অপরাজিতা জামান
দক্ষিণি সিনেমা অঙ্গনের যে কজন অভিনেত্রী মেধার জোরে গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছেন সর্বভারতীয় তারকা তাদের মধ্যে অন্যতম নয়নতারা। তামিল-তেলেগু জয় করে ‘জওয়ান’ হয়ে বলিউডে খাতা খুলেছেন তিনি। প্রথম ছবিতেই করেছেন নিজেকে প্রমাণ। চলুন জেনে নেই মালায়লাম থেকে তামিল, তেলেগু হয়ে নয়নতারার বলিউডে বিজয়রথ ছোটানোর গল্প।
নয়নতারা ১৯৮৪ সালে ১৮ নভেম্বর ভারতের কর্নাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরের একটি খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণের সম্ভ্রান্ত প্রজাতি কোদিয়াত্তু পরিবারে জন্ম তার। নয়নতারার বাবা কুরিয়ান কোদিয়াত্তু ছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনির কর্মকর্তা। চাকরি সূত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে থাকতে হয়েছে তাকে। ওই সুবাদে নয়নের শৈশব, কৈশোরও কেটেছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। নয়নতারা থিরুমোলাপরামের বালিকামদম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর নাম লেখান থিরুভাল্লার মারথোমা কলেজে। সেখান থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। চলচ্চিত্রে নয়নতারার জার্নিটা শুরু হয়েছিল মালায়লাম ছবির মাধ্যমে। তবে এর পেছনে একটি গল্প রয়েছে। নয়নতারার কলেজে পড়াকালীন নাম লিখিয়েছিলেন মডেলিংয়ে। বিভিন্ন এজেন্সির হয়ে ফটোশুটে অংশ নিতেন।
সে সময় তিনি নজরে পড়েন দক্ষিণি নির্মাতা সথ্যন আনথিকাডের। নয়নতারার কিছু স্থিরচিত্র হাতে আসে তার। তাতে মুগ্ধ পরিচালক নিজের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন তাকে। চলচ্চিত্রের প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না নয়নের। সোজা না করে দেন। কিন্ত নাছোড়বান্দা পরিচালক। জোরাজুরি করে রাজি করান। শর্ত ছিল এই একটি ছবিতেই অভিনয় করবেন। ‘মানসসিনাক্কারে’ নামের ওই ছবিতে পর্দায় প্রথম অভিনয় করেন তিনি। এ ছবিতে সৌন্দর্য ও অভিনয় দিয়ে সুবাস ছড়িয়েছিলেন এ অভিনেত্রী। ফলে মোহিত হয় দর্শক। চলচ্চিত্রটিও তুমুল ব্যবসা করে। রাতারাতি তারকা বনে যান নয়নতারা। মালায়লাম ছবিতে সাফল্য লাভের বছর দুয়েক পর তামিল সিনেমায় নাম লেখান তিনি।
ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ২০০৫ সাল। ‘অভ্য’ নামের একটি ছবি দিয়ে এই পথচলা শুরু হয় তার। ভাগ্য ভালো ছিল নয়নতারার। তেলেগুর মতো তামিল চলচ্চিত্রাঙ্গনেও তারকা খ্যাতির জন্যে অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। প্রথম সিনেমা দিয়েই দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিলেন। পরের বছর ২০০৬ সালও পক্ষে ছিল তার। এ বছর ‘লক্সমি’ ছবির মাধ্যমে তেলেগু ইন্ডাস্ট্রিতে খাতা খোলেন এবং এখানেও যথারীতি আলোচনায় জায়গা করে নেন। পরপর কয়েকটি ছবির সফলতায় মালায়লাম-তামিল-তেলেগু তিন ইন্ডাস্ট্রিতেই নির্মাতা ও দর্শকের প্রথম পছন্দ হয়ে ওঠেন নয়ন। একের পর এক ডাক পেতে থাকেন। নয়নতারাও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। প্রতিটি ছবিতেই তার উপস্থিতি মন ভরিয়ে দিতে থাকে দর্শকদের।
২০০৭ সাল নয়নতারার ক্যারিয়ারের জন্য ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমায় রানির আসনটি পোক্ত করার বছরও বলা যেতে পারে। এ বছর তিন তিনটি ছবি মুক্তি পায় তার। ‘দুবাই সেনু’, ‘তুলসি’, ‘বিল্লা’ নামের তিনটি ছবিই হয় ব্যবসাসফল। এরমধ্যে বিল্লা ছবিটি দিয়ে তিনি পুনরায় কর্ণাটকের সিনেমায় নিজের আধিপত্য জানান দেন। এটি ছিল ১৯৮০ সালে একই নামে নির্মিত একটি সিনেমার রিমেক। এতে নয়তারা পর্দা আলোড়িত করেছিলেন ‘সাশা’ চরিত্রে। অনিন্দ্য সৌন্দর্য ও দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি। তুলসি ছবিটিও দুহাত ভরিয়ে দিয়েছিল এ নায়িকার। তেলেগু এ ছবিটি ব্যবসাসফল হওয়ার পাশাপাশি প্রথমবারের মতো ফিল্মফেয়ারের মনোনয়ন এনে দিয়েছিল তাকে।
এক বছরে তিনটি জনপ্রিয় সিনেমা দিয়ে তামিল-তেলেগু অঙ্গনে প্রভাবশালী অভিনেত্রী হিসেবে জায়গা অরে নেন নয়নতারা। পরের বছগুলোতে ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের সেই আধিপত্য আরও বিস্তৃত করেন তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে প্রেক্ষাগৃহে আসে নয়ন অভিনীত পাঁচটি সিনেমা। এরমধ্যে একটি ‘ইয়ারাদিনী মোহিনি’। এতে নিজেকে নতুন রূপে উপস্থাপন করেন তিনি। ছবিটির মাধ্যমে প্রথম পারিবারিক ছবিতে দেখা যায় তাকে। সাদামাটা চরিত্রে অভিনয় করে বেশ প্রশংসিত হন। সমালোচকরাও বাহবা দেন তাকে। প্রশংসার সাথে ইয়ারাদিনী মোহিনি ছবিটি তাকে দ্বিতীয়বারের মতো সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার এনে দেয়। পাশাপাশি দ্বিতীয়বারের মতো পান ফিল্মফেয়ারের মনোনয়ন।
এবার পরিচালকরা তাকে ঘিরে গল্প ভাবা শুরু করেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১০ সালে। সে বছর নয়ন অভিনীত পাঁচটি ছবি মুক্তি পায়। সবকটাতেই কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন তিনি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একের পর এক ছবিতে নারীকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে আনার এ কৃতিত্বটা তাই তাকেই দেওয়া হয়। এরপর নয়ন উপহার দেন ‘আদ্ভান’, ‘আধুরস’, ‘সিংহ’, ‘বসেইস’, ‘এনজিরা ভাস্করন’ নামের বেশকিছু ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। অল্প সময়ে এতগুলো ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে দক্ষিণি চলচ্চিত্রাঙ্গনে একটি আস্থার নামে পরিণত হন এ নায়িকা। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে সমসাময়িকদের পেছনে ফেলেন নয়নতারা। সেইসঙ্গে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত অভিনেত্রীদের তালিকায়ও নাম ওঠে তার।
২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনটি হিট ছবি উপহার দেন নয়নতারা। এগুলো হলো ‘শ্রী রামা রাজ্যম’, ‘রাজা রানি’, ‘আরম্ভাম’। শ্রী রামা রাজ্যম ছবিটিতে সীতার চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করে নেন তিনি। সেইসঙ্গে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে পান ফিল্মফেয়ার ও নান্দী পুরস্কার। রাজা রানি ছবিতেও পুরস্কার ভাগ্য ভালো ছিল নয়নতারার। এ ছবি দিয়ে আবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন তিনি। জওয়ান সিনেমার পরিচালক অ্যাটলি কুমারের প্রথম ছবি ছিল এটি। এরপর নিজের একাধিক ছবিতে নয়নতারাকে নেন এই সফল পরিচালক। এই সময়টাতে জনপ্রিয়তা ও অর্জন সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যায় নয়নতারাকে। ‘লেডি সুপারস্টার’ খেতাব দেওয়া হয় তাকে। ধীরে ধীরে অনুরাগীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে তার। তিনি হয়ে ওঠেন দক্ষিণি অঙ্গনের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের একজন।
২০১৫ সালেও নিজের ঈর্ষণীয় অবস্থানটি ধরে রাখেন নয়নতারা। সেবছর ‘থানি আরুভান’, ‘মায়া’, ‘নানুম রৌডি ধান’র মতো জনপ্রিয় ছবি নিয়ে পর্দায় হাজির হন তিনি। ২০১৬ সালও মসৃণ ছিল নয়নের জন্য। সে বছর কয়েকটি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন নয়নতারা। জানান দেন, তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘ সময়ের জন্য রাজত্ব করতে এসেছেন। নয়নতারার এই রাজত্ব এখন আরও প্রসারিত হয়েছে। বলিউডে নাম লিখিয়েছেন তিনি। শুরুতেই সঙ্গে পেয়েছেন বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানকে। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত জওয়ান ছবিটিই নয়নতারার প্রথম ছবি। মুক্তির পরপরই বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে সিনেমাটি। শাহরুখের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে অভিনয়ের কারণে নয়নতারাও হন প্রশংসিত।
পেশাজীবনের মতো নয়নতারার ব্যক্তিগত জীবনও আলোচিত। যদিও ব্যক্তিজীবন নিয়ে মুখ খোলেন না তিনি। সম্পূর্ণ মনযোগ দিতে চান কাজে। এরইমধ্যে তিনি একাধিক প্রেম, ধর্মত্যাগ ও সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান নেওয়ার জন্য হয়েছেন আলোচিত ও সমালোচিত। পারিবারিকভাবে খ্রিষ্টান ধর্মরীতি মেনে চলতেন নয়নতারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধর্মটির সাথে থাকেননি। ২০১১ সালের ৭ই আগস্ট চেন্নাইয়ের আর্য সমাজ মন্দিরে গিয়ে ধর্মান্তরিত হন তিনি। গ্রহণ করেন হিন্দু ধর্ম। এ কারণে স্বজাতির কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছিল তাকে।
হৃদয়ঘটিত সম্পর্কের কারণে একাধিকবার আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন নয়নতারা। শুরুতে দক্ষিণি অভিনেতা সিম্বুর সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল নয়নতারার। তাদের গোপন প্রেম নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল। অনেকে ভেবেছিলেন, সম্পর্কটা সফল পরিণতি পাবে। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। এরপর নয়নতারার সম্পর্ক হয় ভারতের বিখ্যাত নৃত্য পরিচালক প্রভুদেবার সঙ্গে। তাদের এ সম্পর্ক নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি তখন। এর প্রধান কারণ ছিল প্রভুদেবা বিবাহিত। প্রভুর সঙ্গে নয়নের হৃদয়ের সম্পর্ক মেনে নেননি কেউ। তবে বিষয়টি নিয়ে নয়নতারা বরাবরই নিরবতা পালন করেছেন। এতে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন সমস্ত সমালোচনা পাশ কাটিয়েই গাঁটছড়া বাঁধবেন তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। বিচ্ছেদের পর প্রভুর সঙ্গে সম্পর্ক এমন এক জায়গায় পৌঁছায় যে একে অন্যের ছায়া মাড়ানোও বন্ধ করে দেন। শোনা যায়, প্রভুদেবার ছোট ভাই যুক্ত থাকায় শাহরুখের একটি সিনেমার প্রস্তাবও ফিরিয়ে দেন এ লেডি সুপারস্টার।
সবশেষ নয়ন সম্পর্কে জড়ান দক্ষিণি পরিচালক ভিগনেশ শিবানের সাথে। এবার আর দেরি করেননি। ভিগনেশের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে থিতু হন সংসারে। তবুও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি তার। তবে পরের বিতর্কটা ছিল মা হওয়া নিয়ে। বিয়ের চার মাস পরই নয়নতারা যমজ সন্তান লাভের সংবাদ দেন। সেসময় খবর রটে গর্ভ ভাড়া করে মা হয়েছেন তিনি। বেশ চটে যান নেটিজেনরা। কেননা দক্ষিণে সারোগেসি বা গর্ভ ভাড়া করে মা হওয়া অবৈধ। তাই এমন কাজে লেডি সুপারস্টারের য্ক্তু থাকার কথা জেনে তার বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গেরও অভিযোগ আনেন অনেকে। পরে বেশিদূর এগোয়নি বিষয়টি।
তবে সব বিতর্ক ছাপিয়ে নয়নতারা এখন অনুরাগীদের নয়নের মনি। ভাসছেন জওয়ান উন্মাদনায়। এই উন্মাদনার পারদ যে কতটা উর্ধ্বমুখী তা এক উদাহরণেই স্পষ্ট। দক্ষিণের এতবড় তারকা হয়েও সামাজিকমাধ্যমের সাথে যোগাযোগ ছিল না নয়নতারার। আজকাল মিডিয়ায় নতুন নাম লেখানো কারও যেখানে লাখ লাখ ফ্যান-ফলোয়ার সেখানে নয়নের কোনো অ্যাকাউন্টই ছিল না সোশ্যাল মিডিয়ায়। জওয়ান মুক্তির কিছুদিন আগে নেটমাধ্যমে যোগ দেন এ তারকা। ইনস্টাগ্রামে একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। পোস্ট করেন জওয়ানের ট্রেলার। এ খবর পেতেই অনুরাগীরা ভিড় করেন ইনস্টাগ্রামে। যুক্ত হতে থাকেন প্রিয় তারকার সঙ্গে। মাত্র ১০ ঘণ্টায় তার ফলোয়ার সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় দশ মিলিয়নের ঘর। এর আগে বি-টাউনে শুধুমাত্র ক্যাটরিনার দখলে ছিল এই রেকর্ড। সামাজিকমাধ্যমে যুক্ত হওয়ার পর ২৪ ঘণ্টায় তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ১০ লাখ ভক্ত। ক্যাটরিনার রেকর্ড এভাবে তুড়ি মেরে ভেঙে দেওয়ায় প্রমাণ হয় সময় এখন নয়নতারার।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি