প্রেম, অবিশ্বাস আর প্রতিশোধের গল্প

ঈদুল আজহায় ‘সুড়ঙ্গ’ ও ‘প্রিয়তমা’ সিনেমার পাশাপাশি কম আলোচনায় ছিল ‘প্রহেলিকা’ সিনেমা। চয়নিকা চৌধুরীর পরিচালিত দ্বিতীয় সিনেমাটির ভালো-মন্দ নিয়ে এবারের আলোচনা।

গল্প: ‘প্রহেলিকা’ যার বাংলা অভিধানে শব্দের অর্থ ধাঁধা। সিনেমার নামের সঙ্গে গল্পের মিল ছিল একদম। সিনেমা জুড়ে ছিল গোলকধাঁধা। সিনেমার গল্প ইউনিক। কিন্তু গল্পে তেমন জটিলতা নেই। সিনেমার শুরুতেই দেখা যায়, মনা নামের এক ব্যক্তি এক সমস্যায় পড়ে এলাকার সবচেয়ে বিত্তশালী ও সংগীত অনুরাগী জামশেদের রাজপ্রাসাদে আশ্রয় নেয়। বাড়িতে আসার পর পরিচয় ঘটে জামশেদের স্ত্রী অর্পার সঙ্গে। যিনি অপরূপ সুন্দরী। বাড়িতে মনার আবির্ভাব ঘটার পর জামশেদ ও অর্পার মধ্যকার পারিবারিক সম্পর্কের অজানা রহস্য উন্মোচন হতে থাকে। সিনেমার পরতে পরতে ছিল রহস্য। একের পর এক রহস্য সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

চিত্রনাট্য: ‘প্রহেলিকা’ সিনেমার কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য লিখেছেন পান্থ শাহরিয়ার। সিনেমাটির সবচেয়ে ভালো দিক চমৎকার একটি প্লট। ‘প্রহেলিকা’ অনেকটা ব্যতিক্রম শুধু গল্পের জন্য। সিনেমার সংলাপ নিয়ে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ রয়েছে। বেশকিছু সংলাপ মনে গেঁথে থাকার মতো। সিনেমার চিত্রনাট্য খানিকটা দুর্বল। চিত্রনাট্য দুর্বল হওয়ায় ফলে স্ক্রিন-প্লে খাপছাড়া হয়েছে। চিত্রনাট্য দুর্দান্ত হলে একদম ছক্কা হাঁকাতে সক্ষম হতো সিনেমাটি।

অভিনয়: ‘প্রহেলিকা’ সিনেমায় মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাহফুজ আহমেদ, বুবলী ও নাসির উদ্দীন খান। নিঃসন্দেহে সিনেমার সবচেয়ে বড় পজিটিভ দিক অভিনয়শিল্পীদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। ‘অর্পা’ চরিত্রে বুবলী ক্যারিয়ার সেরা পারফর্ম করেছেন। সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রীতিমতো প্রতিটি সিকুয়েন্সে মুগ্ধ করেছেন তার অভিনয়শৈলী দিয়ে। পুরোটা সময় ন্যাচারাল পারফর্ম করেছেন তিনি। চিত্রনায়িকা থেকে অভিনেত্রী হওয়ার যাত্রায় তিনি পুরোপুরি সফল এই সিনেমায়। নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য বুবলীর অভিনয় সত্তাটাকে এভাবে বের করে আনার জন্য। ‘অর্পা’র স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভার্সেটাইল অভিনেতা নাসির উদ্দীন খান। ওটিটির কল্যাণে নাসির উদ্দীন খান সকলের প্রিয় অভিনেতা। কিন্তু সিনেমায় ভিন্ন এক রূপে দেখা যায়। ‘জামশেদ’ চরিত্রে ভিন্ন এক নাসির উদ্দীন খানকে আবিষ্কার করেছি। এমন চরিত্রে নাসির উদ্দীন খানের আরো যুক্ত হওয়া প্রয়োজন।

নিঃসন্দেহে সিনেমার সবচেয়ে বড় স্টার ছিলেন মাহফুজ আহমেদ। বাংলা নাটকের রোমান্টিক হিরো বড় পর্দায় ব্যাক করেছেন আট বছর পর এই সিনেমার মাধ্যমে। মাহফুজ অভিনীত শেষ সিনেমা ‘জিরো ডিগ্রি’ মুক্তি পেয়েছিল ২০১৫ সালে। ‘মনা’ চরিত্রে মাহফুজ আহমেদ আউটস্ট্যান্ডিং পারফরম্যান্স করেছেন। এককথায় দুর্দান্ত! ভীতু প্রকৃতির এক মানুষের চরিত্রের সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে মিশে গিয়েছেন। চরিত্রটার মাঝে ভয় আর সংশয় ছিল যে পরিমাণ, তা তিনি খুবই নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পরিমিত অভিনয় করেছেন তিনি। এ কে আজাদ সেতু বরাবরই মতোই ন্যাচারাল পারফরম্যান্স করেছেন। শেষ দিকে রাশেদ মামুন অপু কমিক রিলিফ দিয়েছে। যখনই স্ক্রিনে এসেছেন দর্শকদের হাসিয়েছেন ডায়ালগ ডেলিভারি আর অভিনয়শৈলী দিয়ে। অন্যান্য চরিত্রে সকলেই ভালো অভিনয় করেছেন।

টেকনিক্যাল দিক: চয়নিকা চৌধুরী প্রথম সিনেমার চেয়ে দ্বিতীয় সিনেমার টেকনিক্যাল পার্ট বেটার হয়েছে। সিনেমায় দৃশ্যধারণ চোখে তৃপ্তি দিয়েছে। জমিদার বাড়ির পুকুর, জলসা ঘর, খোলা উঠান, হাওরের দৃশ্য, শাপলার বিল; সব দৃশ্যই ছিল অসাধারণ। সুমন হোসেন ক্যামেরা হাতে পুরোটা সময় মুগ্ধ করেছেন। কিছু ফ্রেম চোখে লেগে থাকার মতো। সিনেমার কালার গ্রেডিং খুবই ভালো হয়েছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও ভালো লেগেছে।

সংগীত: ‘প্রহেলিকা’ সিনেমাকে মিউজিক্যাল ফিল্ম বলা যেতে পারে। সিনেমায় চমৎকার কিছু গানের ব্যবহার দেখা গেছে। ইমন সাহার সুর-সংগীতে সিনেমার প্রতিটি গানই ছিল শ্রুতিমধুর। রোমান্টিক ধাঁচের ‘মেঘের নৌকা’ শিরোনামে গানটি বেশ লেগেছে। গানের দৃশ্যায়নে মাহফুজ-বুবলী জুটির রসায়ন ছিল চোখে দেখার মতো। আসিফ ইকবালের লেখা গানটি ইমরান ও কোনালের দ্বৈত কণ্ঠে পূর্ণতা দিয়েছে। সেমি ক্লাসিক্যাল ধাঁচের ‘হৃদয় দিয়ে’ শিরোনামের গানটিও লিখেছেন আসিফ ইকবাল। সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন কিশোর দাস এবং গেয়েছেন স্বরলিপি ও কিশোর নিজে। গানটি অন্যরকম একটি অনুভূতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ‘বিধুর ভালোবাসা’ শিরোনামের গানটি লিখেছেন জামাল হোসেন এবং সংগীতায়োজন করেছেন আকাশ মাহমুদ। গানটি গেয়েছেন আকাশ মাহমুদ ও সিঁথি সাহা। গানটি সিনেমায় দেখে ভালো লেগেছে। সিনেমার প্রতিটি গানের কথা ও সুর তো সুন্দর হয়েছে এর পাশাপাশি প্রতিটি গানের দৃশ্যধারণে ছিল বিশেষ যত্নের ছাপ। মিউজিক্যাল ডিপার্টমেন্টে ‘প্রহেলিকা’ দশে দশ পাবে চোখ বন্ধ করে।

নির্মাণ: রোমান্টিক নাটক নির্মাণের জন্য খ্যাত চয়নিকা চৌধুরীর দ্বিতীয় সিনেমাও ছিল রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন। ছোট পর্দা থেকে উঠে আসা চয়নিকা চৌধুরী নিজেকে ‘প্রহেলিকা’ সিনেমায় প্রমাণ করলেন তিনি বড় পর্দায় ভালো কিছু করতে সক্ষম। নির্মাণের দিক থেকে ‘প্রহেলিকা’ সিনেমা এবছরের অন্যতম সেরা কাজ। নির্মাতা হিসেবে তিনি প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে ভালো করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। নিজের পরিপক্বতার ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স বের করে আনা থেকে শুরু করে শ্রুতিমধুর সংগীত কিংবা চোখ জুড়ানো সিনেমাটোগ্রাফি সবকিছুই করেছেন তিনি। ক্যাপ্টেন অফ দ্য শিপ হিসেবে চয়নিকা চৌধুরী নিঃসন্দেহে লেটার মার্ক পাবেন। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে নারী নির্মাতার সংখ্যা কম সেখানে বাণিজ্যিক সিনেমায় চয়নিকা চৌধুরী প্রথম সিনেমার অনেক ভুল-ভ্রান্তি শুধরে ‘প্রহেলিকা’ উপহার দিয়েছেন এটা আসলেই আনন্দের অনুভূতি জাগায়।

নেগেটিভ দিক: সিনেমার নেগেটিভ দিক হচ্ছে টানটান উত্তেজনা ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি শেষ পর্যন্ত। চিত্রনাট্যে দুর্বলতা লক্ষ্য করা গেছে। নাসির উদ্দীন খানকে ভিন্ন এক চরিত্রে দেখতে পেলেও কিছু কিছু সিকুয়েন্সে নাসির উদ্দীন খানের ডায়ালগ ডেলিভারি খানিকটা মেকি লেগেছে। গল্পের মধ্যে অত্যধিক রহস্য রাখতে গিয়ে দর্শক অনেক সময় হারিয়ে গিয়েছে মূল গল্পটা থেকে।

পজিটিভ দিক: অবশ্যই সিনেমার গানগুলো অন্যান্য সিনেমার থেকে অনেক সুন্দর। প্রতিটি গান মনে গেঁথে থাকার মতো। অভিনয় শিল্পীদের পারফরম্যান্স। মাহফুজ আহমেদের কাম ব্যাক দুর্দান্ত হয়েছে। বুবলীকে ভিন্নভাবে পাওয়া। নির্মাতা হিসেবে চয়নিকা চৌধুরী নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সিনেমালোজি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eighteen − twelve =