মাহবুব আলম
আমার বিশেষ পরিচিত দুজন স্নেহভাজন সাংবাদিকের একজনের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব আরেকজনের বয়স ত্রিশোর্ধ্ব। দুজনই সাংবাদিকতা পেশায় যথেষ্ট সফল ব্যক্তি। কারণ সাংবাদিকতা পেশার এই দুঃসময়ে কর্মহীন না হয়ে একজন সাব এডিটর থেকে শুরু করে এখন একটি জাতীয় দৈনিকে নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। আর একজন স্টাফ রিপোর্টার থেকে শুরু করে বিশেষ সংবাদদাতার দায়িত্ব পালনের পর এখন নিউজ এডিটর হিসেবে কর্মরত আছেন। নিঃসন্দেহে সফল ব্যক্তি। দুজনই স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। তাই বড় ধরনের আর্থিক সংকটও নেই। এক কথায়, দুশ্চিন্তামুক্ত সুখি ব্যক্তি। দুজনের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে বড় ধরনের অমিল আছে। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে আছে অদ্ভুত মিল। এই মিলের অন্যতম হচ্ছে দুজনই অত্যন্ত উচ্চাভিলাসী, দুজনই নিজেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে করেন। এবং সবকিছুতে পাণ্ডিত্য করার একটা ভাব আছে। সৎ শিক্ষিত ও নিষ্ঠাবান এই দুই সাংবাদিকের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের জানাশোনা ও সম্পর্ক। এই সম্পর্ক পেশাগত, ব্যক্তিগত সম্পর্ক পার হয়ে পারিবারিক সম্পর্কে রূপ নিয়েছে তা-ও কয়েক দশক আগে। সম্পর্কে এই দুজনের আমি শ্রদ্ধাভাজন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদর্শিক গুরু ও দিকনির্দেশকও বটে। তারপরেও এই দুজনকে কোনো কারণে ফোন করলে অথবা দেখা করতে বললে ওরা কখনোই তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয় না। এদের একজন ফোন না ধরে কয়েক মিনিট পর কল ব্যাক করে। এবং বলে মিটিংয়ে আছি। আপনাকে পরে ফোন করছি। এবং করেও।
আরেকজন ফোন ধরেই বলে ভাই, ব্যস্ত আছি, পরে ফোন করছি। প্রথম প্রথম এ নিয়ে বিস্মিত হলেও এখন এটা গা সাওয়া হয়ে গেছে। এ নিয়ে আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছিÑ ওরা কেন এমনটা করে। শুধু কি আমার সাথে এটা করে, না অন্যদের সাথেও করে? খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি, ওরা অন্যদের সঙ্গেও এই একই আচরণ করে। এই আচরণের উৎস অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ওরা এটা করে ওদের গুরুত্ব বাড়াতে। ওরা বুঝাতে চায়, ওরা খুব ব্যস্ত মানুষ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। অর্থাৎ সহজলভ্য ব্যক্তি নয়।
এ বিষয়ে আরো খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি ওরা এটা শিখেছে আমলাদের কাছ থেকে। মানে প্রশাসনের বড়কর্তাদের আচরণ দেখে। আমাদের দেশের প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন স্তরের ব্যক্তিদের ফোন করলে ওদের পিএ, পিএস বা পিএস না থাকলে পিয়নরা ফোন ধরেই বলে, স্যার ব্যস্ত আছেন, মিটিংয়ে আছেন, পরে ফোন করেন। কোনো ব্যক্তি সশরীরে গেলেও পিএ, পিএস, পিয়নদের মুখে একই রেকর্ড বাজে। স্যার ব্যস্ত আছেন, মিটিংয়ে আছেন। কখনো কখনো স্যার ব্যস্ত থাকেন, মিটিংয়ে থাকেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু অধিকাংশ সময় স্যার স্রেফ আড্ডা বা একাকী চুপচাপ কর্মহীনভাবে বসে থাকলেও তার পিএ, পিএস, পিয়ন ভাঙা রেকর্ড বাজিয়েই চলে। এর কারণ একটাই তা হলোÑ তার স্যার কোনো সহজলভ্য ব্যক্তি নয়। স্যারের সাথে দেখা করতে হলে বসতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনের মাত্রা অনুযায়ী বকশিশ দিতে হবে। তারপরই পাওয়া যাবে ছাড়পত্র। স্যারের দেখা। এটা দেখেই ওই দুই স্নেহভাজন সাংবাদিক নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতে এই আচরণ করে। সেই সাথে ওরা নানা ক্ষেত্রে রীতিমতো পণ্ডিতি করে। অবশ্য একথা ঠিক যে, ওদের পণ্ডিতি করার কিছু যোগ্যতাও আছে। এইজন্যই আমি ওদের একজনকে বড় পণ্ডিত আর একজনকে ছোট পণ্ডিত নামকরণ করেছি।
সে যাই হোক এবার আসা যাক ‘মিটিংয়ে আছি’ নিয়ে। এই মিটিংয়ে আছি, ব্যস্ত আছি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে, কান পচে গেছে। কারণ এটা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন ছেলেমেয়েকে ফোন করলেও বলে, বাবা মিটিংয়ে আছি পরে ফোন করছি। আর স্ত্রী স্বামীকে ফোন করলে তো কথাই নেই। মিটিংয়ে আছি, বিরক্ত করো না বলে ফোনের লাইন কেটে দেয়। অবশ্য, যেসব স্বামীরা স্ত্রীর ভয়ে সবসময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে তাদের বিষয়টা ভিন্ন।
এই ‘মিটিংয়ে আছি’ বিষয়টা আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়। তাই বিষয়টা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখেছি, বন্ধুদের সঙ্গে স্রেফ আড্ডায় বসে আছে এমন সময় কেউ ফোন করলে নির্দ্বিধায় ‘মিটিংয়ে আছি’ বলে ফোন কেটে দেয়। অনেককে দেখেছি, অফিসে স্রেফ একাকী বসে আছে, হাতে তেমন কোনো কাজ নেই, ফেসবুকে কে কি লিখেছে তাই দেখছে। এমন সময় কেউ ফোন করলে ফোন ধরেই বলে মিটিংয়ে আছি। এমনও ঘটনা দেখেছি, শুক্রবার ছুটির দিনে বাড়িতে আছে তখন ফোন আসলে এক সরকারি কর্মকর্তা ফোন রিসিভ করে বলেন, পরে ফোন করেন মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি। এই বিষয়ে আমার এক ভাবি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, কদিন আগে এক বিশেষ পরিচিত বন্ধু আমার অফিসে এলে কফি খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এসময় ওই বন্ধুর ফোনে রিং বাজতেই ফোন ধরে বলে, ধরা, একটা মিটিংয়ে আছি, প্লিজ পরে কথা বলছি। ভাবি ‘ধরা’ নামটা শুনে লাফ দিয়ে ওঠেন, বলেন, কে আমাদের ধরা। ধরা তো আমারও বন্ধু। তা কথা বললেই পারতেন। আমরা তো এমনিতেই আড্ডা দিচ্ছি। তারপর ওই বেচারা আর কী করবে আমতা আমতা করে বলেন, না মানে আপনার সাথে কথা বলছি তো তাই…।
এইভাবে ‘মিটিংয়ে আছি’ বলা যেন একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। এটাকে অভ্যাস না বলে বলা উচিত বদঅভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নিজেকে ব্যস্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে জাহির করার এই প্রবণতা, এই বদঅভ্যাস এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এরমধ্যে দিয়ে সবার মধ্যে মিথ্যা বলার একটা প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই মিথ্যা বলার প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে সন্দেহ অবিশ্বাস সৃষ্টি করছে। কেন হবে না। স্ত্রী যখন ছুটির দিনে ফোন করে শোনে তার স্বামী অফিসের মিটিংয়ে, এমনকি মধ্যরাতেও ফোন করলেও শোনে তার স্বামী জরুরি মিটিংয়ে, তখন সন্দেহ অবিশ্বাস খুবই স্বাভাবিক। শুধু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে নয়, পুত্র-কন্যাদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। বাবা-মা সম্পর্কে পুত্র-কন্যাদের মাঝে নানান প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।
এছাড়াও নানান ঘটনা ঘটছে। যা নিয়ে দুঃখ আর আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা নিয়ে অনেককে দীর্ঘদিন আক্ষেপ করতে হয়। অনুশোচনা আর লজ্জায় নিজের কাছেই নিজে ছোট হয়ে যায়। এমন একাধিক ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষী। এমন একটি ঘটনা হলোÑ একদিন সকাল দশটা সাড়ে দশটার দিকে এক বন্ধুর অফিসে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় ওই বন্ধুর ফোনে রিং বাজতেই বন্ধু ফোন ধরে নির্দ্বিধায় বলে দিল, মিটিংয়ে আছি, পরে ফোন করো। তারপর আরো একটা ফোন এলো এবারও ওই একই কথা। ঘণ্টা খানেক বাদে আরও একজন ফোন করলে একই কথা বলে বললো, অফিসে আসতে না আসতেই একের পর এক ফোন বিরক্তিকর। একথা বলে আমার ও আমাদের পরিচিত আরো একজনের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা শেষে লাঞ্চ করছি। এমন সময় তার স্ত্রীর ফোন পেয়ে ফোনটা ধরলো। কথা বললো। তারপর বললো, খুব বড় ভুল হয়ে গেছে ফোন না ধরে। নিজেই বললো, আমার এক মামা মারা গেছে। বাদ জোহর শেওড়াপাড়া জামে মসজিদে নামাজে জানাজা। এখন গিয়ে তো কোনোমতেই জানাজা ধরা সম্ভব না। এটা বলে বন্ধুটি তার ছেলেকে ফোন করলো। ওর অফিস বনানী। নিজের অফিস। গাড়িও আছে। এসময় জ্যামও কম। চেষ্টা করলে জানাজা ধরতে পারবে। কিন্তু না, ছেলে ফোন ধরেই ‘বাবা একটা মিটিংয়ে আছি’ বলে ফোন কেটে দিল। আবার ফোন করলো। একই কথা। আধা ঘণ্টা পর ছেলে রিং ব্যাক করলে ছেলেকে জানালো মামার মৃত্যুর খবর। পরে শুনেছি, ছেলে ওই সময় মিটিংয়ে নয় তার অফিসে ফিঁয়াসের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল। আমার ওই বন্ধুটি এ নিয়ে খুব আক্ষেপ করে, মামার জানাজায় যেতে পারেনি বলে। তারপরও ‘মিটিংয়ে আছি’ এই অভ্যাসও ছাড়তে পারেনি। কি করে পারবে? এতো একটা চর্চা। মিথ্যা বলার চর্চা।
আসলে এই মিথ্যার চর্চাটা আমাদের জন্মগত। ছোটবেলা থেকেই আমরা এই চর্চা করছি। পাড়া-প্রতিবেশী কেউ হঠাৎ এসে খোঁজ করলে খোদ বাবা ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে বলে দেয়, বলোÑ বাবা বাড়িতে নেই। পাড়ার ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে কোনো অনুষ্ঠানের চাঁদা চাইতে গেলে তো কথাই নেই। সোজা-সাপ্টা বলে দেয় বাড়িতে নেই। মা শপিংয়ে বা বান্ধবীর বাড়িতে গেলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বলে যায়, তোর বাবা এলে যদি আমার কথা জিজ্ঞেস করে বলবি ছোট খালা ফোন করছিল, খালার বাড়িতে গেছে। এ বিষয়ে আমার একটা মজার অভিজ্ঞতা আছে। ৭০ দশকে কলেজে পড়ার সময় একদিন আমাদের পাড়া নারিন্দায় বন্ধু আমিনুলকে ডাকতে গেলে ওর এক ভাতিজা এসে বলে, ‘চাচ্চু কইছে চাচ্চু বাড়িত নাই।’
মিথ্যা বলার চর্চা আমরা শিশু বয়সেই রপ্ত করে ফেলেছি। তারপর মোবাইল ফোনের যুগে এই মিথ্যা বলা একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মা তার কন্যা বা পুত্রকে ফোন করলে দিব্যি বলে দিচ্ছে কলেজে ক্লাস আছে, ফিরতে দেরি হবে। অথচ আছে বন্ধুদের আড্ডায়। একইভাবে স্বামী স্ত্রীকে ফোন করলে বলে এই তো ঘরে রান্না বান্না করছি। অথচ তিনি দিব্যি কোনো শপিং কমপ্লেক্সে শপিং করে বেড়াচ্ছেন। ঠিক সেভাবেই স্ত্রী স্বামীকে ফোন করলে বলে অফিসে মিটিংয়ে আছি। স্বামী যখন এ কথা বলছেন তখন একটুও খেয়াল করছেন না যে, তার অফিসের সময় অনেক আগেই পার হয়ে এখন অনেক রাত হয়ে গেছে।
মিথ্যার চর্চা অবশ্য নতুন কিছু নয়, সেই আদিকাল থেকেই আমরা মিথ্যার চর্চা করছি। এমনকি পবিত্র ধর্মগ্রন্থে হাত দিয়ে সত্য বলার শপথ নিয়ে আদালতে দিব্যি মিথ্যা কথা বলছি। মিথ্যা স্বাক্ষী দিচ্ছি, সেই মিথ্যা চর্চার নতুন নাম মিটিংয়ে আছি। ব্যস্ত আছি।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা