মোনালিসা’র অজানা তথ্য

বিশ্বজুড়ে শিল্পমনা মানুষের কাছে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসা পেইন্টিংটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমানে এই পেইন্টিংটির বাজার মূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পেইন্টিং হিসেবে বললে ভুল হবে না।

বিশ্বখ্যাত চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’ ও এর স্রষ্টা লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে নিয়ে এখনো পৃথিবীর নানান প্রান্তে গবেষণা চলছেই। মোনালিসা শিল্পকর্মটি নিয়ে রয়েছে হাজারো রহস্য। যুগ যুগ ধরে কল্পনা এবং রহস্যে আবদ্ধ করে রেখেছে মানুষদের। গোলাম মোর্শেদ সীমান্তর প্রতিবেদনে এই শিল্পকর্মটি নিয়ে জানা-অজানা তথ্য জানাচ্ছেন।

কাকে দেখে আঁকা ‘মোনালিসা’

এতো জনপ্রিয় ছবিটি। এতো রহস্য ছবিটির নিয়ে। কাকে দেখে ছবিটি এঁকেছিলেন লিওনার্দো? ১৬ শতকের শুরুতে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি যেসব ছবি আঁকেন তা নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা ছিল। অনেকে বলতেন, নারী ও পুরুষ উভয়েই ঐ ছবির মডেল হয়েছিলেন। তবে আরও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ব্যাখ্যা মতে, মোনালিসা আসলে ফ্লোরেনটাইনের এক রেশম ব্যবসায়ীর স্ত্রী লিসা দেল জিওকোন্ডো।

মোনালিসার নাম ভুল

আপনি কি জানেন মোনালিসা চিত্রকর্মটির নামের বানান যে ভুল। চিত্রকর্মটির আসল নাম ছিল গড়হহধ খরংধ যা ইতালিয়ান গধফড়হহধ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। গড়হহধ অর্থ ‘আমার সহধর্মিণী’।

সুরক্ষায় ব্যয় খরচ ৫০ লক্ষ টাকা

ফ্রান্সে আসা ৮০ শতাংশ পর্যটক ল্যুভ জাদুঘরে শুধুমাত্র মোনালিসা চিত্রকর্মটি দেখতে আসে। ১৯৫৬ সালে এই ছবিটি ভাঙার চেষ্টা করা হয় দুবার। এক বলিভিয়ান পর্যটক তো আস্ত একটি পাথর ছুড়ে মেরেছিল ছবিটির ওপর। আরেকজন ছবিটির ওপর অ্যাসিড ছুড়ে মারে। ফলে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় চিত্রকর্মটি। ছবিটির নিরাপত্তার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তারপর থেকে ছবিটি রাখার জন্য ফ্রান্সের ল্যুভ মিউজিয়ামে বিশেষ একটি কক্ষ তৈরি করা হয়। কক্ষটির তাপমাত্রা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছে, যাতে মোনালিসার ছবিটি নষ্ট হয়ে না যায়। এই কক্ষটি বানাতে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।

মোনালিসার হাসি আঁকা হয়েছে বিশেষ পদ্ধতিতে

মোনালিসা ছবিটি তার রহস্যজনক হাসির জন্য বিখ্যাত। তার হাসির মাঝে লুকিয়ে আছে নানান রহস্য। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদগণ শিল্পকর্মটির রহস্য ভেদ করার জন্য দীর্ঘ গবেষণা করে বিস্ময়কর সব তথ্য পেয়েছেন। মোনালিসার হেঁয়ালিপূর্ণ হাসির রহস্য ভেদ হয় ২০০৮ সালে। ছবিটি আঁকার সময় ভিঞ্চি বিশেষ একটি কৌশল ব্যবহার করেন। যার নাম ‘স্ফুম্যাটো’। যার অর্থ ‘লাইন বা সীমানা ছাড়াই ধোঁয়ার পদ্ধতি’। তখনকার সময়ে রূপরেখা বা লাইন করে চিত্রাঙ্কন করা হতো। তবে ভিঞ্চি ছিলেন তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। লিওনার্দো লাইন বা রূপরেখা ব্যবহার করেননি। আলো এবং ছায়ার এক বিশেষ বিভ্রম তৈরি করতে বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ছবিটিতে কাছের সাবজেক্টগুলোকে স্পষ্ট, আর দূরের সাবজেক্টগুলোকে আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে অস্পষ্ট করে তোলেন। লিওনার্দো দৃষ্টিকোণ এবং ছায়া তৈরির মাধ্যমে হাসিটি তৈরি করেন।

ছবিটি আঁকার সময় তিনি রাত কাটাতেন ফ্লোরেন্স স্টুডিওর কাছের একটি হাসপাতালে। সেখানে তিনি পড়াশোনা করেছেন মানুষের ত্বক, পেশি ও স্নায়ু নিয়ে। হাসির সময় মানুষের মুখের প্রতিটি পেশি কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, পেশিগুলো কীভাবে নড়াচড়া করে, সেসব বিশ্লেষণ মোনালিসার হাসিতে ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন গবেষকেরা। লিওনার্দো মারা যাওয়ার পর প্রায় ছয় হাজার পাতার একটি নোটবই উদ্ধার করা হয়েছিল। সেখানে পেশি নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রমাণ পাওয়া যায়। আলাদা আলাদা কোণ থেকে দেখলে এই ছবিটির হাসি পরিবর্তন হতে থাকে। সামনে থেকে দেখলে মনে হবে মোনলিসার ঠোঁট বাঁকা হয়ে আছে। আবার দূর থেকে দেখলে মনে হবে সে হাসছে।

রহস্যময় সেতু

ছবিটি কাছ থেকে ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মোনালিসার পেছনে একটি রহস্যময় সেতু আছে। ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমিতে খিলানযুক্ত সেতুর অবস্থান। বাস্তবে সেতুটির অস্তিত্ব ও অবস্থান এখনও অজানা। তবে শিল্প গবেষক ও ইতিহাসবিদ সিলভানো ভ্যান্সেলি ধারণা করেছেন, ইতালির পার্বত্য অঞ্চল তাসকানির লাতেরিনা শহরে একটি প্রাচীন পাথরের খিলানযুক্ত সেতুর অবশিষ্টাংশই মোনালিসা ছবিটির সেই সেতু। ইতালির তাসকানি শহরেই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জন্মস্থান। ১৫০১ থেকে ১৫০৭ সাল পর্যন্ত ভিঞ্চি এখানে কাজ করেছিলেন। প্রাচীন রোমান ও এটরুস্কান আমলে তৈরি করা সেতুটির কাঠামো প্রায় দুই হাজার বছর পুরোনো! ভার্চ্যুয়ালি সেই সেতুটিকে আবারো তৈরি করা হয়েছিল এবং সেতুটি মোনালিসা’র পটভূমির সেতুটি সাথে মেলানো হয়েছিল। তবে সেতুটির অবস্থান সম্পর্কে অনেক বির্তক রয়েছে।

যে ঠোঁট আঁকা সম্পূর্ণ হয়নি

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ৫১ বছর বয়সে মোনালিসা ছবিটি আঁকার কাজ শুরু করেন। মোনালিসা ছবিটি তৈরি করতে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির দীর্ঘ ১০ বছর সময় লেগেছিল। দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যেও তিনি ঠোঁট আঁকা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। দীর্ঘদিন গবেষণার পরও আজ পর্যন্ত জানা যায়নি মোনালিসা ছবির ঠোঁটের কোন অংশের কাজ এখনো অসম্পূর্ণ।

কাগজ ছাড়া আঁকা হয়েছে মোনালিসা

দেখলে মনে হতে পারে মোনালিসা বোধহয় সেই সময়ের বিশেষ কোনো কাগজে আঁকা! তবে ছবিটি কোনো কাগজ বা কাপড়ের উপর আঁকা হয়নি। ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি পাইন গাছের কাঠের তিনটি তক্তার ওপর মোনালিসা ছবিটি অঙ্কন করেছিলেন।

হারিয়ে যাওয়ার পর জনপ্রিয়তা

বর্তমানে মোনালিসা যত জনপ্রিয়, শুরুর দিকে কিন্তু এতোটা ছিল না। হারিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ‘মোনালিসা’ কিন্তু সেই অর্থে বিখ্যাত কোনো শিল্পকর্ম ছিল না। ১৯১১ সালের ২১ আগস্ট বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরের ভেতরে রাখা এক আলমারি থেকে বেরিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। জাদুঘরের দেয়াল থেকে মোনালিসার ফ্রেম নামালেন। তারপর ফ্রেম থেকে ছবিটি খুলে নিজের ওভারকোট দিয়ে মুড়ে বেরিয়ে গেলেন ল্যুভর থেকে। টের পায়নি কাকপক্ষীও! ঐ ব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়ার আগে প্রায় দুই বছর ছবিটির কোনো হদিস ছিল না। তারপর ছবিটি আবারও ল্যুভরে ফিরে আসে। এরপর থেকে ছবিটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়।

অজানা প্রাণীর অস্তিত্ব

ভৌতিক ঘটনা নির্ভর জনপ্রিয় ওয়েবসাইট প্যারানরমাল কুশ দাবি করে, ভিনগ্রহের প্রাণীর রহস্য লুকিয়ে আছে মোনালিসা ছবিটিতে। মোনালিসা ছবিটিকে যদি নব্বই ডিগ্রি এঙ্গেলে প্রিন্ট করা হয় এবং সেই ছবিটি আয়নায় সামনে ধরা হয় তখন এক আশ্চর্য ইমেজ তৈরি হয়। যার আকৃতি অনেকটা মহাবিশ্বের অজানা প্রাণী বা এলিয়েনের মতো! আপনিও এভাবে দেখার চেষ্টা করতে পারেন।

আউটলাইন না রেখে ছবি আঁকা

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এই চিত্রটি আঁকার সময় এমন ধরনের অঙ্কন কৌশল ব্যবহার করেছেন যাতে কোনো আউটলাইন না থাকে। এমন শিল্প পাণ্ডিত্য আজ পর্যন্ত কোনো চিত্রশিল্পী এতো ভালোভাবে করতে পারেনি, যা ভিঞ্চি বেশ সুন্দরভাবেই চিত্রটিতে করেছেন। তবে শুধু আউটলাইন মোনালিসার হাসি বদলের কারণ নয়, মূল কারণটি লুকিয়ে রয়েছে মোনালিসার চোখে। যখন মোনালিসার চোখের দিকে তাকানো হয় তখন তাকে বেশ হাসিখুশি মনে হয়। কিন্তু ঠোঁটের দিকে তাকালে সেই হাসির দেখা পাওয়া যায় না।

চোখের পাতা ও ভ্রু না থাকার রহস্য

কখনো কি খেয়াল করেছেন, মোনালিসা ছবিতে চোখের পাতা ও কপালে ভ্রু নেই! তবে ২০০৪ সালে বিজ্ঞানী প্যাসকেল স্কটে মোনালিসার পেইন্টিংকে স্পেক্টার লাইটিং প্রযুক্তি এবং হাই ইনটেনসিটি ক্যামেরার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে ছবিটিতে শরীরের বিভিন্ন অংশ চিহ্নিত করেন। ছবিগুলোকে ২৪ গুণ ম্যাগনিফাই করে দেখেন, একসময় চোখের পাপড়ি এবং কপালে ভ্রু ছিল। তবে দীর্ঘদিন পরিচর্যা করতে করতে তা মুছে গেছে।

চুলের থেকে পাতলা যে রং

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তার আঁকা ছবিতে যে রঙ ব্যবহার করেছিলেন তার ঘনত্ব মাত্র ৪০ মাইক্রোমিটার; যা কি না একটি চুলের থেকেও সূক্ষ্ম ছিল! রং করার জন্য তিনি কয়লাও ব্যবহার করেছিলেন। তবে সেই পাতলা রং ব্যবহার করার পরও পাঁচশো বছর ধরে ছবিটি কীভাবে এখনো টিকে আছে তা এক বিস্ময়! তবে গবেষকেরা দাবি করেন, মূলত মোনালিসা ছবিটির নিচে আরও তিনটি খসড়া ছবি রয়েছে। তবে কেন ভিঞ্চি নিচে তিনটি খসড়া ব্যবহার করেছেন, তা আজও অজানা এবং রহস্যে ঘেরা।

মৃত্যুর জন্য দায়ী মোনালিসা

জার্মান নাজিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ‘মোনালিসা’কে ৬ বার স্থানান্তর করা হয়। ১৫১৯ সালে ভিঞ্চির মৃত্যুর পর থেকেই ছবিটি ফ্রান্সে রাজাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহের অংশ হয়ে গিয়েছিল। সম্রাট নেপোলিয়ন ছবিটি দেখে এতোটাই মনোমুগ্ধ হয়েছিলেন যে এটিকে নিজের শয়নকক্ষের দেওয়ালে সযত্নে টানিয়ে রেখেছিলেন। ১৮৫২ সালের ২৩ জুন লুই মাসফেরো নামে এক ফরাসি তরুণ শিল্পী প্যারিসে বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে নিজের সুইসাইড নোটে তিনি লিখে রেখেছিলেন এক অবাক করা কথা। তিনি লিখেছিলেন, তার মৃত্যুর জন্য দায়ী মোনালিসার হাসি। এ ঘটনা বিশ্বকে হতবাক করে দেয়।

চোখে গোপন কোড

২০১০ সালে ইটালির জাতীয় সাংস্কৃতিক সংঘ এক বিস্ময়কর তথ্য দেয়। তারা দীর্ঘ সময় গবেষণা করে বের করে, মোনালিসার চোখে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা ধরলে কিছু সংখ্যা ও সংকেত পাওয়া যায়। ডান চোখের মনিতে তারা দেখতে পান ‘এল’,  ‘ভি’ বর্ণ লিখা রয়েছে। আর বাম চোখের মনিতে লেখা আছে ‘বি’ অথবা ‘এস’ বা ‘সি’, ‘ই’ বর্ণদ্বয়। ‘এল’ ও ‘ভি’ দিয়ে লিওনার্দোর নাম বোঝা গেলেও বাকি অক্ষরগুলো অর্থ আজও অজানা।

তৃতীয় নারীর চেহারা

২০০৪ সালে বিজ্ঞানী পাস্কাল কট পুরো বিশ্বকে হতবাক করে দেন। মোনালিসা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণায় পাস্কল বিশেষ আলো ও লেন্স ব্যবহার করে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ছবি তোলেন। তিনি লক্ষ্য করেন, ছবিটিতে তিনটি আলাদা ইমেজ রয়েছে। তৃতীয় ছবিটিতে তিনি দেখলেন অন্য নারীর চেহারা। তবে তার ঠোঁটে কোনো হাসি ছিল না।

হাতে গোপন কোড

মোনালিসার মধ্যে দা ভিঞ্চি আরো একটি গোপন বার্তা লুকিয়ে রেখেছিলেন। গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, মোনালিসার ডান হাতের কাছে গোপন একটি বিশেষ বার্তা দেওয়া আছে। আলট্রা লাইট পদ্ধতিতে এই ছবিটির বিভিন্ন অংশকে ভালোভাবে দেখা হচ্ছিল তখন এটি খুঁজে পাওয়া যায়। এবং এই অক্ষরগুলোর পরপর সাজালে একটি বাক্য তৈরি হয়। যা হলো “La Risposta Si Trova Qui”। বাক্যটিকে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় The Answer Is Here…

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × two =