বদলে যাওয়া বাংলাদেশে তিন মাস কাটানো

সালেক সুফী

পর্ব দুই

বলেছি নানা কারণে ৫২ পেরুনো পরিবর্তিত বাংলাদেশে প্রবাস জীবনের সাম্প্রতিক  সময়ে দীর্ঘতম অবস্থানকালে অনুসন্ধিৎসু মন নানা চ্যালেঞ্জ খুঁজে পেয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রসরমান নতুন প্রজন্ম উন্নয়নের স্বর্ণশিখরে এগিয়ে যেতে আগ্রহী। পথের বাধাগুলো ডিঙ্গাতে হলে সংকটের শেকড় অনুসদ্ধান জরুরি।  পর্যায়ক্রমে সেগুলো আলোচনা করবো।  বাংলাদেশে অবস্থাকালে নানা বয়সের, নানা পেশার, নানা দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের সঙ্গে আন্তরিক আলোচনার ভিত্তিতে অর্জিত অভিজ্ঞতা এখানে আলোচনা করবো।

বিশ্বজোড়া নানা ভূরাজনৈতিক বিবর্তনের সময়ে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা, মুদ্রাস্ফীতি সামাল দেওয়া, দ্রব্যমূলের উর্ধ্বগতি সামলানো:

আমার মতে ১৫ বছর তিন টার্মে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকার নতুন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ ক্ষয়িষ্ণু অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলা। কোভিড সংক্রমণ সামাল দিতে না দিতেই এসেছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ যা এখনো চলমান।  মূলত দুই পরাশক্তি বলয়ের এই ছায়া যুদ্ধ উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত বিশ্ব সবার অর্থনীতি নানাভাবে  প্রভাবিত করেছে, করছে।  উন্নয়নশীল অর্থনীতির সোপানে উন্নীত বাংলাদেশ নিজস্ব মুদ্রানীতির অসংলগ্নতা, ব্যাঙ্ক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শেয়ার মার্কেটে অবাববস্থাপনা, চিহ্নিত মহলের অবাধ লুটপাট, অর্থ সম্পদ লোপাটের কারণেও বিপাকে পড়েছে।

প্রতিষ্ঠানগুলোর ভান্ডার প্রায় শূন্য, প্রচুর অর্থ সম্পদ পাচার হয়ে গেছে মুদ্রাস্ফীতি আশংকাজনক। এমতাবস্থায় চেনা মুখের সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বাজার মূল্য সামাল দেওয়া প্রধান চ্যালেঞ্জ। এরই মাঝে এসেছে হামাস ইস্রায়েল সংঘাত, প্রতিক্রিয়ায় হুতি বিদ্রোহীদের আগ্রাসন। অতি সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে চলছে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর যুদ্ধ। পরাশক্তি চীন, যুক্তরাষ্ট্র এতদঅঞ্চলে প্রভাব বিস্তারে মরিয়া হয়ে ওঠায় আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখা বাংলাদেশের বিশাল চ্যালেঞ্জ। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ এখন ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বহন করছে।

আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক  ভূরাজনীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত করলেও সরকারকে ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার করে শৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে হবে। সঠিক মুদ্রা নীতি নিরুপণ করে মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে, ডলার বিনিময় হার সঠিক বিবেচনার মাধ্যমে নিরুপণ করতে হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ সম্পদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। লুটেরা মহলের পরিচয় অজানা নয়। বাজার সিন্ডিকেট সবার চেনা। সরকার সুষ্ঠু ব্যাবস্থাপনার মাধ্যমে এদের দমন অথবা নিয়ন্ত্রনের আশু  ব্যবস্থা করতে না পারলে অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে।

দেশে কিন্তু কৃষকরা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাম্পার ফলন করছে প্রতিনিয়ত।  চাল, ডাল, সবজি, মাছ, পেঁয়াজ,মরিচের সরবরাহ চেন স্বাভাবিক থাকলে সংকট থাকার কথা না। কিন্তু সংকট হয় চিহ্নিত মধ্যস্বত্ব ভোগীদের কারসাজির কারণে। আমি নিজে আশুগঞ্জ, কুমিল্লা, গাজীপুর অঞ্চল থেকে ঢাকা ফেরার সময় প্রতিবার অনেক সুলভ মূল্যে তরিতরকারি, মাছ নিয়ে এসেছি। কিন্তু ঢাকার বাজারে কৃত্রিমভাবে এগুলোর দাম অনেক বেশি দেখেছি।

ঢাকা শহরে ফেরি করে বেড়ানো সবজি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে চাঁদাবাজির করুণ রূপ দেখেছি। সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যগণ এবং দায়িত্ব প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা সক্রিয় হলে অচিরেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। তবে সেই ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা থাকতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক পণ্য প্রয়োজনে আমদানি করে সরবরাহ বজায় রাখতে হবে। আসন্ন রোজার মাস সরকারের জন্য অগ্নি পরীক্ষা।

আর একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় নির্ধারিত মাত্রার উপর ধরে রাখা। মনে রাখতে হবে সরকারকে বিপুল সংখ্যক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া ঋণের সুদ সহ আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে।  রপ্তানি আয় এবং বিদেশে কর্মরত প্রবাসী আয় বাংলাদেশের মূল উৎস।  রপ্তানি আয় বজায় রাখার জন্য শিল্পগুলোতে মানসম্মত এবং নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ভুল পরিকল্পনা এবং কৌশলের কারণে সরকার নিজেদের প্রাথমিক জ্বালানি সম্পদ আহরণ অবজ্ঞা করে জ্বালানি আমদানির পানে ছুটে সংকটে পড়েছে।

দ্রুত এখন থেকে বেরিয়ে আসা এখন অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। সরকারকে জ্বালানি বিদ্যুৎ অপচয় কমানো, কৃচ্ছতা সাধন নিশ্চিত করতে হবে। রেমিটেন্স প্রবাহ হুন্ডির পরিবর্তে যেন সঠিক চ্যানেলে আসে সেই প্রক্রিয়াটি সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। প্রবাসীদের প্রতি আচরণে আরো উদারতা এবং সহশীলতা দেখতে হবে। কাজগুলো কিন্তু সহজ না মোটেও।

মনে রাখতে হবে ২০২৬ থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে অন্নুনত দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অনেক সুবিধা হারাবে। তাই ২০২৪, ২০২৫ বাংলাদেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের উচিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অযথা সংঘাতে না জড়িয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা। অর্থনৈতিক সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কারো জন্যই মঙ্গল হবে না।

আমি মনে করি দেশপ্রেম, দুর্নীতি দমনে নিস্পৃহ, আপোষহীন এবং সবাইকে নিয়ে সঠিক পথে এগুলে এখনো অর্থনৈতিক সংকট সহনীয় রাখা সরকারের আয়ত্তে আছে। তবে নিজেদের স্বচ্ছ থেকে আইনের শাসন কায়েম করা ছাড়া গত্যন্তর নাই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × five =