বিশ্ব রক্ষায় জলবায়ু সম্মেলন কী পথ দেখাবে

মোল্লাহ আমজাদ হোসেন, আফরোজা আকতার পারভীন ও আদিত্য হোসেন

দুবাই এক্সপো সিটিতে শুরু হতে যাওয়া এবারের জলবায়ু সম্মেলন কিছুটা ভিন্ন হবে এমন প্রত্যাশা করা হচ্ছে। কেননা প্যারিস চুক্তির পর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাকশিল্পায়ন যুগের তুলনায় একুশ শতকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখার বৈশ্বিক উদ্যোগের হিসাব নিকাশ হবে এ বছর। যাকে বলা হচ্ছে গ্লোবাল স্টকটেক। গ্রিন হাউজ গ্যাস দূষণ কমানোর লক্ষ্যে এনডিসি বাস্তবায়ন, দরকষাকষি ও এডাপটেশন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও জলবায়ু তহবিলে অর্থায়নের বিষয়টি বিচার বিশ্লেষণ করা হবে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে এই বিচার বিশ্লেষণের পর লক্ষ্য অর্জনে নতুন উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত হবে কপ২৮ থেকে। কিন্তু এই সম্মেলন শুরুর আগে প্রকাশিত এডাপটেশন গ্যাপ রিপোর্ট ও এনডিসি সিনথেসাইজ রিপোর্টে হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বের দেশগুলোর গ্রিন হাউজ গ্যাস দূষণ কমানোর প্রতিশ্রুতি শতভাগ অর্জন করা গেলেও ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাস দূষণ কমবে মাত্র ২ শতাংশ। অথচ বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আইপিসিসি বলেছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বিশ্বকে ২০১৯-এর তুলনায় ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাস দূষণ ৪৩ শতাংশ এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ৬০ শতাংশ কমাতে হবে। জলবায়ু বিশ্লেষকরা মনে করছেন একুশ শতকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখা যাবে না। কিন্তু বিপদ হচ্ছে এই সময়কালে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে বিশ্ব বড় ধরনের খাদ্য সঙ্কটে পড়বে। সৃষ্টি হবে হাজারো ধরনের নতুন সঙ্কট।

অবশ্য আইপিসিসির একটি সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে ইতোমধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাকশিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৪ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা চলতি বছরের জুন মাসকে বিশ্ব ইতিহাসের উষ্ণতম মাস হিসেবে ঘোষণার পর জাতিসংঘ প্রধান বলেছেন, ‘এরা অব গ্লোবাল বয়লিং হ্যাজ অ্যারাইভড’ (উষ্ণ নয়, বিশ্ব এখন ফুটন্ত অবস্থায় পৌঁছেছে)। এই অবস্থায় কপ২৮ থেকে বিশ্ব তাপমাত্রা কমাতে কতটা অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারবে তা নিয়ে সংশয় আছে। বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অ্যামিরেটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত মনে করছেন, বিশ্ব এখন যে অবস্থায় আছে তাতে এই লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব।

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে অনুষ্ঠিত হবে লিডার সামিট। করোনা উত্তর বিশ্বের কপ২৬ সম্মেলনকে ঘিরে স্কটল্যান্ডে একটি পলিটিক্যাল মোমেনটাম তৈরি হলেও শার্ম আল শেখের কপ২৭-এ তা ধরে রাখা যায়নি। যদিও সেখানকার বড় অর্জন ছিল লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল গঠনে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু তার ধারাবহিকতায় দুবাই কপ থেকে এই তহবিলের যাত্রা শুরুর প্রত্যাশা থাকলেও তা পূরণ না হওয়ার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। আয়োজক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বের সবচেয়ে দূষণকারী দেশ চীন ও দ্বিতীয় দূষণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রধানের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। লিডার সামিটে ইউরোপীয় দেশগুলো, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, সাউথ আফ্রিকাসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সরকার প্রধানদের উপস্থিতি নিশ্চিত হলেও রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টকে সেখানে পাওয়া যাবে না বলে মনে হচ্ছে। আবার রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ও তার বিপরীতে রাশিয়ার উপর পশ্চিমাদের অবরোধ, ইসরাইলে গাজা উপত্যাকায় হত্যাকাণ্ড ও আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের ইসরাইলের প্রতি সমর্থন পুরো বিশ্বকে বিভক্ত করেছে, যার ফলে এক ধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের উপর। ফলে নেট জিরো অর্জনের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্য জিএইচজি দূষণ ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৩ শতাংশ কমিয়ে আনার অপরিহার্যতার পথে বিশ্ব কতটা এগুতে সক্ষম হবে তা নিয়ে সংশয় এখন প্রকট। কেননা দূষণের জন্য ঐতিহাসিকভাবে দায়ী দেশগুলো (এনএক্স ১) নিজস্ব দূষণ কমানোর পাশাপাশি অন্যদের দূষণ কমাতে প্রতিশ্রুত অর্থায়নে কতটা একমত হবে তা-ও অনিশ্চিত। বিশেষ করে ২০২০ সাল থেকে বিশ্ব জলবায়ু তহবিলে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এখনো অর্জিত হয়নি। যদিও ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই তহবিলে ৩০০ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার কথা থাকলেও তার পরিমাণ এখনো খুবই অপ্রতুল। আবার কপ২৮-এ চূড়ান্ত হওয়ার কথা ২০২৫ সাল থেকে জলবায়ু তহবিলের জন্য বর্ধিত আর্থিক সহায়তাসীমা নির্ধারণের বিষয়টি। যা জলবায়ু আলোচনায় নিউ কালেকটিভ কুয়ানটিফায় গোল হিসেবে পরিচিত। এটা নিয়ে কর্মরত কমিটির ৮ম বৈঠক কপ২৮ চলাকালে অনুষ্ঠিত হবে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশ আন্দোলন ও সিভিল সোসাইটির নেতারা মনে করছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজার হত্যাযজ্ঞ থেকে সৃষ্ট অবিশ্বাস এবং অস্থিরতা জলবায়ু দরকষাকষিকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। আবার আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের কারণেও জলবায়ু দরকষাকষিতে তাদের অবস্থান রক্ষণশীল হতে পারে।

জলবায়ু দুর্যোগ ও মানবতার জন্য করণীয়

ব্রাজিলের রিও ডি জেনোরিওতে বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিশ্বকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা জোরালো হতে শুরু করে। কিন্তু তখন গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের কারণে বিশ্ব কী ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণিত ছিল না। ধরিত্রী সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের আওতায় যাত্রা শুরু করে ইউএনএফসিসিসি বা জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক অব ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ কনভেনশন। ১৯৯৫ সালে প্রথম জলবায়ু সম্মেলন বা কনফারেন্স অব পার্টি আয়োজনের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়। শুরুতে সকল দেশ এর স্বাক্ষরকারী না হলেও ২০ বছরের প্রচেষ্টায় এক বড় ধরনের রাজনৈতিক সাফল্যের পথ ধরে বিশ্বের সকল দেশ প্যারিসে এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। প্যারিস চুক্তির মধ্য দিয়ে তা নতুন মাত্রা পায়। যার প্রধান কথা ছিল প্রাকশিল্পায়ন সময়কালের বিবেচনায় একবিংশ শতকে গিয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত করতে না পারলেও ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ধরে রাখতে হবে। কিন্তু জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক অব ক্লাইমেট চেঞ্জ কনভেনশনের সবচেয়ে বড় সঙ্কট হচ্ছে সিদ্ধান্তগুলো কোনো দেশ আইনগতভাবে মানতে বাধ্য নয়। আবার অধিকাংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগও নেই। সকল সিদ্ধান্ত হতে হবে সকল সদস্য দেশের ঐকমত্যের ভিত্তিতে, যা প্রায় অসম্ভব। কেননা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বিপরীত অবস্থানে আছে জিএইচজি দূষণের জন্য ঐতিহাসিকভাবে দায়ী দেশগুলো। কিন্তু ঐ দেশগুলোর আর্থিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতার কাছে বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো জিম্মি। আবার তারা উদ্যোগী না হলে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে বিশ্বকে রক্ষার জন্য নেওয়া উদ্যোগে বড় কোনো সাফল্য আসবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো লক্ষ্য অর্জনে আন্তরিক হলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ তার অন্যান্য মিত্রগুলো কখনো কখনো ইতিবাচক কথা বললেও দিনশেষে দায়িত্ব নিচ্ছে না।

কিন্তু বৈশ্বিক বিপর্যয় থেমে নেই। কেননা ইতোমধ্যে আইপিসিসি বা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে গ্রিন হাউজ গ্যাস দূষণের কারণে বিশ্ব আজ বড় ধরনের হুমকির মুখে। আইপিসিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে জিএচইচজি দূষণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে, আর বিশ্ব বাঁচাতে ঐ বছরই তা স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে হবে। বৈশ্বিক যে লক্ষ্য আছে ২০৫০ সালে নেট জিরো অর্জন এবং একবিংশ শতকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখা, তা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে জিএইচজি দূষণ ৪৩ শতাংশ কমাতে হবে। কিন্তু সেটা অর্জন করার জন্য দেশগুলো এনডিসি দাখিল করলেও তা অপর্যাপ্ত। বিশেষ করে অতি দূষণকারী দেশগুলোর উচ্চাভিলাষী এনডিসি অনুপস্থিত। ফলে বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে হতাশা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দূষণ কমাতে ব্যর্থ হলে ২০৪০ সালের মধ্যেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে। যা বিশ্বের আজকের প্রাকৃতিক রুষ্ঠতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। যার ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে, উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, নতুন নতুন রোগব্যাধি বিশ্বকে গ্রাস করবে। প্রাকৃতিক রুষ্ঠতা উন্নয়নকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। বিশ্ব বিপন্ন হওয়ার মুখে পড়বে। দ্বীপ রাষ্ট্রসহ উন্নয়নশীল ও আবহাওয়াগত ভঙ্গুর দেশগুলো এর প্রধান শিকার হলেও উন্নত দেশগুলোও এর প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে না।

গ্লোবাল স্টকটেকিং (জিএসটি)

এবার কপের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে গ্লোবাল স্টকটেকিং। প্যারিস চুক্তির আওতায় জিএইচজি ইমিশন ২ ডিগ্রির নিচে বা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখার জন্য বিশ্বের দেশসমূহ যে কাজ করেছে তার অর্জন পর্যালোচনা করা হবে। এনডিসি পর্যালোচনার পাশাপাশি অভিযোজন (এডাপটেশন), প্রশমনে (মিটিগেশন) কী কাজ হয়েছে তা-ও পর্যালোচনা করা হবে। পর্যালোচনা করা হবে প্রতিশ্রুত জলবায়ু অর্থায়ন অগ্রগতি নিয়েও।

কিন্তু এবারের গ্লোবাল স্টকটেকিং-এর পর বিশ্ব লক্ষ্য অর্জনে উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ নিতে কতটা আগ্রহী হবে সেটাই বড় প্রশ্ন। কেননা সকল লক্ষ্য অর্জনের জন্য অর্থ দরকার। এটার জন্য যে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার হবে তা উন্নত দেশগুলো জোগান দিতে কতটা প্রস্তুত সেটা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আবার করোনার কারণেও এই অর্থায়ন বিঘ্নিত হয়। অর্থ পাওয়ার বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজা-ইসরাইল বিরোধকে কেন্দ্র করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইপিসিসির নির্দেশিত পথে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য অর্জনের জন্য হয়তো উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি নেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু দেশগুলোর জন্য তা পালনের কোনো আইনী বাধ্যবাধ্যকতা না থাকার ফলে উন্নত দেশগুলো এতে অর্থায়নে কতটা এগিয়ে আসবে সেটা নিয়ে আশঙ্কা প্রকট।

জলবায়ু তহবিলে অর্থায়ন

প্যারিস কপ অর্থাৎ কপ১৫ থেকে বিশ্বের উন্নত (এনএইচ ১) দেশগুলো সম্মত হয়েছিল লক্ষ্য অর্জনে অর্থায়নের কোনো বিকল্প নেই। সেই কারণে ২০২০ সাল থেকে বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার বাইরে ১০০ বিলিয়ন ডলার করে দেবে। কিন্তু ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই তহবিলে ১০০ বিলিয়ন ডলারও পাওয়া যায়নি, যদিও এই সময়কালের মধ্যে এই তহবিলে ৩০০ বিলিয়ন ডলার জমা হওয়ার কথা ছিল। শিল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে ২০২২ সালে শার্ম আল শেখ-এ দাবি করা হয় এই তহবিলের আওতায় তারা ৮৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক এনজিও অক্সফাম দাবি করেছে, উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে এই তহবিলে দেওয়া অর্থের পরিমাণ মাত্র ২৩ বিলিয়ন ডলার। ভারতসহ অন্যান্য দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় এর পরিমাণ আরো কম বলে দাবি করেছে। কপ২৮-এ উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ১০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে এমন হিসাব উপস্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। কিন্তু এলডিসি গ্রুপ, জি৭৭+চায়না চাইবে এই তহবিলের অর্থ প্রচলিত উন্নয়ন সহায়তার অতিরিক্ত হিসাবে নিশ্চিত করতে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো আশা করছে, এবার কপ২৮-এর অর্থাৎ ২০২৫ সালের বিশ্ব জলবায়ু তহবিলে অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার পরিমাণ নির্ধারণে আলোচনা শুরু হবে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো সেটাকে আরো বিলম্বিত করতে চাইছে। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সঙ্কট সব মিলিয়ে অর্থায়ন প্রশ্নে কপ২৮-এ অগ্রগতি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী হতে পারছেন না। যদিও কপ২৮-এ নিউ কালেটিভ কুয়ানটিফায় গোল নিয়ে কর্মরত কমিটির ৮টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ২০২৫ সালের পর থেকে জলবায়ু তহবিলে সর্বনিম্ন অর্থ জোগানের পরিমাণ কত হওয়া দরকার তা নিয়ে কোনো ঐকমত্য বেরিয়ে আসবে এমনটি আশা করা যাচ্ছে না।

গ্লোবাল গোল অন এডাপটেশন (জিজিএ)

গ্লাসগো-শার্ম আল শেখ ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অন গ্লোবাল গোল অব এডাপটেশন কপ২৮-এ গৃহীত হওয়ার কথা। গ্লাসগোতে সিদ্ধান্ত ছিল কপ২৮ থেকে অভিযোজনে (এডাপটেশন) অর্থায়ন দ্বিগুণ করা হবে। আবার কপ২৭-এর সিদ্ধান্ত ছিল যে জিজিএকে গ্লোবাল স্টকটেকিং-এর সাথে যুক্ত করা হবে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাওয়া হচ্ছে জলবায়ু দূষণের কারণে মানুষ ও অর্থনীতির ক্ষতি কমাতে জিজিএ’র আওতায় একটি সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে। এর আওতায় দেশগুলো জাতীয় অভিযোজন প্লান চূড়ান্ত করবে। ইতোমধ্যে ৪৮টি দেশ তাদের এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এটাতে অর্থায়ন দ্বিগুণ করার যে প্রতিশ্রুতি গ্লাসগোতে দেওয়া হয়েছিল তা অর্জন হবে কি না সেটা নিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জ আছে। কার্যত এটার জন্য অর্থ পাওয়ার বিষয়টি এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ। কপ২৮-এ জিজিএ অপারেশনাল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মিটিগেশন ওয়ার্ক প্রোগ্রাম মূল্যায়ন ও নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ

শার্ম আল শেখে কপ২৭-এ মিটিগেশন (প্রশমন) অ্যাম্বিশন অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন ওয়ার্ক প্রোগ্রাম গৃহীত হয়। কপ২৮-এ এটি মূল্যায়ন করে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য অর্জনে করণীয় নির্ধারণ করা হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে করণীয় হিসেবে কপ২৮-এর আওতায় কিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর তা অবশ্যই করতে হবে ২০১৯ সালের অবস্থা থেকে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৩ শতাংশ এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ৬০ শতাংশ কমানোর মতো কর্মসূচি হাতে নিয়ে। এই সময়কালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন তিনগুণ করা মানে প্রতি বছর ১৫০০ গিগাওয়াট করে বাড়ানোর লক্ষ্য স্থির করা হতে পারে। জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার এখনকার অবস্থা থেকে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নেওয়া হতে পারে। অন্যদিকে কুলিং লোড কমিয়ে আনা, দূষণমুক্ত গাড়ির ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে কর্মসূচিও গ্রহণ করা হতে পারে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ২০২৫ সালের মধ্যে এর পক্ষে এনডিসি ঢেলে সাজাতে হবে।

লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাল্ড

আগেই বলা হয়েছে লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল গঠন প্রশ্নে শার্ম আল শেখ-এ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়। যা সত্যি একটি বড় বৈশ্বিক অর্জন। দুবাই দরকষাকষি থেকে এই তহবিলের যাত্রা শুরুর সকল আয়োজন নিশ্চিত করতে গঠিত হয় একটি কারিগরি কমিটি। কমিটির চারটি বৈঠকে এই তহবিল গঠনের সুপারিশ চূড়ান্ত করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর কমিটির ৫ম বৈঠক গত ৩ ও ৪ নভেম্বর দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়। অনেক বিষয় নিয়ে দ্বিমত থাকলেও একটি সুপারিশ বেরিয়ে এসেছে, যা কপ২৮-এর মূল দরকষাকষির সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু ইতোমধ্যে কারিগরি কমিটির সুপারিশে কপ২৯ থেকে এই তহবিল কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। সুপারিশে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল পরিচালনা করার জন্য বিশ্বব্যাংকের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে এই তহবিলে টাকা কোথা থেকে আসবে, এই টাকা কারা পাবে তা-ও চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। এই তহবিল পরিচালনা পরিষদ কীভাবে কাজ করবে তা নিয়ে মতদ্বৈততা রয়েছে। অতি দূষণকারী দেশগুলোর জন্য এই তহবিলে অর্থ দেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার কথা থাকলেও বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্র স্বেচ্ছাধীন (ভলান্টারি) করতে চায়, ফলে এটি নিষ্পত্তি হয়নি। অধিকাংশ দেশই মনে করছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ সকল দেশের এই তহবিলের অর্থ পাওয়ার সুযোগ থাকতে হবে, তা নিয়েও কমিটি একমত হতে পারেনি। তবে এলডিসি গ্রুপের লস অ্যান্ড ড্যমেজ পরামর্শক এম হাফিজুল ইসলাম খান মনে করছেন, কপ২৮ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করবে এবং ২০২৪ থেকে তহবিলটি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করতে পারবে। সুপারিশ অনুসারে ১১টি শর্ত অনুসরণ করে বিশ্বব্যাংক এই তহবিল পরিচালনা করবে।

বাংলাদেশ ও কপ২৮

সকলের জানা কপ নেগোসিয়েশন প্রক্রিয়ায় একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তেমন কোনো করণীয় নেই। এলডিসি, জি৭৭+চায়না ও সমমনা দেশগুলোর সাথে সম্মিলিতভাবে অন্যান্য বারের মতো এবার বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল কাজ করবে। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ূ পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন। থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি। এর বাইরেও বিভিন্ন ধরনের পার্শ্ব কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য কপ২৮ যাবেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তবে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের অনেকেই পুরো দরকষাকষিতে থাকতে পারবেন না। এর বাইরে সাইড ইভেন্ট এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ, জ্বালানির দক্ষ ব্যবহারসহ ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্য অর্জনের পক্ষের বাংলাদেশের নেওয়া কর্মসূচিগুলোকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা হবে বলে জানা গেছে। তুলে ধরা হবে বাংলাদেশের অ্যাডাপটেশন কাজের অগ্রগতি।

উপসংহার

তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.০১ মতান্তরে ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আসার পরই বিশ্বে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতে ব্যর্থ হলে বিশ্ব কী ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে তা তুলে ধরা হয়েছে। আয়োজক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত কপ২৮ থেকে নানা বিষয়ে সাফল্য পেতে বছরব্যাপী কাজ অব্যাহত রেখেছে। জলবায়ু বিষয়ে এপেক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডের এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর মধ্যে জলবায়ু নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে তা কপ২৮ ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে জলবায়ু রক্ষায় অর্থায়ন, ফসিল ফুয়েল সাবসিডি ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্যে নামিয়ে আনাসহ নানা বিষয়ে যে রাজনৈতিক মোমেনটাম তৈরি হয়েছিল তা দুবাই কপে ফিরিয়ে আনা যাবে এমনটি কেউ প্রত্যাশা করছেন না। আবার আগামী বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ফলে জলবায়ু বিনিয়োগ প্রশ্নে কোনো উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত তারা নেবে এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার বৃদ্ধি প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অগ্রণী ভূমিকা রাখবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তবে আইপিসিসির বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট অনুসরণ করে বৈশ্বিক তাপমাত্রা একুশ শতকের শুরুতে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখার পথে বিশ্ব এগুতে পারবে এমন কোনো আশাবাদ দেখা যাচ্ছে না। যদিও সিভিল সোসাইটি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো লক্ষ্য অর্জনে তাদের চাপ অব্যাহত রেখেছে। দুবাই জলবায়ু দরকষাকষিতেও তা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু প্রাপ্তি কী হবে তা বলা যাবে কপ২৮-এর শেষে। কেননা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে জরুরি বিনিয়োগ এবং ঐতিহাসিকভাবে দূষণকারী দেশগুলোর গ্রিন হাউজ গ্যাস দূষণ কমাতে উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা নেওয়া। কিন্তু এই দুটি লক্ষ্য অর্জনের পক্ষে উন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা যে অনুপস্থিত তা নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। বিশ্ব রক্ষায় জলবায়ু অর্থায়নের চেয়ে তারা বিশ্ব ধ্বংসে যুদ্ধে অর্থায়নে অতি আগ্রহী।  ঢাকা, নভেম্বর ২৬, ২০২৩

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: প্রচ্ছদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

9 + fourteen =