আলোচিত আবিষ্কার

২০২৩ সালে আবিষ্কার হয়েছে অনেক প্রযুক্তি। রহস্য ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে অজানা কিছু। গত বছরের আবিষ্কার হওয়া নতুন কিছু নিয়ে জানিয়েছে শিশির।

এআই পিন

পিন জামাকাপড় কিংবা কাগজ আটকানোর জন্য ব্যবহার হয়। তবে প্রযুক্তির বদৌলতে তা ভিন্ন রুপ নিয়েছে। এআই পিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান হিউম্যানের প্রথম পণ্য। এই স্টার্টআপ অ্যাপলের সাবেক কর্মীরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। হালকা ওজনের একটি যন্ত্র পোশাকে পিন আকারে যুক্ত থাকে। হাতের তালুর মাধ্যমে মোবাইল ফোনে কল ও অন্যান্য কাজ করা যায় এই পিনের মাধ্যমে। নতুন এই যন্ত্র স্মার্টফোনের ব্যবহার কমিয়ে দিতে পারে। আনুষ্ঠানিকভাবে চালু না হলেও প্যারিস ফ্যাশন উইকে সুপার মডেল নাওমি ক্যাম্পবেল যন্ত্রটি ব্যবহার করেছেন। ক্ষুদ্র এই যন্ত্র ব্যবহারকারীদের কল, বার্তা পাঠাতে ও গ্রহণ করতে কাজ করে।

পা বিহীন টিকটিকি (লিজার্ড)

অ্যাঙ্গোলার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত সেররে দে নেভের ঢালে পা-বিহীন টিকটিকির একটি নতুন প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। সাপের মতো দেখতে এ টিকটিকিকে স্কিনকও নামেও ডাকা হয়। এটি পোকামাকড় ও ছোট শিকার ধরার জন্য পাতা ও বনের মাটিতে লুকিয়ে থাকে। নামিব মরুভূমির উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এই পর্বতে বিচিত্র গাছপালা ও প্রাণিদের আবাস। ভার্জিনিয়া চিড়িয়াখানার মতে, স্কিনকগুলো সাপের থেকে আলাদা। কারণ তাদের বাইরের কান খোলা এবং চোখের পাতা রয়েছে, যা নড়াচড়া করতে পারে। যদিও বেশিরভাগ স্কিনক একই রঙের, তবে সদ্য আবিষ্কৃত স্কিনকটির (বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাকনটিয়াস মুকওয়ান্দোর) গলায় গোলাপি বৃত্ত রয়েছে।

হাজার বছর পুরানো তাঁতে বোনা জুতা

জুতা আমাদের সকলেই কাছেই খুবই পরিচিত। তবে তা যদি হয় তাঁতে বোনা হাজার বছরের পুরানো তাহলে তা আর সাধারণ কিছু থাকে না। স্প্যানিশ কয়লাখনি থেকে তাঁতে বোনা ২২টি স্যান্ডেল পাওয়া গিয়েছিল ১৮৫৭ সালে। ১৯৭০ এর দশকে কার্বন আইসোটোপ পরীক্ষায় জানা যায়, এটি ৫০০০ বছরের পুরানো। তবে বার্সেলোনার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলোর বয়স ১০০০০ বছরের কিছু বেশি। হাজার বছর আগের শিল্পকর্ম বিস্মিত করছে সবাইকে।

মোনালিসার নতুন রহস্য উন্মোচন

মোনালিসা শুধুমাত্র একটি ছবি নয়। এই আলোচিত শিল্পকর্ম নিয়ে হাজারো রহস্য রয়েছে। এ ছবি নিয়ে অনেকে গবেষণা করেছেন। মোনালিসা কে ছিলেন, কেন তার ঠোঁটে সেই রহস্যময় হাসি – তা নিয়ে এখনো বিস্তর জল্পনা চলে। তবে মোনালিসার ছবি থেকে এক্সরে-র মাধ্যমে এবার উন্মোচিত হয়েছে নতুন রহস্য। এর ভিত্তি-স্তর পরীক্ষা করে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, প্লাম্বোনাক্রাইট নামের একটি খনিজ উপাদান রয়েছে মোনালিসার ছবিতে। তেল ও লেড অক্সাইড একত্রে মিশে এই উপাদানটি তৈরি হয়েছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিই প্রথম মানুষ – যিনি এর ব্যবহার করেছেন।

পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো ফ্লাশ টয়লেট

দৈনন্দিন জীবনে ফ্লাশ টয়লেট আমরা সকলেই ব্যবহার করি, তবে কখনো কী ভেবে দেখেছি অনেক আগে সেই বস্তুটি দেখতে কেমন ছিল। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জানা গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ফ্লাশ টয়লেটের কথা। ২৪০০ বছরের পুরানো এক লেভেটরি ও বেন্ট পাইপ সে সময়ের চীনের অভিজাত শ্রেণির কথাই মনে করিয়ে দেয়। জি’য়ান শহরের ইউয়েইয়াং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনায় এটি পাওয়া গেছে। যেহেতু খুবই দুষ্প্রাপ্য ছিল তাই সে সময় সকলে তা ব্যবহার করতে পারতো না।

পিরামিডের গোপন পথ

পৃথিবীর রহস্যময় এবং আশ্চর্যজনক স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম মিশরের পিরামিড। হাজারো প্রত্নতত্ত্ববিদ পিরামিড নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। গত কয়েক বছর ধরেই পিরামিডের নানা রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে। এর ভেতর রয়েছে রহস্যময় এক শূন্যস্থান। অবলোহিত রশ্মি ও কসমিক রশ্মি ব্যবহার করে পিরামিড প্রজেক্ট কর্মকর্তারা খুঁজে পেয়েছেন মূল প্রবেশ পথের কাছাকাছি ৩০ ফুট দীর্ঘ এক করিডোর। মার্চে মিশরের পুরাতত্ত্ব বিষয়ক সুপ্রিম কাউন্সিলের প্রধান মোস্তফা ওয়াজিরি জানান, প্রবেশ পথে মমি ঢোকানো সহজ করতে বা অজানা কোনো প্রকোষ্ঠের গন্তব্য হিসেবে এই করিডোর তৈরি হয়ে থাকতে পারে।

নাটক রচয়িতা কে জানাল এআই

সতেরো শতকের শেষ দিকের স্প্যানিশ এক নাটকের রচয়িতা কে তা অজ্ঞাত ছিল। এ বছরের জানুয়ারিতে জানা গেল এটি ফেলিক্স লোপে দে ভেগার কাজ। সেই রহস্য ভেদ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। গবেষকরা দেশটির জাতীয় গ্রন্থাগারে ১৩০০ অজ্ঞাত পরিচয় খসড়ার পাঠোদ্ধার ও লেখকের পরিচয় বের করেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। স্প্যানিশ স্বর্ণযুগের পাণ্ডুলিপিটির নাম ছিল ‘দ্য ফ্রেঞ্চউইমেন লরা’। ১৬৩৫ সালে মৃত্যুর আগে ফেলিক্স এটি লিখে গিয়েছিলেন।

টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে গলার হার

টাইটানিক ডুবেছে ১৯১২ সালে। তারপর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে পড়ে আছে এর ধ্বংসাবশেষ। সম্প্রতি গভীর জলে অনুসন্ধান চালানো সংস্থা ম্যাজিলান পুরো জাহাজজুড়ে অনুসন্ধান চালায়। এতে তারা পেয়েছে একটি গলার হার, যাতে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক হাঙর ‘মেগালোডোন’র একটি দাঁত। ম্যাজিলানের সিইও রিচার্ড পার্কিনসন গলার হারটিকে ‘বিস্ময়কর, চমৎকার ও শ্বাসরুদ্ধকর’ বলে অভিহিত করেছেন।

সাগরতলে গুপ্তধন

ইতালির সার্ডিনিয়া উপকূলে এক ডুবুরির চোখে পড়ে সাগরতলে ধাতব কী যেন ভাসছে। তিনি গভীরে যান আর খুঁজে পান ৩০০০০-৫০০০০টি ব্রোঞ্জ মুদ্রা, যা চতুর্থ শতকের বলে জানা গেছে। অ্যাম্ফোরে নামের দুই হাতলবিশিষ্ট প্রাচীন রোমান ও গ্রিক পাত্রও উদ্ধার করা হয়েছে সেখান থেকে। এর ফলে এমন সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে, যাতে করে মনে হচ্ছে কাছে-পিঠেই কোথাও রয়েছে ডুবন্ত জাহাজ, যাতে রয়েছে আরও আরও গুপ্তধন।

মানুষের কৃত্রিম ভ্রুণ

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালেটেকের একদল গবেষক যৌথভাবে মানুষের কৃত্রিম ভ্রুণ তৈরি করেছেন। এজন্য তারা শুক্রাণু ব্যবহার করেননি, ব্যবহার করেছেন মানবদেহের স্টেম কোষ। যদিও এ কাজ বেশিরভাগ দেশে আইনবিরুদ্ধ। তবে ঠিক কৃত্রিম মানুষ তৈরির উদ্দেশ্যে তা করা হয়নি বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। তাদের দাবি, মানব শরীরের স্বাভাবিক বিকাশ, জিনগত রোগ ও বার বার গর্ভপাতের কারণ অনুসন্ধানের জন্যই এ গবেষণা করেছেন তারা।

পরমাণুর এক্স-রে ফটো

যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী একক পরমাণুর এক্স-রে ফটো তুলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আর্গন ন্যাশন্যাল ল্যাবরেটরি গবেষক ওয়াই হিলা ও ভলকার রোজ তাদের সহকর্মীদের নিয়ে এ কাজটি করেছেন। তারা ছোট্ট একটি বস্তু নিয়েছেন, যাতে ১০ হাজার পরমাণু ছিল। তারপর সেখান থেকে সিনকোট্রন এক্স-রের সাহায্যে একক পরমাণুর ছবি তুলেছেন। তাদের এই পদ্ধতিটি পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ কোনো বস্তুতে যদি খুব সামান্য পরিমাণ বিষাক্ত বা ক্ষতিকর পদার্থ থাকে, সেটি শনাক্ত করা সম্ভব হবে এই পদ্ধতির সাহায্যে।

কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণ

রসায়নে ২০২৩ সালে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা। জলবায়ু সংকটের অন্যতম গিনিপিগ হচ্ছে সমুদ্র। সেখানে প্রতিবছর দূষণ হচ্ছে। সমুদ্রে প্রতিবছর কার্বন ডাই অক্সাইড জমে সমুদ্র দূষিত করে তুলেছে। বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের পানি থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ করে তা থেকে জ্বালানি তৈরি করার উপায় খুঁজে পেয়েছেন।

বিজ্ঞানীদের পরিধানযোগ্য সেন্সর টেলিমেডিসিন ক্ষেত্রকে আরও উন্নত করেছে। বছরজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জোয়ার রসায়নেও লাগে। রসায়নে জিপিটি ভাষার মডেল উদ্ভাবন ওটচঅঈ এর সেরা দশের তালিকায় রয়েছে। প্লাস্টিক দূষণ কমাতে ডিপোলিমারাইজেশন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। সম্প্রতি সুইস ফার্ম একটি নতুন প্ল্যান্ট চালু করেছে, যেখানে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বছরে ৪০ কিলো টন চঊঞ রিসাইকেল করা হবে। অন্যদিকে রসায়নে কোয়ান্টাম ডট আবিষ্কার করে নোবেল পেয়েছেন আলেক্সি ইয়াকিমভ, মুঙ্গি বাওয়েন্ডি ও লুই ব্রম্নস।

ডিএনএ এডিটিং

কৃত্রিমভাবে এক পদার্থের সঙ্গে অন্য পদার্থ মিলিয়ে নানান বস্তুর উৎপাদন বিশ্ববাসী দেখেছে। উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর ক্ষেত্রেও ঘটেছে এমন ঘটনা। বিজ্ঞানীরা মানুষের ডিএনএ এডিটিং নিয়ে গবেষণায় অনেক দূর এগিয়েছেন। ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে ডিএনএ পরিবর্তন করার সক্ষমতা অনেক বাড়বে। এ বছরেই জিন এডিটিং প্রযুক্তি বহুদূর এগিয়ে যাবে, যা সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

13 + 11 =