন্যান্য জ্বর হওয়া ও ঠান্ডা লাগার প্রবণতা বেড়ে যায়। যাকে ‘সিজনাল জ্বর’ বলা হয়ে থাকে। মূলত এই সময়টায় আবহাওয়া স্থির থাকে না। গরমে ঘেমে একাকার আবার শীত শীত আবহাওয়া। এর প্রভাবে খুব সহজে জীবাণু শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।

বর্ষায় ডিহাইড্রেশন হবার সম্ভাবনা থাকে। কারণ অনেক সময় তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ঘামের মাধ্যমে পানি বের হয়ে যায়, ফলে শরীরে পানির পরিমাণ কমতে থাকে। যখন শরীর চাহিদা অনুযায়ী পানি না পায় তখন পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন হতে পারে। ডিহাইড্রেশন হলে কোনো কাজে মন দেওয়া যায় না। পানির অভাব হলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। সারাক্ষণ অস্থির লাগে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। অকারণে মাথা ব্যথা করে ও ঘোরে। মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় ইত্যাদি। গুরুতর পানিশূনত্য হলে জ্ঞান হারিয়ে পড়েও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

বর্ষায় রোগমুক্ত থাকার উপায়

ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, এই সময়টা সবাইকে অনেক বেশি সচেতন থাকতে হবে। যেহেতু ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে তাই মশার প্রজনন যাতে বৃদ্ধি না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাড়ির আশ পাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। পানি জমে থাকতে দেওয়া যাবে না। যেমন ফুলের টব, ডাবের খোল, টায়ার, ক্যান, বোতল ইত্যাদি জায়গা পরিষ্কার রাখতে হবে। নিয়মিত বাগানের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে হবে। বাড়ির সামনে ডোবা থাকলে তা পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া মশা প্রতিরোধী ব্যবস্থা নিতে হবে। যাদের আগের থেকে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন ও হৃদরোগের মতো দীর্ঘমেয়াদি অসুখ রয়েছে তাদের বাড়তি সচেতনতা অবলম্বন করা জরুরি। কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে কম থাকে।

এই আবহাওয়ায় যতটা সম্ভব বাইরের খাবার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে পেটের অসুখ হতে পারে। বাসি খাবারে খুব সহজেই ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। এতে ডায়রিয়া, কলেরা ও টাইফয়েড হতে পারে। পানিশূনত্য দূর করতে বেশি করে ফলের রস, স্যালাইন, সুপ, বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। বাইরে থেকে ঘেমে এসেই গোসল করা যাবে না। প্রথমে ফ্যানের বাতাসে শরীর শুকিয়ে নিতে হবে। এরপর কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করতে হবে। বাসার ধুলাবালি পরিষ্কার রাখতে হবে। বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। এ সময়টায় যেকোনো রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে; তা না হলে পরবর্তীতে অবস্থা গুরুতর হতে পারে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

9 + 5 =