মাসুম আওয়াল
তিন দশকেরও অধিক সময় ধরে বাংলা সিনেমার জন্য গান তৈরি করে আসছেন শওকত আলী ইমন। অডিও-ভিডিও কোম্পানির জন্যও গান তৈরি করেছেন তবে সিনেমার তুলনায় তার পরিমাণ খুব কম। কাজ করেছেন ভারতীয় সিনেমাতেও। কিবোর্ড প্লেয়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে এক সময় খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে গেছেন সংগীত পরিচালক হিসেবে। একই সঙ্গে সংগীত পরিচালক, গীতিকার, কিবোর্ড, বেহালা, গিটারে পারদর্শী তিনি। তিন দশকে প্রায় ৪৫০টি চলচ্চিত্রের গানের সুর দিয়েছেন এবং সংগীত পরিচালনা করেছেন। নিজেও বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের শিল্পী। শওকত আলী ইমন আজও চলমান তার আপন আলোয়। সংগীত পরিবারের মানুষেরা তাকে নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘আমাদের একজন শওকত আলী ইমন আছেন’। নতুন করে আলোচনায় এসেছে ‘বধূ বেশে কন্যা এখন এলো রে’ গানটি। শওকত আলী ইমন ২০০৩ সালে তৈরি করেন এই গান। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই মানুষটির পথ চলার গল্প।
ঢাকার ছেলে মুন্না ভাই
শওকত আলী ইমনের জন্ম ঢাকা জেলায় ১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই। তার পৈতৃক নিবাস মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইরে। তার মা মুসলিমা বেগম একজন সংগীতশিল্পী ছিলেন। তার দুই বোন আবিদা সুলতানা ও রেবেকা সুলতানাও দেশের নামকরা সংগীতশিল্পী। শওকত আলী ইমন নানা সময় গণমাধ্যমে শুনিয়েছেন তার জীবনের গল্প। পরিবারের মানুষেরা তাকে ডাকেন মুন্না ভাই বলে। গুণী এই সংগীত পরিচালক বলেন, ‘আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। সেইসূত্রে আমরা থাকতাম মতিঝিল কলোনিতে একটা অ্যাপার্টমেন্টে। আমার জন্ম সেখানেই। পরে আমরা নয়াপল্টনে চলে আসি। তারপর থেকে ওখানেই বেড়ে ওঠা। আমাকে বাসায় সবাই বিভিন্ন নামে ডাকে। আমার বোনেরা ডাকে মুন্না ভাই বলে। কারণ আমি ভাই বোনদের মধ্যে সবার ছোট। ছোট ভাই নাননে-মাননে বাচ্চা এরকম একটা ব্যাপার ছিল তো! আমার ভাগ্নে ভাগ্নিরাও সেই থেকে মুন্না মামা বলে ডাকে।’
যেভাবে সংগীতের সঙ্গে জড়ালেন ইমন
ইমনের বেড়ে ওঠা এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। তার বোন ও দুলাভাই আবিদা সুলতানা ও রফিকুজ্জামান। ইমন বলেন, ‘নয়াপল্টনে আমার বাবার যে বাড়ি ছিল সেখানে আমার চাচা, ফুপু সবাই ওই এলাকায় থাকতেন। আমার নানির বাড়ি ছিল সিদ্ধেশ্বরীতে, বাবার বাড়ি থেকে কাছেই। বাবা-খালাদের বাড়িতে গান বাজনার চর্চা হতো নিয়মিত। গানের পরিবেশটা আমি পেয়েছি ছোটবেলা থেকিই। আমাদের, চাচার কিংবা মামা-খালাদের বাসায় প্রতিমাসে একটা না একটা অনুষ্ঠান হতো। কেউ কবিতা পড়তেন, কেউ নাটক করতেন। কেউ গান গেয়ে শুনাতেন। আমার বাবা বাঁশি বাজাতেন। সেই থেকে গানটা রক্তের ভেতর প্রবেশ করেছে। গান শিখেছি পারিবারিক ট্র্যাডিশন থেকেই। ওস্তাদের হাতে নাড়া বেঁধেছি। গান শিখেছি। তবলা শিখেছি। ক্লাসিক্যাল শিখেছি।’
মায়ের স্বপ্ন পাইলট, নিজের স্বপ্ন সংগীত পরিচালক
ছোটবেলা থেকেই শওকত আলী ইমন স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে সংগীত পরিচালক হবেন। ইমন বলেন, ‘সংগীতকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিব এটা পরিবার একদমই চায়নি। মেয়েরা গান করেছে শখে। এদিকে ছেলে মিউজিক করে উপার্জন করবে, প্রফেশন হিসেবে এটাকে বেছে নিবে; এটা ভাবতে পারতেন না পরিবারের মানুষরা। বড় হওয়ার পরে পড়াশোনা করো, চাকরি করতে হবে। পারিবারের চাওয়া ছিলো এমনই। প্রফেশনালি সংগীতে আসার পেছনে বিশেষ করে আবিদা সুলতানা আপার অবদান অনেক বেশি। তার হাজবেন্ড আমার দুলাভাই রফিক ভাইয়ের অবদানও অনেক। আমার মেজো বোন রেহেনা আপারও অবদান অনেক। তিনি ছিলেন শিশু একাডেমির পরিচালক। উনার কারণে শিশু একাডেমিতে আমার অনেক যাতায়াত হতো। ওখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে আমি গান গাইতাম। ইন্সট্রুমেন্টাল প্রোগ্রাম হতো। আমি পারফর্ম করতাম। আমাদের পাড়ায় ছোটদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘খেলাঘর’ ছিল সেখানেও আমি অংশগ্রহণ করতাম।’
কিবোর্ড নিয়ে পথচলা শুরু
ইমন বলেন, ‘আমি প্রথমে কিবোর্ড বাজাতাম। আমার মেজো আপা খুব ভালো হাইওয়ান গিটার বাজাতেন। আপা খুব উৎসাহ দিতেন। কিবোর্ড ভালো করে বাজাতে বলতেন। গান তো করতামই কিন্তু বেসিকালি আমি কিবোর্ড প্লেয়ার হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে যাত্রা শুরু করি। তখন আবিদা আপা প্রচণ্ড ব্যস্ত শিল্পী। গানের রেকর্ডিংয়ে যাওয়ার সময় আপা আমাকে নিয়ে যেতেন। তখন আমি ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি। আপার সঙ্গে গিয়ে দেখতাম একটা স্টুডিওর মধ্যে সত্য সাহা রেকর্ডিং করছেন। আমি প্রথম কিবোর্ড প্লেয়ার হিসেবে ঢাকা অর্কেস্ট্রাতে ঢুকলাম। তখন কিবোর্ড যারা বাজাতেন তাদের অনেক মূল্যায়ন ছিল। কারণ বাংলাদেশে কম কিবোর্ডিস্ট ছিল। প্রায় সব রেকর্ডিংয়ে আমার ডাক পড়তে শুরু করলো। সেই সময় মিউজিক কম্পোজার হওয়ার ইচ্ছে জাগলো। ভাবলাম মিউজিক কম্পোজার হতে হলে আমাকে কারো আন্ডারে কাজ করতে হবে। পরে আমি একটা ব্যান্ডে ঢুকেছিলাম। ব্যান্ডের নাম ‘চাইম’। আবিদা সুলতানা আপা-রফিক ভাইয়ের মাধ্যমে সত্য দা, আলাউদ্দিন আলী পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাকে বেগ পেতে হয়নি। আলাউদ্দিন আলী তো আমার পরিবারের মানুষ ছিলেন। আমার আরেক বোনের হাজব্যান্ড ছিলেন। শেষে কাজ শুরু করলাম আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে। আমি অনেকদিন তার সহকারী ছিলাম। আমি আজ যতটুকু হতে পেরেছি তাদের কারণেই। সংগীত একটা গুরুমুখী বিদ্যা। গুরুর আন্ডারে কাজ না করলে শেখা যায় না।’
সংগীতজীবন
ইমনের সংগীতজীবন শুরু হয় ১৯৯৬ সালে ‘রুটি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ২০০২ সালে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা দেখা দিলে তিনি সংগীত পরিচালনা বন্ধ করে দেন। ২০০৭ সালে ‘এক টাকার বউ’ চলচ্চিত্র দিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করেন। ইমনের সুরে কণ্ঠ দিয়ে সংগীতজীবন শুরু করেছেন আসিফ আকবর, দিনাত জাহান মুন্নী, তাসিফ সহ আরো অনেকে। ইমন কলকাতার অন্যায় অবিচার, বিচারক সহ ১২টি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন। সেখানে কণ্ঠ দিয়েছেন কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক, সাধনা সরগম, বাবুল সুপ্রিয়, সনু নিগম, শান। তিনি বলিউডে মহেশ ভাট পরিচালিত ‘সার্চ ২’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন। ইমন বলেন, ‘চলচ্চিত্রের গান করতে গেলে যেটা হয়, আমি গানের ভিতরে পুরো দৃশ্যটা দেখতে পাই। আমি প্রতিটা লাইন কি মিউজিক করেছি, কি এক্সপ্রেশন দিয়েছি। আমার গানে চিত্রনায়ক রাজ্জাক, চিত্রনায়ক আলমগীর যেমন ঠোঁট মিলিয়েছেন তেমনি বাপ্পি-সাইমনরাও ঠোঁট মিলিয়েছে। অনেক জেনারেশন আমার গান পেয়েছে, আমার খুব গর্ব হয়, খুব ভালো লাগে। কিন্তু অডিও গান করে আমি এই ফিলটা পাই না। অনেক গান হারিয়ে যায়। কিন্তু চলচ্চিত্রের গান থেকে যায়। বাংলাদেশে মানুষের মুখে মুখে যে গানগুলো আছে তার অধিকাংশই চলচ্চিত্রের গান।’
পুরস্কার ও সম্মাননা
২০১৩ সালে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শওকত আলী ইমন। ২০২২ সালে আবারও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
বিচারকের আসনে শওকত আলী ইমন
২০২২ সালে বেসরকারি টিভি চ্যানেল আরটিভির সংগীত বিষয়ক রিয়েলিটি শো ড্যানিশ প্রেজেন্টস ‘ইয়াং স্টার’-এর বিচারকের আসনে অতিথি বিচারক হিসেবে বসেছিলেন শওকত আলী ইমন। ইমন বলেন, ‘শুধু সিনেমার গান দিয়ে বিশেষ পর্বে অতিথি হতে পেরে ভীষণ ভালো লেগেছে। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা বেশ দারুণ ছিল।’
ছেলেকে নিয়ে মায়ের গর্ব
মায়ের স্বপ্ন পূরণ না করে নিজের পছন্দ মতো ক্যারিয়ার গড়ায় রাগ করেছিলেন কী শওকত আলী ইমনের মা। তার মুখ থেকেই শোনা যাক। ইমন বললেন, ‘আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল অন্য। আমার নানা ছিলেন পাইলট। মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল আমি পাইলট হই। আমি ফ্লায়িং ক্লাবে ভর্তি হবো, এটা মায়ের ইচ্ছে। কিন্তু আমি সংগীতে আসলাম। মা বলল, ছেলে উচ্ছন্নে গেছে। তবে মায়ের ইচ্ছা ছিল আমি পড়াশোনা শেষ করে যা ইচ্ছা হয় সেটা করি। আমি পড়াশোনা শেষ করেছি। আমার মা মারা গেছেন ২০১৩ সালে। শেষের দিকে খুব অসুস্থ ছিলেন মা। মা কথা বলতে পারতেন। আমি একদিন রাতের বেলায় ছিলাম হাসপাতালে মায়ের সঙ্গে। হঠাৎ করে মাকে বললাম, মিউজিক করব পাইলট হব না বলে আমাকে একবার খুন্তি দিয়ে পিটিয়েছিলে। এখন আমাকে নিয়ে কি তুমি খুশি? মা আমাকে বলেছিলেন, শওকত আলী ইমন তো একজনই আছে। কিন্তু পাইলট অনেক। আমি তোকে নিয়ে গর্ব করি।’
সংগীত নিয়ে স্বপ্ন
শওকত আলী ইমন বলেন, ‘যদি সরকারি উদ্যোগে আমাদের নেক্সট জেনারেশন তৈরি করে যেতে পারতাম খুব ভালো লাগতো। যারা আমাদেরকে রিপ্রেজেন্ট করবে, বাংলাদেশের সংগীতকে ধরে রাখবে। নতুন যারা কাজ করছে তাদেরকে নিয়ে একটা ফ্রাস্ট্রেশন কাজ করে আমার। তারা প্রপারলি শিখে আসছে না।’
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সূর মুর্ছনা