রুসলান রেহমান তরুণ সংগীত পরিচালক। ‘তাকদীর’, ‘জাগো বাহে’, ‘কারাগার’, ‘গুটি’, ‘অগোচরা’র মতো জনপ্রিয় ওয়েব কনটেন্টে কাজ করেছেন সংগীত পরিচালক হিসেবে। শ্রোতাদের কাছে তার কাপল ব্যান্ড ‘দ্য রেহমান ডুয়ো’ বেশ জনপ্রিয়। সম্প্রতি ‘ব্লেন্ডারস চয়েস-দ্য ডেইলি স্টার ওটিটি অ্যাওয়ার্ডস ২০২২’-এ বেস্ট ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ক্যাটাগরিতে পুরস্কার অর্জন করেছেন। জানাচ্ছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত।
শুরুটা যেভাবে
২০১১ সালের শেষের দিকে তিন জন মিলে তৈরি করেছিলেন ‘মিথোনমিয়া’ নামের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। ২০১৩ সালে টেলিকম অপারেটর কোম্পানি রবি আয়োজন করে ‘রবি শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। সারা বাংলাদেশ থেকে শর্ট ফিল্ম মেকাররা তাদের সিনেমা জমা দেয় এই আয়োজনে। তিন বন্ধু মিলে ‘ঝরহপব ডব ঝবঢ়ধৎধঃব’ নামের শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করে জমা দেন ফেস্টিভ্যালে। ওই সিনেমায় সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে মিউজিক নিয়ে কাজ করা শুরু। এই আয়োজনের জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী। তিন বন্ধুর নির্মিত শর্ট ফিল্মটি চ্যাম্পিয়ন হয়। অমিতাভ রেজা চৌধুরী একদিন অফিসে ডাকেন তাদের। একসাথে কাজ করার কথাও জানান। তিন জনের মধ্যে একজন হলেন বর্তমান সময়ের মেধাবী চিত্রগ্রাহক সুমন সরকার। আর একজন রুসলান রেহমানের বড় ভাই রেদওয়ান রহমান। অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘আয়নাবাজি’ সিনেমার স্ক্রিপ্টে কাজ করছিলেন সুমন সরকার ও রুসলান রেহমান। ২০১৪ সালে অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘সারফেস’ নামের নাটকে চিত্রগ্রাহকের দায়িত্ব পান সুমন সরকার এবং মিউজিকের দায়িত্ব পান রুসলান রেহমান। নাটকটি সেই বছর মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছিল ক্রিটিক ক্যাটাগরিতে। রুসলান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে মেটাল ব্যান্ড ‘গ্রিমোরিয়াম ভেরাম‘ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত কম্পোজিশন, লাইভে বাজানো হয়েছে। এরপর বন্ধ ছিল অনেক দিন। ২০১৪ সালে আবার মিউজিকে ফেরা অমিতাভ রেজার সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে। এরপর অনম বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন বিজ্ঞাপনে জিঙ্গেল দেওয়া, ফিকশনে আসা।
দ্য রেহমান ডুয়ো
তুমি আমি অনেক কাছাকাছি
অনন্ত রাত ভোর
তুমি আমি অনেক দূরে থাকি
অলুক্ষণে ঘোর…
এটি রুবায়েত রেহমান-রুসলান রেহমান জুটির ‘দ্য রেহমান ডুয়ো’ ব্যান্ডের ‘অন্বয়’ শিরোনামের গানের কথা। কাপল ব্যান্ড বাংলাদেশে তেমন একটা দেখা যায় না। তারা দুজন দীর্ঘদিন ধরে গান লিখে, মিউজিক করে, ভিডিও বানিয়ে শ্রোতাদের মাঝে হাজির হচ্ছেন। তরুণ প্রজন্মের শ্রোতাদের অন্যতম প্রিয় কাপল ব্যান্ড বললেও ভুল হবে না। ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু হয় তাদের এই ব্যান্ডের। দুজনের পরিচয় ২০১৩ সালে। তারা দুজন একসময় একটা আইরিশ ব্যান্ডের গান শুনতেন। ওখানে মেল অ্যান্ড ফিমেল সিঙ্গার পিয়ানো, গিটার নিয়ে গাইত। ওই আদলে নিজেরা শুরু করেন ‘দ্য রেহমান ডুয়ো’ ব্যান্ড।
২০২০ সালে কোভিডের সময় তারা নিজেদের প্রথম অরিজিনাল গান ‘অন্বয়’ প্রকাশ করেন। গানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ভালো সাড়া ফেলে। তারপর থেকে ‘দ্য রেহমান ডুয়ো’ নিয়ে পথচলা শুরু। শুরুটা কভার দিয়ে হলেও এখন বেশকিছু মৌলিক গান রয়েছে তাদের ব্যান্ডের। পরিচয় থেকে পরিণয়, তারপর বিয়ে। ২০১৭ সালে বিয়ে করেন তারা। এখন ৬ বছরের সংসার তাদের। ‘দ্য রেহমান ডুয়ো’ ব্যান্ডকে বলা যায় দুজনের ব্যান্ড। নিজেদের ঘরে বসে রুবায়াত রেহমান গাইছেন তো বাজাচ্ছেন রুসলান রেহমান। গান লিখছেন, সুরও করছেন দুজন মিলে। রুসলান-রুবায়াত দম্পতির টাইটেল ‘রেহমান’ থেকেই ব্যান্ডের নামকরণ। ছোটবেলায় বাবার চাকরির সূত্রে খুলনায় থাকতেন রুসলান। খুলনার রোটারি স্কুলে পড়ার সময় গিটার শিখতেন স্কুলের পর্তুগিজ ফাদার পিন্টোজের কাছে। তার হাত ধরেই ক্ল্যাসিক্যাল আর ফ্ল্যামেঙ্কো স্টাইলের সঙ্গে রুসলানের পরিচয়। টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে পড়তেন রুবায়াত। সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য খ্যাত এই স্কুলে তিনি গান শিখতেন। তিনি গাইতেন রবীন্দ্রসংগীত। এখন দুজন একসঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করে থাকেন।
শ’খানেক বিজ্ঞাপন
এখন পর্যন্ত শ’খানেক বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন তিনি। মিউজিকের দায়িত্ব সামলেছেন সুনিপুণভাবে। গত ঈদে ফ্যাশন ব্রান্ড দেশালের সাথে কাজ করেছেন যা বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ইউনিলিভার ব্রান্ডের ২৫ বছর উপলক্ষ্যে একটি কাজ করেছেন। এছাড়া গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক সহ দেশের প্রথম সারির বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। বিজ্ঞাপনের কাজ করার শুরুটা হয় নির্মাতা অনম বিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমেই।
ওটিটি প্লাটফর্মে রুসলান
ফিকশনে বড় আকারে কাজৎ শুরু হয় নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ শাওকীর সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে। ২০১৬ সালে শাওকী শুরু করেন ‘প্রজন্ম টকিজ’ নামে প্লাটফর্ম। সেখান থেকেই একসাথে কাজ করা শুরু। ওটিটি প্লাটফর্মে কাজ করার শুরুটা হয় সৈয়দ আহমেদ শাওকীর ‘তাকদীর’ ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে। সিরিজ দেখার পর সকলে সিরিজের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নিয়ে প্রশংসা করেন।
’৫২, ’৭০ এবং ’৭১ সালের তিনটি গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছিল অমনিবাস চলচ্চিত্র ‘জাগো বাহে’। যেখানে একটি গল্পের মিউজিকের দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি। ২০২২ সালে ‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করেন সৈয়দ আহমেদ শাওকী। দুটি সিজনের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নিয়ে কাজ করছেন রুসলান রেহমান। আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল সিরিজের মিউজিক ডিপার্টমেন্ট। অসাধারণ স্কোরের নেপথ্যে ছিলেন তিনি। ২০২৩ সালে শঙ্খ দাসগুপ্তর ‘গুটি’ ও সিদ্দিক আহমেদের ‘অগোচরা’ ওয়েব সিরিজে কাজ করে নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।
কাজের স্বীকৃতি ও নতুন কাজ
‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজে কাজ করার জন্য পেয়েছেন স্বীকৃতি। ব্লেন্ডারস চয়েস-দ্য ডেইলি স্টার ওটিটি অ্যাওয়ার্ডস ২০২২-এ বেস্ট ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হয়েছেন তিনি। সামনে একটা অ্যান্থোলজি ফিল্ম করার পরিকল্পনা চলছে। নির্মাতা শঙ্খ দাসগুপ্ত নিজের প্রথম ফিচার ফিল্ম নির্মাণ করছেন। সিনেমাটির মিউজিক করার কথা রয়েছে রুসলানের। নির্মাতা রেজওয়ান সুমিত নিজের নির্মিত নতুন সিনেমার জন্য অনুদান পেয়েছেন। সিনেমাটির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে রুসলান রেহমানের। এছাড়া হাতে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনের কাজ রয়েছে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে