তটিনী
রাফাহ নানজীবা তোরসা ১৯৯৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১০ সালে মডেলিং জগতে যাত্রা শুরু। ২০১৭ সালে প্রথম অভিনীত টেলিফিল্ম ‘স্বপ্ন তোমার জন্য’। ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৯ খেতাব লাভ করেন।
ভেবে দেখুন, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন পৃথিবী থেকে ১৯ হাজার ২৪ ফুট উচ্চতায়। যারা পাহাড় আর ভ্রমণ ভালোবাসেন তাদের জন্য অবশ্যই এটি একটি সুখকর স্মৃতি। সেই উচ্চতা থেকে চার পাশের সৌন্দর্য তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করবে। বলছি ভারতের অন্যতম দর্শনীয় স্থান লাদাখের কথা। প্রতিবছর হাজার হাজার ভ্রমণপ্রেমী সেখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে যান। তবে আজ শোনাবো অন্য গল্প। গল্পটা একজন নারী ও একটি রেকর্ডের। এবার বিশ্বদরবারে বিশ্ব রেকর্ডের অংশ হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের রাফাহ নানজিবা তোরসা। হাঁটলেন ভারতের লাদাখে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শো’তে।
মডেল কিংবা অভিনয়শিল্পীদের র্যাম্পে হাঁটা নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে তা যদি হয় বিশ্বের সর্বোচ্চ উঁচু যান চলাচলের সড়ক উমলিং লা তে? ব্যাপারটা তখনই হয়ে ওঠে আলোচনার বিষয়। সম্প্রতি উমলিং লা কে র্যাম্পের মঞ্চে হাঁটলেন বিশ্বের ১১/১২টি দেশের মডেলরা। যাদের সঙ্গে র্যাম্পের মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তোরসা। আর এভাবেই তিনি দলীয়ভাবে বিশ্ব রেকর্ডের ভাগীদার হয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু যান চলাচলের উপযোগী সড়কে অনুষ্ঠিত ফ্যাশন শো’তে। সবুজ রঙের একটা স্যুট পরে তোরসা হেঁটেছেন আত্মবিশ্বাসী হয়ে। ভাইব্রেন্ট লাদাখ ফেস্টিভ্যালের অধীনে এই আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শো অনুষ্ঠিত হয়। ভিন্নধর্মী এই আয়োজনকে বিশ্ব রেকর্ডের স্বীকৃতি দিয়েছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ। এমন সাফল্যে আনন্দিত এই শো’য়ে অংশ নেওয়া একমাত্র বাংলাদেশি মডেল তোরসা।
গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩০ আগস্ট। এতে জি২০ দেশের অন্যান্য মিস ইউনিভার্স, ওয়ার্ল্ডস এবং আর্থদের সঙ্গে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের তোরসা অংশ নিয়ে ১৯ হাজার ফুট পাহাড়ের ওপর হাঁটলেন দেশের পতাকা হাতে। এতে যারা অংশ নিয়েছেন তারা শান্তি ও বন্ধুত্বের আদর্শের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের ওপর আলোকপাত করেছেন। পুরো অনুষ্ঠান নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়েছে। যা নেটফ্লিক্স ও অ্যামাজন প্রাইমে দেখানো হবে। কান চলচ্চিত্র উৎসবসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবেও এটি দেখানো হবে বলে জানান তোরসা। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ অর্থাৎ ‘এক বিশ্ব এক পরিবার’ এমন সেøাগানে আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তোরসা বললেন, ‘গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের মতো এমন একটি জায়গায় বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পেরেছি, এটা আমার জন্য গর্বের। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি এই আয়োজনে আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। আগামীতেও দেশ, শোবিজ ও গার্মেন্টস সেক্টরে এমন আরও অর্জনের চেষ্টা করে যাবো।’
চট্টগ্রামের মেয়ে রাফাহ নানজীবা তোরসা ১৯৯৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়াতে। তার বাবা শেখ মোরশেদ ছিলেন একজন আইনজীবী আর মা শারমিনা আক্তার একজন গৃহিণী। তার একমাত্র ছোট ভাই তুরাজ। তোরসার বাবা ২০১৪ সালে মারা যান। তোরসা লিটল জুয়েলস স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। এরপর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে লেখাপড়া করেন। বাবার পেশার খাতিরে তোরসার বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। শৈশব থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণ ছিল। ছোট বয়স থেকেই নাচ শিখেছেন এবং পেয়েছেন সাফল্য। ২০০৮ সালে ‘লিটল মিস চিটাগাং’ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ২০০৯ সালে তোরসা বঙ্গবন্ধু শিশুকিশোর প্রতিযোগিতায় লোকনৃত্য বিভাগে প্রথম হন। যার পুরস্কার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। জাপানে যাবার জন্য সরকারি বৃত্তিও লাভ করেছিলেন তোরসা। কিন্তু ঠিক সেই সময়টাতেই দিল্লিতে চট্টগ্রাম বিভাগের হয়ে মূকাভিনয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার কারণে জাপানে যেতে পারেননি তিনি। ২০১০ সালে জাতীয় যুব প্রতিযোগিতার ভরতনাট্যম বিভাগে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন তোরসা। ২০১০ এনটিভির মার্কস অলরাউন্ডার প্রতিযোগিতায় প্রথম রানার আপ হয়েছিলেন।
তোরসার অনুপ্রেরণা বলিউডের অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। প্রিয়াঙ্কার আত্মবিশ্বাসী মনোভাব অনুসরণ করেন তিনি। সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পান মিস ওয়ার্ল্ড এর মতো প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর। নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের মতো একটি প্রতিযোগিতার জন্য। জানার চেষ্টা করেন মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার সামাজিক উদ্দ্যেশ্যগুলো। যা তার কাছে এই প্রতিযোগিতাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। সুন্দরী প্রতিযোগিতার যে মূল উদ্দেশ্য ‘বিউটি উইথ এ পারপাস’ বিষয়টি বেশ আগ্রহী করে তুলেছিল তোরসাকে। প্রতিযোগিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মিস ওয়ার্ল্ড হচ্ছে এমন একটা প্ল্যাটফর্ম যেটা উইমেন হুডকে সেলিব্রেট করে, অ্যা সেন্স অব লাইফ। এটা কোন ট্র্যাডিশনাল বিউটি প্রেজেন্টের আওতায় পড়ে না। আর আমি নিজেও একজন সোশ্যাল ওয়ার্কার। ১১ বছর বয়স থেকেই আমি সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেছি এবং করে যাচ্ছি এখনও। এই প্রেরণা থেকেই মূলত মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশে অংশগ্রহণ করা।’ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তোরসা মনে করেন এই মুকুটের উজ্জ্বলতায় তিনি নিজের দেশকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করতে পারবেন এবং দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারবেন।
সুন্দরীদের মঞ্চে সাফল্যের মুকুট মাথায় পরে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন তোরসা। নিজের অনুভূতি জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এখানে আমরা যারা অংশগ্রহণ করেছি তারা সবাই এটা ডিজার্ভ করে। আমার কাছে মনে হয় জাজরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা সেটা ভেবে চিন্তেই নিয়েছেন। আমি এর জন্য কৃতজ্ঞ। আমি আশা করবো সবাই আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবেন। আমি বিশ্বাস রাখি যে, পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।’
শোবিজে কাজ করার ইচ্ছা আগে থেকেই ছিল তোরসার। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মে আসার আগে চিন্তা করে আসেননি তিনি। তোরসার জীবনে টার্নিং পয়েন্ট আসে ২০১৯ সালে। সে বছর মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন রাফাহ নানজিবা তোরসা। ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৯ খেতাব লাভ করেন তোরসা। এরপর ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে লন্ডনে অনুষ্ঠিত মিস ওয়ার্ল্ড ২০১৯ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। তখন থেকেই মিডিয়া জগতে পাকাপোক্ত করে নেন নিজেকে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তোরসা নৃত্য, আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, থিয়েটার, মডেলিং, মূকাভিনয়েও পারদর্শী। তিনি আবৃত্তি সংগঠন ‘নরেন’ এবং থিয়েটার সংগঠন ‘ফেইম’ এর সাথে যুক্ত। এছাড়া নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন সামাজিক সংগঠন লিও ক্লাব এবং রেডক্রিসেন্টের সদস্য হিসেবে। বিজয় টিভির শো সঞ্চালনাও করেছেন, পাশাপাশি রেডিওতে কাজ করেছেন। ২০১০ সালে মডেলিং জগতে যাত্রা শুরু তোরসার। এরপর কাজ করা শুরু করেন মিডিয়া জগতে। তার অভিনীত প্রথম টেলিফিল্ম ‘স্বপ্ন তোমার জন্য’। ২০১৭ সালে অভিনয় করেছেন তৌকির আহমেদ পরিচালিত হালদা চলচ্চিত্রে।
আত্মসম্মানের সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ চলবে না বলে মনে করেন এই মডেল। যেখানে আত্মসম্মান ক্ষুণ্ন হয় সেই জায়গা থেকে সরে আসা উচিৎ বলে করেন তিনি। তোরসা ছোটবেলায় মঞ্চে কথা বলতে কিছুটা জড়তা বোধ করতেন। সেই জায়গা থেকে ভেঙে চুরে নিজেকে গড়েছেন তোরসা। তার মতে, সেলফ কনফিডেন্স এক জনেরটা অন্যজন তৈরি করে দিতে পারে না। নিজের বাধাগুলো নিজেকেই টপকাতে হবে। হয়তো কেউ কাউকে সাহায্য করবে। তবে যারা পথ রোধ করে দাঁড়ায় তাদের কথায় কান না দিয়ে কেউ সাহায্য করলে সেটাকে সাদরে গ্রহণ করেন তিনি। নিজে কি করতে চান এটা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন। নিজের সিদ্ধান্ত সবসময় নিজেই নেওয়ার পক্ষপাতী তিনি। শুভাকাক্সক্ষীদের পরামর্শ নিলেও দিন শেষে নিজের ভালো মন্দ নিজেই বেছে নেন তোরসা। পাশাপাশি বই পড়া আর ইতিবাচক চিন্তা করেন তিনি।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি