আয়মান সাদিক ও মুনজেরিনের শুভ পরিণয়

নীলাঞ্জনা নীলা

সম্প্রতি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক ও একই প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ প্রধান এবং শিক্ষক মুনজেরিন শহীদ। বিয়ের কিছুক্ষণ পরই সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে তাদের ছবি। ছবি নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক এবং প্রশংসা। তাদের বিয়ে পড়ানো হয় মসজিদে। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে তা হলো তাদের বিয়ের আয়োজন ও পোশাক নিয়ে। কাবিনের দিনে তাদের দুজনকেই দেখা যায় স্নিগ্ধ সাজে। সাজ পোশাকের জন্য ভক্তদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন ব্যাপকভাবে। জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের সাজের যুগে তাদের দেখা যায় সাদামাটা সাজে। মুনজেরিন শহীদকে সবাই খুব সাধারণ সাজ পোশাকে দেখেই অভ্যস্ত। বিয়েতেও তিনি তার নিজস্বতা ধরে রেখে স্নিগ্ধ সাজেই ছিলেন। কাবিনের দিন পরেছিলেন বুটিক নকশার কাতান যার আঁচলে ছিল কারুকাজ। সঙ্গে ছিল গোলাপি জর্জেটের ওড়না। গলায় ছিল ছোট নেকলেস। আয়মান সাদিক পরেছিলেন অফ হোয়াইট পাঞ্জাবি।

মুনজেরিনের মেকআপের দায়িত্বে ছিলেন মেকআপ আর্টিস্ট নাভিন আহমেদ। নাভিন আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, মুনজেরিন খুব বেশি প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে চাননি। আর একজন মেকআপ আর্টিস্টের জন্য কম প্রোডাক্ট ব্যবহার করে ব্রাইডাল মেকআপ এক প্রকার চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ খুব ভালোভাবেই উতরেছেন নাভিন আহমেদ। তিনি আরো বলেন, মুনজেরিনের স্কিন ন্যাচারাল ভাবেই খুব সুন্দর। তাই খুব একটা ফাউন্ডেশনের প্রয়োজন হয়নি। মেকআপের আগে খুব ভালোভাবে স্কিন ময়েশ্চারাইজ করা হয়েছে। লিপস্টিক ব্যবহার না করে হালকা লিপটিন্ট রাখা হয়েছিল। আইলাইনার, নকল আইলেশ কিছুই ব্যবহার করা হয়নি।

বিয়ের সাদামাটা পরিবেশ দেখে প্রশংসা করা অনেকেই আয়মান ও মুনজেরিনের গায়ে হলুদের আয়োজন দেখে সমালোচনা করেছেন। কারণ হলুদে ছিল না কোনো আয়োজনের কমতি। কাবিনের মতো হলুদের সাজপোশাকও রীতিমতো ভাইরাল হয়। বিয়েতে যেমন ছিল স্নিগ্ধতা তেমনি হলুদে ছিল না কোনো রঙের অভাব। গায়ে হলুদে রঙিন পোশাক ও রঙিন চশমায় নজর তারা কেড়েছেন সবার। মুনজেরিনের হলুদের সাজেও ছিল ভিন্নতা। সকল কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও ইনফ্লুয়েন্সারদের মিলনমেলা হয়ে উঠে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। নাচ-গান আর হই-হুল্লোড়ে জমে উঠে আয়োজন।

হলুদের কিছুদিন পর আয়োজিত হয় মুনজেরিন ও আয়মানের রিসেপশন। রিসেপশনের সাজে মুনজেরিনকে দেখা যায় অ্যান্টিক গোল্ড ও আইভরি পোশাকে। মুনজেরিনের রিসেপশন মেকআপও করেন নাভিন আহমেদ। কাবিন ও বিয়ের মতো রিসেপশনেও মুনজেরিনের চাহিদা ছিল ন্যাচারাল লুক। সাজ পোশাকের মাধ্যমে মুনজেরিনের মধ্যে ফুটে উঠেছিল আভিজাত্য। বিয়ের প্রতিটি আয়োজনে মুনজেরিনের সাজে প্রমাণ হয়েছে বিয়ের কনে মানেই ভারী সাজ ও গহনা নয়। নিজস্বতা বজায় রেখেও নিজেকে সুন্দরভাবে সবার সামনে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব।

মুনজেরিন ও আয়মান সাদিকের বিয়ের কার্ড হঠাৎ করেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে যায়। ভক্ত ও অনুরাগীরা সেই পোস্ট শেয়ার দিতে থাকেন। কিন্তু তখন তাদের দুজনের কেউই এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। ছবি প্রকাশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা নিজেদের বিয়ের ঘোষণা দেন। তাদের প্রেম নিয়ে গুঞ্জন ছিল কয়েক বছর ধরে। তাদের একসাথে নানা সাক্ষাৎকার ও ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট থেকে সবাই ধারণা করে নিত তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু তারা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ চুপ ছিলেন। তাদের এই বিয়ে হয়তো অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। নিজ নিজ জায়গা থেকে সফলতা অর্জন করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এবং একটি মিষ্টি সম্পর্ক তৈরি করেছেন তারা। তাদের ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক দুটিকেই তারা আলাদা রেখেছেন ও দুটিকেই সম্মান করেছেন।

প্রেম আর ক্যারিয়ার ব্যালেন্স করেও যে জীবনে সুন্দরভাবে চলা যায় তা তারা প্রমাণ করেছেন। কিন্তু এরপরেও তাদের বিয়ে নিয়ে রয়েছে নানা সমালোচনা। অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সহকর্মীকে বিয়ে করা কতটা যুক্তিযুক্ত। সমাজের অনেক স্তরের মানুষ সহকর্মীকে বিয়ে করার ব্যাপারটি ইতিবাচকভাবে দেখছেন না। তবে তরুন প্রজন্ম এ বিষয়ে দারুণ ইতিবাচক। তাদের মতে দুটি সফল ব্যক্তি যদি একসাথে থাকবার সিদ্ধান্ত নেয় তবে অন্যদের কেন এতো সমস্যা হবে?

আয়মান সাদিক ও মুনজেরিনের তারকা শিক্ষক হয়ে ওঠা শুরু হয় ২০১৫ সাল থেকে। আয়মান সাদিকের ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল শিক্ষক হবেন। সেই স্বপ্নের হাত ধরে পথচলা শুরু করেছিল টেন মিনিট স্কুল। কিন্তু তিনি কোনো স্কুলে চাকরি নেননি, নিজেই তৈরি করেন একটি স্কুল। যেখানে লাখ লাখ শিক্ষার্থী একসঙ্গে তার ক্লাস করেন। টেন মিনিট স্কুল শুরুর আগে আয়মান সাদিক বিভিন্ন ওয়েব নির্মাতা কোম্পানিরগুলোর সাথে যোগাযোগ করেন। কিন্তু শুরুতেই ভালো ফল পান না। তখন কিছুটা হতাশ হলেও থেমে থাকেননি। ২০১৫ সালের ১০ মে ওয়েবসাইট লঞ্চ করার দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু লঞ্চিংয়ের ঠিক সাত দিন আগে সব কোডিংগুলো হঠাৎ কিভাবে যেন মুছে যায়। ওয়েবসাইটটি তার কার্যক্ষমতা হারায়। পরবর্তীতে টেন মিনিট স্কুল ১৭ মে লঞ্চ হয়। সেই থেকে শুরু হয় টেন মিনিট স্কুলের যাত্রা। টেন মিনিট স্কুল খোলার পিছনে আয়মান সাদিকের অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি ছিল পড়াশোনাকে আনন্দের বিষয় করে তোলা। কারণ বেশিরভাগ মানুষের কাছেই পড়াশোনা একটি ভীতি ও বিরক্তিকর বিষয়। আনন্দ নিয়ে ও বুঝে পড়লে পড়াশোনা যে একটি মজার বিষয় তা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন আয়মান সাদিক এবং তাতে তিনি সফলও হয়েছেন।

টেন মিনিট স্কুলের মাধ্যমে লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে এক করেছেন তিনি। তিনি বারবার মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ভালো নাম্বারের চেয়ে জ্ঞান অর্জন অনেক বেশি দরকারি। কারণ ভালো রেজাল্ট করার পরেও অনেকের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকে না। ২০১৮ সালে টেন মিনিট স্কুল কুইন্স ইয়াং লিডার অ্যাওয়ার্ড পায়। এছাড়া ২০১৬ সালে লন্ডনে ফিউচার লিডারস লিগ চ্যম্পিয়ান অ্যাওয়ার্ড পায়।

অপরদিকে মুনজেরিন শহীদ বেড়ে উঠেন চট্টগ্রামে। ইংরেজির প্রতি তার আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। করোনার লকডাউনে ঘরে বসে তিনি ইংরেজি বিষয়ক নানা ধরনের কন্টেন্ট বানানো শুরু করেন; যার মাধ্যমে সকলে বেশ উপকৃত হচ্ছিল। টেন মিনিট স্কুলে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ব্লগ রাইটার হিসেবে। পরে হিউম্যান রিসোর্স টিমে কাজ করা শুরু করেন। মুনজেরিন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেন, ছোটবেলা তিনি অংকে বেশ কাঁচা ছিলেন। তাকে দেখলে শান্ত মনে হলেও স্কুলে বেশ দুষ্টামি করতেন। মুনজেরিন মনে করেন, অনলাইন ক্লাসের কদর দিন দিন আরো বাড়ছে। কারণ সবাই এখন প্রযুক্তির সাথে জড়িত। অনলাইন ক্লাসে সবাই যে যার স্থান থেকে অংশ নিতে ও শিখতে পারে। এক্ষেত্রে যাতায়াত ও স্থান পরিবর্তনের কোনো ঝামেলা থাকে না। অনলাইন ক্লাস কতটা কাজে দিতে পারে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ২০২০ সালের লকডাউনে।

এই তো গেল তাদের ক্যারিয়ারের শুরুর কথা। সকলের সমালোচনা ও গুঞ্জনের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজেদের সম্পর্কের শুভ পরিণতি ঘটিয়েছেন তা সকলের প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। নিজেদের সম্পর্ক বিষয়ে কঠোর গোপনীতা বজায় রেখেছেন যা এই প্রজন্মকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করবে। এছাড়া তরুনদের লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা শিষ্টাচারে যেভাবে দক্ষ করার চেষ্টা করছেন তা-ও শিক্ষণীয়। এতোদিন তারা ছিলেন শুধু সফল উদ্যোক্তা, শিক্ষক হিসেবে সবার অনুপ্রেরণা। কিন্তু আয়মান সাদিক ও মুনজেরিন যুগলবন্দী হওয়ার পর অনেকের কাছে ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণার উদাহরণ হয়ে থাকবেন। সর্বদা তাদের হাস্যজ্জ্বল মুখ ও একে অপরকে শ্রদ্ধা করার বিষয়টি আসলেই মুগ্ধ হওয়ার মতো।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 + sixteen =