মৌ সন্ধ্যা
ঊনিশ শতাব্দীতে যাদের হাত ধরে বাংলা সংগীত আলোকিত হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খাঁ। জীবদ্দশায় ১০৩টি বসন্ত পেয়েছিলেন। শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা যারা করেন তাদের কাছে এখনো স্বরণীয় বরণীয় এই গুণী মানুষটি। তরুণ প্রজন্মের কাছে গুল মোহাম্মদ হয়তো এক অপরিচিত নাম। তবে আসল কথা হলো, গুল মোহাম্মদদের স্মরণ না করলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না; বরং তাদের ভুলে গেলে তাদের রেখে যাওয়া মণি মানিক্য থেকে নিজেদেরই বঞ্চিত করা হবে। এই গুণী সংগীত গুরুকে স্মরণ করে তাকে এক ঝলক জানার প্রচেষ্টা তো আমরা করতেই পারি।
কে ছিলেন গুল মোহাম্মদ খাঁ
ইতিমধ্যেই জেনেছেন ঊনিশ শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী ছিলেন গুল মোহাম্মদ খাঁ। তিনি ছিলেন দ্বারভাঙার প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী। গুল মোহাম্মদের জন্ম ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের বিহারের তিরহুত শহরে। পিতা ওস্তাদ আহমদ খাঁ। তার কৈশোর কেটেছে ভারতের পাটনা শহরে। পিতার কাছেই তার সংগীতে হাতেখড়ি। শুরুতে দীর্ঘ আট বছর ধ্রুপদ ও খেয়াল অনুশীলন করেন। তার যখন ১৪ বছর বয়স তখন তার পিতার মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর পিতৃব্য ওস্তাদ হায়দার বকসের কাছে সংগীতের তালিম গ্রহণ করেছিলেন। পিতা ও পিতৃব্যের বদৌলতে তিনি ডাগর ঘরানা বা ডাগর বাণীতে ধ্রুপদ ও খেয়ালে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। গুল মোহাম্মদ বেশ কিছুদিন আগ্রা গিয়েও বসবাস করেছিলেন এবং সেখানে আগ্রা ঘরানায় পারদর্শিতা লাভ করেন।
বিয়ে অতঃপর ঢাকায় পাড়ি
কলকাতায় বেড়ে উঠলেও এক সময় বাংলাদেশে চলে আসেন গুল মোহাম্মদ খাঁ। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি মথুরা-বৃন্দাবনের মুরসান গ্রামের চান্দ খাঁর কন্যা সাকুরান বিবির সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। বিয়ের পনের বছর পর ৩৫ বছর বয়সে সপরিবারে ঢাকা চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে এখানেই বসবাস শুরু করেন। তার সংগীতের আলো ছড়িয়ে যেতে থাকে পুরো দেশে এবং বিদেশে। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বাকি জীবন এই দেশেই কাটিয়ে দেন।
গুল মোহাম্মদ খাঁ’র সংগীতে অবদান
বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গ সংগীত বিস্তার ও বিকাশে গুল মোহাম্মদ খাঁ ছিলেন একজন পথিকৃৎ। তিনি ঢাকায় উচ্চাঙ্গ সংগীতের একটি শিক্ষাকেন্দ্র ও আসর চালু করেছিলেন। সেখানে তার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছেন অনেকেই। তার হাত ধরেই আমরা পেয়েছি ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দীন, দীপালি নাগ, রানী সোম, লায়লা আর্জুমান্দ বানুসহ অনেককেই। ফেরদৌসী রহমান, রওশন আরা, উৎপলা সেন প্রমুখ খ্যাতনামা কণ্ঠ শিল্পীও তার কাছে খেয়াল শিখেছেন। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গুল মোহাম্মদ খাঁ পুরিয়া রাগে খেয়াল পরিবেশন করেছিলেন। তিনি আমৃত্যু ঢাকা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। সংগীত শিক্ষক হিসেবে ছিলেন এই বেতারের সাথে দীর্ঘকাল যুক্ত। পুরিয়া মালকোশ, পুরিয়া বানেশ্রী, মুলতানী এগুলোই ছিল তার প্রিয় রাগ।
পুরস্কার-সম্মাননা
সংগীত সাধনা করে এক জীবনে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন গুল মোহাম্মদ। অনেক সংগীত সাধকদের কাছেও অনুকরণীয় তিনি। ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খাঁ ১৯৬৫ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পুরস্কার পান ১৯৭১ সালে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাকে স্বীকৃতি সংবর্ধনা দেয় তাকে। এদিকে সংগীতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক একুশে পদকে ভূষিত হন।
ডাকটিকিটে গুল মোহাম্মদ
ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খাঁ তার সংগীতের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে নন্দিত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশ সরকার তার ছবি সম্বলিত ডাক টিকিট প্রকাশ করে। রঙিন এই টিকিটে তার জন্ম ও মৃত্যু তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। টিকিটটির মূল্য রাখা হয়েছিল ৬ টাকা। সেই ডাক টিকিট এখন এন্টিক হিসেবে বিক্রি হয়। যেসব সৌখিন মানুষরা টিকিট সংগ্রহ করেন তাদের অনেকের সংগ্রহেই হয়তো আছে এই ডাক টিকিট।
না ফেরার দেশে
১৯৭৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা শহরেই পরলোক গমন করেন ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খাঁ। তাকে স্মরণ করছে রঙবেরঙ। তার প্রতি রইলো অনেক অনেক শ্রদ্ধা। ওপারে শান্তিতে থাকুন বাংলা সংগীতের ধ্রুবতারা।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সুরের মূর্চ্ছনা