ডিমের গুনাগুণ ও মাহাত্ম্য

মাহবুব আলম

কী গ্রাম কী শহরের গরিব মানুষের ডিম ভাজা বড়লোকদের ডাইনিং টেবিলে হয়ে যায় অমলেট। তাও আবার ডাবল ওমলেট। এই অমলেটের ওপর গোলমরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে করা হয় সুস্বাদু। এই ওমলেটের সাথে ভদ্রলোকদের নাস্তায় এখন ডিম পোচ খুবই সাধারণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সেই সাথে কয়েকটা ডিম সিদ্ধ তো থাকতেই হবে, বিট লবণ দিয়ে মজা করে খাওয়ার জন্য। কড়া করে সেঁকা পাউরুটির উপর মাখন ও জেলির প্রলেপ দেওয়া টোস্ট মুখে দেওয়ার মাঝে সিদ্ধ ডিমে কামড় দেওয়ার আনন্দই আলাদা।

অবশ্য, এই ডিম আনন্দ আর অভিজাত্যের জন্য নয়। নিজস্ব পুষ্টিগুণেই রান্নাঘর আর খাবার টেবিলে স্থান করে নিয়েছে। তাইতো হাসপাতালে রোগিদের নাস্তায় একটি ডিম সিদ্ধ থেকেই থাকে। এমনকি সরকারি হাসপাতালে যেখানে রোগিদের বরাদ্দ খাবারের সিংহভাগই লোপাট হয়; সেখানেও রোগিদের নাস্তায় ডিম দেওয়া হয়। শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা দুনিয়ায় এটা করা হয়। এটাই ডিমের শক্তি আর গুনাগুণ মাহাত্ম্য। আর তাইতো দুনিয়ার দেশে দেশে ডিমের রেসিপির কোনো কুল কিনারা নেই। আমাদের দেশে ডিমের জনপ্রিয় রেসিপি হলো: ডিমের কারমা-কারি, দো-পেঁয়াজু, ডিম ভর্তা ইত্যাদি। এমনকি মোরগ পোলাও, বিরিয়ানিতেও ডিমের ব্যবহার খুব জনপ্রিয়। এছাড়া কেক, বিস্কুট, নুডলসহ বিভিন্ন খাবার তৈরিতে ডিমের ব্যবহার করা হয়। আর তাই তো ডিমের দাম বেড়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি এই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে রীতিমত আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এই মূল্যবৃদ্ধির শুরুটা হয় গত বছর ২০২২ সালের মার্চে, ইউক্রেন যুদ্ধের পরপরই। ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শুরুর কয়েক দিন পর দোকানে ডিম কিনতে গেলে এক ডজন ডিমের দাম রাখে ১২৫ টাকা। এটা দেখে আমি বললাম, কি বিষয় গত সপ্তাহে তো ৮০ টাকা রাখলে। আমার কথা শেষ হতে না হতেই দোকানের ছেলেটা (বড়জোর ১৬-১৭ বছর বয়স হবে) বলে, স্যার, জানেন না ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধের জন্য দাম বেড়ে গেছে। তারপর তা বাড়তে বাড়তে এখন ২০০ টাকায় ঠেকেছে। মনে হচ্ছে যেন ইউক্রেন থেকে ডিম আসছে। অবশ্য, ফেসবুকে আবার এক বন্ধু ভালো লিখেছে। বলেছে, যুদ্ধের সব খরচ তো আমরাই দিচ্ছি।

অবশ্য, ডিম নিয়ে আলোচনা সমালোচনা তর্কবিতর্ক চলছে সেই আদিকাল থেকেই। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো তর্ক হচ্ছে ডিম আগে না মুরগি আগে। এই বিতর্কের যেমন শেষ নেই, তেমনি ডিম নিয়ে নানান গল্প শেষ নেই।

অনেক অনেক দিন আগে বাগদাদের এক রাজা বাজার পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন এক ব্যক্তি ঝুড়িতে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করছে। আর ক্রেতারা ভিড় করে মহা আনন্দে সেই ডিম কিনে খাচ্ছে। এটা দেখে রাজারও ডিম খাওয়ার ইচ্ছা হলো। রাজা ওই ডিম বিক্রেতার ঝুড়ি থেকে একটি ডিম নিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো তার কাছে তো কোনো মুদ্রা নেই। রাজা কি আর মুদ্রা সাথে নিয়ে ঘুরেন। না ঘুরেন না। তাই তিনি ডিমটা আবারও ঝুড়িতে রেখে দিলেন। এই ঘটনা দেখে বিক্রেতা বললো,

-জনাব আপনি এটা রাখবেন না, দয়া করে এটা নিন।

-কিন্তু আমার কাছে তো দাম দেওয়ার মতো কোনো মুদ্রা নেই।

-এখন নেইতো কি হয়েছে। পরে দেবেন। মনে করেন আমি আপনাকে ধার দিলাম।

ডিম বিক্রেতার কথা শুনে রাজা খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, আমি এই রাজ্যের রাজা। একদিন প্রাসাদে এসে দাম নিয়ে যেও।

কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। ওই ডিমওয়ালা আর আসে না। শেষে প্রায় এক যুগ পর একদিন রাজ দরবারে হাজির ওই ডিমওয়ালা। ডিমওয়ালাকে দেখে রাজা খুব খুশি হলেন। কারণ তিনি তার কাছে ঋণী হয়ে আছেন। তিনি ডিমওয়ালাকে স্বাগত জানিয়ে মন্ত্রীকে ডিমের দাম পরিশোধের নির্দেশ দিলেন।

এই আদেশ শুনে ডিমওয়ালা মুচকি হেসে বললেন,

-হুজুর আগে তো ডিমের দামটা ঠিক করুন। তারপর কি দেবেন সেটা আপনার বিষয়।

রাজা: বলো তোমার ডিমের দাম কত।

ডিমওয়ালা: তার আগে তো হিসাব করতে হবে ওই ডিম থেকে কত বাচ্চা, কত ডিম হয়েছে। তারপর তো দাম।

রাজা: তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো পরিষ্কার করে বল।

ডিমওয়ালা: হুজুর আমি মুখ্যসুখ্য মানুষ। আমি কি আর এত হিসাব বুঝি। আপনি আপনার মন্ত্রীকে বলুন হিসাবটা বের করতে। ধরেন, একটা ডিম থেকে একটা বাচ্চা হয়েছে। সেই বাচ্চা বড় হয়ে ১০০টা ডিম দিয়েছে। তারপর ১০০টা ডিম থেকে ১০০টা বাচ্চা হয়েছে। ওই বাচ্চাগুলো ডিম দিয়েছে। এইভাবে ১২ বছরে কত ডিম আর কত বাচ্চা হয়েছে তার হিসাবটা বের হলেই ডিমের দাম বেরিয়ে যাবে।

ডিমওয়ালার কথা শুনে রাজা মন্ত্রীসহ রাজদরবারে উপস্থিত সকলের ভিমড়ি খাওয়ার দশা। ১২ বছরের হিসাব সেকি সহজ নাকি! কিন্তু কোনো উপায় নেই। বের তো করতেই হবে। রাজার ঋণ বলে কথা।

শেষ পর্যন্ত মোল্লা নাসির উদ্দিনের ডাক পড়লো। মোল্লা নাসির উদ্দিন সবকিছু শুনে হাসতে হাসতে বললো, এ আর এমনকি, এতো খুব সহজ হিসাব। তবে এই হিসাব এখানে এই রাজ দরবারে বের করা যাবে না। হিসাব বের করতে হবে আমার বাড়ির উঠানে বসে। কাল সকালে আপনারা সকলেই চলে আসেন। আপনাদের সামনে আমি হিসাব বের করে দেব।

পরদিন সকালে রাজা তার সভাসদসহ হাজির হলেন মোল্লা নাসির উদ্দিনের বাড়িতে। হাজির হলেন পাওনাদার ডিমওয়ালাও। তারা গিয়ে দেখলেন নাসির উদ্দিন তার বাড়ির উঠানে ভাত ছিটাচ্ছেন। এমনকি রাজা মন্ত্রী আমলা দেখেও না দেখার ভান করে আপন মনে গভীর মনোযোগ দিয়ে খটখটে রোদে শুকনো উঠানে ভাত ছিটিয়েই চলেছেন।

এটা দেখে রাজা খুব বিরক্ত হলেন। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, এটা কি হচ্ছে?

মোল্লা নাসির উদ্দিন খুব শান্তভাবে জবাব দিলেন, এটা খাদ্য নিরাপত্তা। ভবিষ্যতের জন্য ধান বুনছি।

কি, ধান বুনছো? তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?

না, হুজুর আমি পাগল হইনি। আমি নিশ্চিত সেদ্ধ ডিম থেকে যদি বাচ্চা ফুটতে পারে তাহলে আমার এই ভাত থেকেও ধান গাছ হবে। সেই গাছে ধানও হবে।

ডিম নিয়ে এমন অনেক গল্প আছে। সেই জানা-অজানা গল্পে সম্প্রতি নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিম সংরক্ষণ গল্প। ডিম সিদ্ধ করে ফ্রিজে সংরক্ষণ।

পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ডিম খাওয়া ছাড়াও এর বহুবিধ ব্যবহার আছে। এই ব্যবহারের মধ্যে অত্যন্ত ভয়াবহ বিপদজ্জনক ব্যবহার হল গরম ডিম। ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশেও গরম ডিম থেরাপি চালু আছে। এই গরম ডিমের নাম শুনলে ভয়ে কুঁকড়ে যায় বড় বড় বিপ্লবী আর সাহসী সন্ত্রাসী জঙ্গিরা। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের প্রতি পুলিশের এই নির্মম নির্যাতনের প্রামাণ্য দলিল হচ্ছে, নাচোল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্রের জবানবন্দী।

এছাড়াও ডিমের আরেকটি জনপ্রিয় ব্যবহার আছে। তাহলো নেতা-নেত্রীদের প্রতি পচা ডিম নিক্ষেপ। এর কারণ হলো ডিম পচলে উৎকট গন্ধ হয়। মানুষ দেশে দেশে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নিন্দিত অপছন্দের নেতা-নেত্রীদের প্রতি পচা ডিম নিক্ষেপ করে। জুতা স্যান্ডেলের চাইতেও এটা অনেক বেশি কার্যকরী। এই পচা ডিম নিক্ষেপের যারা শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টও রয়েছেন। আর আমাদের দেশে এটা হারহামেশাই হতো একসময়। এখনো হয়, তবে আগের মতো এতোটা নয়। কারণ পচা ডিম সংগ্রহ এতো সহজ নয়, যথেষ্ট ব্যয়বহুল।

শুরুতেই বলেছি, ডিম নিয়ে বিতর্ক আর নানান গল্প চালু আছে সেই আদিকাল থেকেই। এই গল্পের অন্যতম সেরা গল্প হলো, ঘোড়ার ডিম-অশ্বডিম্ব। তাইতো শিশুরা ছড়া কাটে:

বৃষ্টি পড়ে রিমঝিম

পাড়ল ঘোড়া মস্ত ডিম

সেই ডিমের খাব ভাজি

তোমরা কি কেউ আছ রাজি।

ঘোড়ার ডিম পাড়ে আর সেই ডিম যে মস্ত বড় এটা কেউ কখনো দেখেনি। দেখার কথাও না। তারপরও ঘোড়ার ডিম-অশ্বডিম্ব কথাটা আমাদের সমাজের ব্যাপকভাবে চালু আছে। সত্যজিৎ রায়ের মতো বিখ্যাত লেখক-চলচ্চিত্রকার তাই তো লিখেছেন ‘তোরাই বাঁধা ঘোড়ার ডিম’। আসলে ঘোড়া ডিম প্রসব করে না। তবে ঘোড়ার পক্ষে এক শ্রেণির আমলা, মন্ত্রী, এমপিরা আনন্দচিত্তে এই ডিম প্রসব করে। কোটি কোটি শত নয়, শত শত কোটি টাকা খরচ করে তারা প্রায়শই অশ্বডিম্ব প্রসব করে। যা সমাজের উপকারের পরিবর্তে ক্ষতির কারণ হয়। কখনো কখনো বিপদজ্জনক, অত্যন্ত বিপদজ্জনক হয়। হ্যাঁ, আমাদের আমলা মন্ত্রী এমপিরা অনেক গবেষণা আর বিপুল অর্থ ব্যয় করে এই অশ্বডিম্ব প্রসব করে।

অবশ্য, বিষয়টা এত সহজ নয়। এই জন্য তাদের যথেষ্ট বুদ্ধি আর মেধাসম্পন্ন হতে হয়। আর তাইতো এই কাজটা সাধারণ কোনো মানুষ অর্থাৎ আমজনতা নয়, এ কাজটা করে সমাজের উঁচু তলার নেতৃস্থানীয় আমলা, মন্ত্রী, এমপিরা। তারপর শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। কোথায় কোথায় সেই অশ্বডিম্ব। খোঁজ খোঁজ, কিন্তু কোথায় খুঁজবে। কোথায় তদন্ত করবে? রাতের আঁধারে না দিনের আলোয়? তারপর একদিন মেঘলা দিনে নয়তো ঝড়ের রাতে সব শেষ। হাওয়ায় উড়ে যায় তদন্ত প্রতিবেদনের সব ছাই পাস।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × three =