এগিয়ে যাও মেয়েরা

উপল বড়ুয়া

স্বাধীনতা পাওয়ার মতো ক্রিকেটে আজকের অবস্থানে আসতে কম যুদ্ধ করতে হয়নি বাংলাদেশকে। অনেক কণ্ঠাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে এতদূর আসা, ওয়ানডে ক্রিকেটে পরাক্রমশালী হয়ে ওঠা। অবশ্য জাতীয় ক্ষেত্রে এখনো আইসিসির কোনো শিরোপা ঘরে তোলা হয়নি বটে, তবে আশায় বুক বাঁধলে ক্ষতি কী!

১৯৭৭ সালে আইসিসির সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। তিন বছর খেলে আইসিসি ট্রফি। ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ এশিয়া কাপ, সেই আসরেই বাংলাদেশ প্রথম কোনো ওয়ানডে ম্যাচ খেলে আইসিসির পূর্ণ সদস্যের বিপক্ষে। সেই দলটি ছিল পাকিস্তান। সেই ম্যাচে অনভিজ্ঞ বাংলাদেশ পেরে ওঠেনি। আর তারা সেই হারের প্রতিশোধই যেন নিল ১৯৯৯ বিশ^কাপে। ওয়াসিম আকরামদের সেই দল ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলও। তার আগে একই বছর ত্রিদেশীয় সিরিজে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি করেছিলেন মেহরাব হোসেন অপি। সে এক ইতিহাস। এরপর আরও কত সেঞ্চুরি এলো বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ব্যাটে! তবে প্রথম সবসময় অবিস্মরণীয়, অনন্য ও ইতিহাস।

তেমন এক ইতিহাস গড়লেন ফারজানা হক পিংকি। বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেটে প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি। আর সেটিও ঢাকার মাটিতে, মিরপুরে পরাক্রমশালী ভারতের বিপক্ষে। বাংলাদেশের মেয়েদের পরিসরে যাতায়াত বেশিদিনের নয়। আর গণ্ডিটাও বেশ ছোট। তবে সেখানেই দ্যুতি ছড়াচ্ছেন নিগার সুলতানা জ্যোতিরা। সম্প্রতি মিরপুরে রোমাঞ্চকর ওয়ানডে সিরিজ ড্র করেছে ভারতের বিপক্ষে। প্রথম ম্যাচ জিতে ইতিহাস গড়ার পর দ্বিতীয় ম্যাচে হার। আর সিরিজ নির্ধারণী শেষ ম্যাচে নাটকীয় টাই। সেই ম্যাচেই ওপেনার ফারজানা ১৬০ বলে ৭ চারে খেলেন ১০৭ রানের ইতিহাস গড়া ইনিংস। এখন এই ম্যাচটিই হয়ে ওঠেছে আন্তর্জাতিক মহলে যত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজ ড্র মেনে নিতে পারেননি ভারতীয় অধিনায়ক হারমানপ্রীত কৌর। শেষ ম্যাচে অমন নাটকীয় টাই দেখে হয়তো রক্ত চড়েছিল তার মাথায়। ম্যাচটিতে নিজের ব্যাটিং ব্যর্থতা তো আছেই। আম্পায়ারের সঙ্গে বাগ-বিতণ্ডার পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ অধিনায়ক জ্যোতিকেও কটূক্তি করেন তিনি। যা মোটেও খেলোয়াড়ীসুলভ নয়। তার জন্য হারমানপ্রীতকে নিজ দেশের ক্রিকেটারদের তো বটে, বাইরের ক্রিকেটাররাও সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। এমন অশোভন আচরণের শাস্তি হিসেবে দুটি ভিন্ন অপরাধে ম্যাচ ফির ৭৫ ও ২৫ শতাংশ কাটা গেছে তার। আইসিসির ৪টি ডিমেরিট পয়েন্ট পাওয়ার পাশাপাশি দুই ম্যাচ নিষিদ্ধও হয়েছেন।

খুব কাছে গিয়েও ভারতের বিপক্ষে প্রথমবার ওয়ানডে সিরিজ জিততে না পারলেও আক্ষেপ করার কথা নয় বাংলাদেশের। মিরপুরে সীমিত ওভারের দুই সিরিজে বাংলাদেশের প্রাপ্তি যে অনেক! টি-টোয়েন্টিতে এর আগেও ভারতের বিপক্ষে জিতেছেন জ্যোতিরা। এবার তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচটি জিতে হোয়াইটওয়াশ এড়িয়েছে। সেই ধারাবাহিকতা তারা দেখিয়েছে ওয়ানডে সিরিজে। প্রথম ম্যাচে বৃষ্টি আইনে ৪০ রানের জয়। তবে পরের ম্যাচে বাজে হার, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে পিংকির ইতিহাস গড়া সেঞ্চুরিতে ৪ উইকেটে ২২৫ রানের সংগ্রহ। এই ম্যাচটাও প্রায় মুঠোয় পুরেছিল বাংলাদেশ। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে মারুফা আক্তার ও সুলতানা খাতুনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে শুরুতে ২ উইকেট হারিয়ে বসে ভারত। সেখান থেকে ওপেনার স্মৃতি মান্ধানার ফিফটিতে ৩ উইকেটে ১৩৯।

কিন্তু সফরকারীরা যখন জয়ের কথা ভাবছে তখনই নাহিদা আক্তারের ঘূর্ণিতে ম্যাচে ফিরে বাংলাদেশ। দেখতে দেখতে ২১৭ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে হারের শঙ্কায় ভারত। তবে অলরাউন্ডার জেমিমাহ রদ্রিগেজের সঙ্গে শেষ উইকেটে মেঘনা সিংহের জুটিতে ধড়ে একটু প্রাণ ফিরে পায় সফরকারীরা। তবে মারুফা করা শেষ ওভারের আগুনঝরা তৃতীয় বলটিই সব হিসেব চুকিয়ে দিল। ভারতের স্কোরও তখন সময়। বাকি চার বলে ১ রান নিলেই জয় তাদের। আর টাইয়ের জন্য বাংলাদেশের দরকার এক উইকেট। মারুফার অফসাইডের দুর্দান্ত গতির ডেলিভারি টোকা দিতে গিয়ে জ্যোতির হাতে ক্যাচ মেঘনা। বাংলাদেশ মেতে ওঠে সিরিজ ড্রয়ের আনন্দে।

এই ম্যাচেই মারুফা দেখিয়ে দিলেন, হারের আগ পর্যন্ত হারতে নেই। করে যেতে হয় লড়াই। বাংলাদেশের মেয়েরাও বিশ্বাস করেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের বয়স কম হলেও বিশ্বসেরা হওয়ার জন্য এই মানসিকতায় প্রয়োজন। এভাবেই তারা এগিয়ে যাবেন। জ্যোতি-মারুফা-পিংকিদের পারফরম্যান্সে খুশি হয়ে পুরস্কার ঘোষণাও করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। দলীয় ও ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের জন্য ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের। মেয়েদের এতদূর আসার পেছনে রয়েছে অনেক লড়াই ও শ্রমের গল্প। সেসব গল্প না হয় আরেকদিন হবে। তবে সময় এসেছে আমাদের মেয়েদের পৃষ্ঠপোষকতা করার। সে ফুটবলে হোক বা ক্রিকেটে। পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে অনেকের পথচলায় থেমে যাবে। যে সিরিজটিতে কোনো স্পন্সর ছিল না কোনো চ্যানেল টিভি সত্ত্ব-ই কিনতে চায়নি, সে সিরিজটিই এখন বিশ্বক্রিকেটে বাংলাদেশের মাথাটা উঁচু করে দিয়েছে।

এ বৈষম্য দূর হোক

বিশ্বকাপ মানেই সাজসাজ রব। যেন এক বিশাল মেলা। টানা কয়েকদিন ধরে চলা এই মেলা। ভেঙে গেলে হৃদয়ে বিরহের বাণ আসে। ক্রিকেট হোক বা ফুটবল কিংবা অলিম্পিক; ক্রীড়াঙ্গণের এসব উৎসব মানে মানুষের এক মিলনমেলা। প্রতিবছরই তো কোনো না বিশ্বকাপ চলছেই। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে কাতারে বসল ফুটবল বিশ্বকাপ। ওয়ানডে বিশ্বকাপ হবে এ বছরের অক্টোবরে, ভারতে। তার আগে চলছে আরেকটি বিশ্বকাপ। বাংলাদেশের মানুষ হয়তো সেটি জানে না। জানলেও আগ্রহ কম।

অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডে (চলমান) নারী ফুটবল বিশ্বকাপের খবর ক’জনে জানে! ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের যেকোনো ইভেন্ট এখনো আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠতে পারেনি। বলা চলে, হয়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। তার কারণ পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। নারীরা এখনো পুরুষদের মতো খেলাধুলায় অগ্রসর না হলেও প্রায় প্রতিটি ডিসিপ্লিনে অংশ নেয়। আজ আমাদের দেশের নারীরাও শুধু গৃহস্থালি সামলাচ্ছেন না। ক্রিকেট, ফুটবলসহ বেশকিছু জনপ্রিয় ক্রীড়াক্ষেত্রে বয়ে আনছেন দেশের সম্মান।

তারপরও নারীদের খেলাধুলা দেখে নাক সিঁটকানো মানুষের সংখ্যা কম নেই। আমাদের দেশে তো আছেই, বিদেশেও এখনও পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার মেয়েদেরে ক্রীড়াক্ষেত্র। সেসব যাক, আজ আমরা করব মেয়েদের ফুটবল বিশ^কাপের গল্প। কারণ এই মুহূর্তে বৈশ্বিক লড়াই বলতে ওই একটিই চলছে। মেয়েদের ফুটবলে লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, নেইমার, কিলিয়ান এমবাপ্পেদের মতো তারকা নেই। যার কারণে হয়তো বিশ্বকাপের সাজসাজ যে রব সেটা তেমন দেখা যায় না। যার কারণে ওশেনিয়া অঞ্চলে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপে মাঠে দর্শক খরা কাটানোর জন্য ফ্রি বিতরণ করতে হয়েছে টিকিট। তবে সেটির সফলতাও পাওয়া যাচ্ছে। মাঠে দর্শকদের উপস্থিতি বেশ লক্ষ্যণীয়। জমে ক্ষীর এই বিশ্বকাপের ১০ম আসর। ২০ জুলাই উদ্বোধনী ম্যাচে নরওয়ের বিপক্ষে জয় পায় নিউ জিল্যান্ড। তাতেই ইতিাহাস। নারী বিশ্বকাপ ইতিহাসে এটাই যে প্রথম জয় তাদের।

নারী বিশ্বকাপ শুরু ১৯৯১ সালে। চার বছর অন্তর অন্তর শুরু হওয়া এই বিশ্বকাপের এটি দশম আসর। ৩২ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ছেলেদের বিশ্বকাপে যেমন সর্বোচ্চ শিরোপা জিতেছে ব্রাজিল, মেয়েদের ফুটবলে যুক্তরাষ্ট্রই পরাশক্তি। দুবার শিরোপা জিতেছে জার্মানি। একবার করে জাপান ও নরওয়ে। শুরুতে এই বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের নাম ছিল ‘ফিফা নারী বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ’। প্রথম আয়োজিত হয় চীনে, ১৯৯১ সালে। মূলত ছেলেদের বিশ্বকাপের এক বছর পরে বসে এই আসর। এখানেও পেরিয়ে আসতে হয় বাছাইপর্বের সাঁকো। এবার প্রথমবারের মতো হচ্ছে ওশেনিয়ার দুই প্রতিবেশি অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডে। অংশ নিয়েছে ৩২ দল। দুই দেশে যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন, এবারই প্রথম। ইতোমধ্যে এ টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্ব শেষে শুরু হয়েছে নকআউট রাউন্ড।

গত মাসে ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা আইসিসি জানিয়েছিল, এখন থেকে ছেলেদের বিশ্বকাপের মতো নারী বিশ্বকাপেও সমান প্রাইজ মানি থাকছে। কেবল বিশ্বকাপে নয়, ছেলে ও মেয়েদের দুই ক্ষেত্রেই আইসিসির অধীনে যত টুর্নামেন্ট হবে, সমান প্রাইজ মানি দেওয়া হবে। এমনকি অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের। এমন অসাধারণ সিদ্ধান্তের জন্য আইসিসি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

তবে ফুটবলের ক্ষেত্রে অবশ্য এই বৈষম্য এখনো থাকছে। ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা ফিফা এখনো তেমন কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। ২০২২ বিশ্বকাপে প্রাইজ মানি ছিল রেকর্ড ৪৪০ মিলিয়ন (মার্কিন) ডলার। যা ২০১৮ বিশ^কাপের চেয়ে ৪০ মিলিয়ন ডলার বেশি। ২০১৪ বিশ্বকাপে দেওয়া হয়েছিল ৩৫৮ মিলিয়ন ডলার। কাতার বিশ্বকাপে বাজেট ছিল ৪.৬ বিলিয়ন ডলার। যেখানে ২.৬ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে সম্প্রচার সত্ত্ব থেকে। আর চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা কত পেয়েছিল জানেন? রেকর্ড ৪২ মিলিয়ন ডলার!

প্রতি আসরে বাজেট, প্রাইজমানি, চ্যাম্পিয়নদের টাকার অংক যে বাড়বে সেটি বলে দেওয়াই যায়। তবে সে তুলনায় মেয়েদের বিশ্বকাপ এখনো অনেক পিছিয়ে। এটা ঠিক যে, মেয়েদের ফুটবলের প্রতি মানুষের তেমন আগ্রহ এখনো তৈরি হয়নি। নেই খুব বেশি তারকা। যা আছে, তাদের নামই বা ক’জনে জানেন! রাত জেগে তো কেউ আর মেয়েদের ক্লাব ফুটবল হোক বা কোনো আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ দেখে না। যা একটু আলোচনা, বিশ্বকাপ এলেই।

ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো জানিয়েছেন, ২০২৩ নারী বিশ্বকাপের প্রাইজ মানি ১১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চ্যাম্পিয়নরা পাবে ১০.৫ মিলিয়ন ডলার। রানার আপরা পাবে ৭.৫ মিলিয়ন ডলার। এর বাইরে, ৬.২ মিলিয়ন ডলার ভাগ করে দেওয়া হবে অংশ নেওয়া খেলোয়াড়দের। মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়নে প্রায় ৪.৩ মিলিয়ন দেওয়া হবে দেশগুলোর ফুটবল ফেডারেশনকে।

একটু তুলনা করলেই দেখা যায়, ছেলে ও মেয়েদের ফুটবলের ফারাক ও বৈষম্য কতটুকু। যেখানে ছেলেদের লো-ভোল্টেজ কোনো ম্যাচ দেখার জন্য টিকিট মেলে না সেখানে মেয়েদের ফুটবল বিশ্বকাপের টিকিট দিতে হচ্ছে ফ্রিতে। এই বৈষম্য কি আদৗ কাটবে? ছেলেদের মতো মেয়েদের ফুটবলেও কি বিনিয়োগ করবে না বহুজাতিক কোম্পানিগুলো? এসব ক্ষেত্রে পার্থক্য যা হোক না কেন, মাঠের খেলায় অবশ্য উত্তেজনার কমতি নেই মেয়েদের ফুটবলে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seven − seven =