ঝড়ের পাখি সিনেমার ৫০ বছর

এমন একটি সিনেমার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন হতেই পারত। কিন্তু কে মনে রাখে এসব। এমন অনেক ভালো সিনেমা আর্কাইভে ধুলার স্তুপের নিচে চাপা পড়ে আছে হয় তো। রঙবেরঙের এ সংখ্যায় এই সিনেমার পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের সম্মানে ‘ঝড়ের পাখি’ সিনেমা নিয়ে থাকলো এ আয়োজন। মৌ সন্ধ্যার প্রতিবেদন

সাদা কালো সিনেমা কিন্তু একবার দেখতে শুরু করলে না শেষ করে উপায় নেই। অর্ধশত বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘ঝড়ের পাখি’ সিনেমার কথা বলছি। সামাজিক গল্পের এই সিনেমাটির কাহিনি বিন্যাস এক কথায় দুর্দান্ত। এটি নির্মাণ করেছিলেন ঢাকাই সিনেমার কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সি বি জামান। যেসব সিনেমার হাত ধরে ঢালিউডের সোনালি দিন এসেছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সিনেমা ‘ঝড়ের পাখি’।

মুক্তির আলোয় ‘ঝড়ের পাখি’

সিনেমার নামটির মধ্যেই লুকানো আছে এক আলাদা চমক। পাখি বলতে আমরা বুঝি সুন্দরের প্রতীক। ঝড় বলতে বুঝি এলোমেলো হয়ে যাওয়া কিছু। সত্যি প্রচণ্ড ঝড়ের ভেতরেও পাখি তার রূপ ছড়ানোর চেষ্টা করে। ‘ঝড়ের পাখি’ সিনেমার মধ্যে কী আছে? আমরা সেসব জানবো। তার আগে জেনে নেই সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ। সিনেমাটির ফরম্যাট ছিল ৩৫ মিমি।

যাদের হাত ধরে আসে ‘ঝড়ের পাখি’

নীহার রঞ্জন গুপ্তের ‘বধূ’ উপন্যাস অবলম্বনে এই সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সি বি জামান। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন খান আতাউর রহমান। প্রযোজনা করে সেভেন আর্টস। পরিবেশনায় ছিল জে এস কথাচিত্র। সম্পাদনা করেন আবু তালেব। রূপসজ্জায় ছিলেন মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলী।

রাজ্জাক-শাবানার চমক

ঢাকাই সিনেমায় দীর্ঘদিন সিংহাসন জুড়ে ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। সিনেমাটির নায়ক ছিলেন তিনি। আর তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন আরেক কিংবদন্তি নায়িকা শাবানা। এই সিনেমার চমক হিসেবে হাজির হয়েছিল এই জুটি। তাদের প্রাঞ্জল অভিনয় এখনো দর্শকদের মন জুড়ে আছে। ‘ঝড়ের পাখি’ সিনেমায় রাজ্জাক অভিনয় করেন সেলিম চৌধুরী আর শাবানা রুমা চরিত্রে। গফুর চরিত্রে অভিনয় করেন খান আতাউর রহমান, নার্গিস করেন হেনা চরিত্রে। এ ছাড়া মামুন চরিত্রে কায়েস, ফাতেমা চরিত্রে মিনু রহমান, মুস্তফা আনোয়ার চরিত্রে খলিল, সেলিমের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন আয়শা আখতার।

‘ঝড়ের পাখি’ সিনেমার গান

চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখার পাশাপাশি এই সিনেমাটির গীত রচনা ও সংগীত পরিচালনা করেছেন খান আতাউর রহমান। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন আবিদা সুলতানা, রেবেকা সুলতানা ও আব্দুল জব্বার। সিনেমার এক পর্যায়ে শাবানার লিপে আসে ‘কখন গোপনে নিলে ঠাঁই নয়নে, কিছু জানিনি কিছু বুঝিনি’ গানটি। আর সিনেমার টাইটেল সং ‘আমি এক নীড় হারা ঝড়ের পাখি, অজানার পানে ছুটে চলেছি’ গানটি পাওয়া যায় রাজ্জাকের লিপে। দুটোই বাংলা সিনেমার কালজয়ী গান।

কি আছে ঝড়ের পাখি সিনেমায়?

সিনেমার প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় গফুর চৌধুরী (খান আতাউর রহমান) অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে প্রবেশ করছেন। তাকে এ অবস্থায় দেখে ভয় পেয়ে যান তার স্ত্রী। চিন্তিত হয়ে পড়েন। ভাবতে থাকেন, ঘরে ছোট সন্তান। এই সময় গফুরের কিছু হয়ে গেলে সংসার চলবে কী করে! না ছাড়তে বললেও কেন সে নেশা ছাড়ে না। এসব বলে আক্ষেপ করতে থাকেন গফুরের স্ত্রী। ডাক্তার নিয়ে আসেন সেলিম (রাজ্জাক)। ডাক্তার রুগীকে পরীক্ষা করে যা বলেন তা শুনে সবাই চমকে যায়। ওপরওয়ালা না চাইলে আর কখনই নাকি কথা বলতে পারবেন না গফুর। শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেছে। আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবেন কি না তারও কোনো ঠিক নেই। গফুরের পরিবারের সবাইকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে আসে সেলিম। বিক্ষিপ্ত মনে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। এরপরের দৃশ্যে দেখা যায় রাস্তায় পত্রিকা বিক্রি করছে হকার। দৈনিক আজাদ ও ইত্তেফাক পত্রিকায় সেলিমের ছবি ছাপা হয়েছে। সে নাকি ব্যাংকে চেক জালিয়াতি ও এক ব্যক্তিকে খুন করে পলাতক। মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে সেলিমের কারণ সে জানে সে নির্দোষ। সে কাউকে খুন করেনি। সে জালিয়াতি করেনি। একদিকে সে কাঁধে তুলে নেয় গফুরের পরিবারের দায়িত্ব। অন্যদিকে বাড়িতে বয়স্ক মা। যে মায়ের একমাত্র ভরসা সে। ছোটবেলাতেই সেলিমের বাবা মারা গেছেন জেলখানায়। তিনিও না কি মিথ্যে মামলার আসামী হয়ে লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করেছিলেন। এখন কী করবে সেলিম।

পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তার চলবে না। তাহলে দুটি পরিবার ধ্বংসের মুখে পড়বে। অনেক ভেবে চিন্তে ছদ্মবেশ ধারণ করে সেলিম। মুখে দাড়ি, মাথায় লম্বা টুপি পরে অন্যরকম বেশ ধারণ করে সে। তার একমাত্র বন্ধু মামুনও তাকে দেখে চিনতে পারে না। এই মামুন সবসময় তার পাশে থাকে। তাকে বিশ্বাস করে। মামুন পুলিশের কাছে ধরা দিতে বলে সেলিমকে। এই সময় একটা চিঠি আসে সেলিমের কাছে। মায়ের চিঠি। মা তাকে দেখা করতে বলেছেন গ্রামের বাড়িতে গিয়ে। গ্রামের বাড়িতে ছুটে যায় সেলিম। মায়ের সঙ্গে দেখা হয় তার। সেলিমের গ্রামের বাড়িতেও পুলিশের আনাগোনা বাড়ে। সেলিমের জীবনে ঘটে যাওয়া এসব খবর জানতে পারেন তার মা। তিনিও তাকে ভুল বোঝেন। নিজের বাড়িতে আসার পথও বন্ধ হয়ে যায় সেলিমের। বিপদ বাড়তে থাকে। পালিয়ে বেড়িয়ে দিন চলবে না। সহকর্মীর পরিবারকে দেখতে হলেও টাকার প্রয়োজন। বন্ধু মামুনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে কত দিন আর চলা যায়। তাই অন্য একটা কাজের চেষ্টা করতে থাকে সেলিম।

এই সময় পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে তার। শহরের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি তার ছোট ছেলের জন্য হোম টিউটর খুঁজছেন। তিনি একজন জজ। ছদ্মবেশ নিয়ে চাকরির পরীক্ষা দিতে আসে সেলিম। কাজটা সে পেয়ে যায়। এই বাড়ির লজিং মাস্টার হয়ে যায় সে। এখানেই জজ সাহেবের মেয়ে রুমার (শাবানা) সঙ্গে পরিচয় হয় সেলিমের। প্রথমে সেলিমকে অপছন্দ করলেও এক সময় সেলিমের ব্যবহার দেখে তাকে পছন্দ করতে শুরু করে সে। তাকে ইতিহাস পড়ানোর অনুরোধ করে। অনুরোধ রাখে সেলিম। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্কটা অর্থবহ হতে থাকে। এর মধ্যে কাহিনিতে নতুন মোড় আসে। রুমার বিয়ে ঠিক হয়। বন্ধুর ছেলের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই মেয়ের বিয়ের কথা পাকা করে রেখেছিলেন জজ সাহেব আনোয়ার (খলিল)। রুমাও জানতে পারে বাবার মনের ইচ্ছে। আনোয়ারের বন্ধুর ছেলে বিদেশে পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে এসে পুলিশের বড় কর্মকর্তা হয়েছেন। এই বাড়িতেও যাওয়া আসা তার। একদিন ছদ্মবেশি লজিং মাস্টারকে দেখে সে। তার সন্দেহ হয়। সে তার মতো করে খোঁজ করতে থাকে।

সেলিম রুমার কাছে একটা চিঠি লিখে রেখে পালিয়ে যায়। মায়ের কাছে চলে যায় সেলিম। সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে আসে। পুলিশের গুলিতে সেলিমের বাড়ির এক আত্মীয়র প্রাণ যায়। অবশেষে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় সেলিমকে। সবাই সেলিমকে অবিশ্বাস করলেও রুমা তাকে বিশ্বাস করেছে। রুমার বাবা জজ সাহেবও ভাবছেন, তার মানুষ চিনতে তার ভুল হতে পারে না। কিন্তু প্রমাণ সব সেলিমের বিপক্ষে। সেলিম নিজের শেষ ইচ্ছার কথা বন্ধু মামুনকে জানায়। মায়ের অবিশ্বাস ভাঙাতে পারলে তার জীবন ধন্য হবে। সেলিমের মা’কে আনা হয় আদালতে। মামুনের কাছে সেলিমের ত্যাগের গল্প শুনে ছেলের জন্য দোয়া করেন তিনি। সব শেষে মিরাকল ঘটে যায়। গফুর তার কণ্ঠ ফিরে পান। স্ত্রীর হাত দিয়ে একটি চিঠি পাঠান আদালতে। শেষ পর্যন্ত নির্দোষ প্রমাণিত হয় সেলিম।

চলচ্চিত্র নির্মাতা সি বি জামান

সি বি জামান চলচ্চিত্র পরিচালনা ছাড়াও অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি আসামের গৌরীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ইমাদুর রহমান চৌধুরী ও মায়ের নাম শরীফা খাতুন। তিনি মুরারি চাঁদ কলেজে পড়ালেখা করেছেন। সি বি জামান ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। তার পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘পুরস্কার’ ১৯৮৩ সালে পাঁচ বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিল। এছাড়া, তিনি ‘উজান ভাটি’ ও ‘কুসুম কলি’র মতো চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। চলচ্চিত্র দুইটি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। তার পরিচালিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘কুসুম কলি’ ১৯৯০ সালে মুক্তি পেয়েছিল। চলচ্চিত্র পরিচালনা ছাড়াও তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’। এছাড়া, তিনি দুইটি বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হয়েছেন। সি বি জামান ফাতেমা জামানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের একমাত্র পুত্র চৌধুরী ফরহাদুজ্জামান।

সিবি জামান পরিচালিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো: ঝড়ের পাখি, উজান ভাটি, পুরস্কার, শুভরাত্রি, হাসি, লাল গোলাপ, কুসুম কলি প্রভৃতি। সিবি জামান অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো: অরুণ বরুণ কিরণ মালা, ইয়ে করে বিয়ে, চেনা অচেনা, দিন যায় কথা থাকে, ত্রিরত্ন, এক টাকার বউ, নীল আঁচল, ভালোবাসার শেষ নেই, বিয়ের প্রস্তাব প্রভৃতি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × 1 =